পিকাসোর ভুল ঠিকানায়
শেয়ার করুন
ফলো করুন

কোঁত দা’জো। মানে হলো আকাশি নীল সৈকত। ফরাসি দেশের পূর্ব উপকূলবর্তী এক অঞ্চল। এর উত্তরে ইতালি, দক্ষিণে স্পেন। আর পুবে সুনীল সাগর। আজ থেকে প্রায় শত বছর আগে এ অঞ্চলকে ইউরোপের লোকে বলত ‘হাওয়া বদলের’ স্থান। যাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষয়ে এসেছে, তিনি আসতেন এখানকার উজ্জ্বল আলো শুষে নিয়ে চোখের দ্যুতি ফেরাবার দুর্মর আশায়। যিনি গেঁটেবাতে ভুগতেন, তিনি আসতেন এখানকার সৈকতের লোনা জলে সাঁতার কেটে বাতের অসহ্য যন্ত্রণা উপশমের অভিপ্রায়ে। আর যিনি ক্ষয়রোগে ভুগতেন, তিনি আশা করতেন সাগর থেকে একটু দূরে লুকিয়ে থাকা পাহাড়ি গাঁয়ের জল-হাওয়া আর তাজা খাবার সে রোগ থেকে দেবে চিরমুক্তি। রোগ নিরাময়ের স্থান হিসেবে এ অঞ্চলের সুখ্যাতি এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছিল যে হঠাৎ করে কোনো হোটেলে কেউ মারা গেলে পেছনের দরজা দিয়ে মরদেহ সরিয়ে নেওয়া হতো। যাতে কেউ জানতে না পারে, এখানকার শহরগুলোতেও চুপিচুপি মৃত্যু নামক কালো বাদুড় এসে হানা দেয়!

কোঁত দা’জো। ইউরোপের হাওয়া বদলের জায়গা থেকে শিল্পীদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে
কোঁত দা’জো। ইউরোপের হাওয়া বদলের জায়গা থেকে শিল্পীদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে

শুধু কিন্তু রোগ উপশমের আশায় আসা রোগীরাই নন, একসময়ে এ অঞ্চলের সুখ্যাতি গিয়ে কড়া নাড়ে ফরাসি দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের দরজাতেও। বিশেষ করে চিত্রশিল্পীদের। প্যারিসের মেঘলা দিন যাদেরকে বাধ্য করত দিনের পর দিন নিজের স্টুডিওর গুমোট ঘরে বন্দী হয়ে ছবি আঁকতে, তাঁরা আবিষ্কার করলেন, প্রকৃতির খুব কাছে গিয়েও চাইলে ছবি আঁকা যায়। সেখানে প্রকৃতি না চাইতেই ঢেলে দেয় অবারিত আলো, নানা পদের ফুল সেখানে উজ্জ্বল বর্ণের পাপড়ির প্রাচুর্য মেলে সৃষ্টি করে রংধনু। সেখানে শীতকালে সবকিছু বন্ধ করে চুল্লি জ্বেলে জবুথবু হয়ে বসে থাকতে হয় না। বরং চাইলেই কোনো পাইনগাছের তলায় দাঁড়িয়ে মৃদুমন্দ বায়ু ফুসফুসে টেনে নিয়ে আঁকা যায় একের পর এক ছবি।

বিজ্ঞাপন

তেমনই এক কুহকী টানে আবেশিত হয়ে প্রথমে এলেন রেনোয়াঁ, তারপর মাতিস। সবশেষে পিকাসো। কোঁত দা’জোর সমুদ্রের ঢেউ, সাগরতীরের পাম, পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাইন আর দূরের গাঁগুলোকে আড়াল করে রাখা জলপাইগাছগুলোকে তাঁরা সিক্ত করলেন অমরত্ব প্রদানকারী সঞ্জীবনী জলে—নিজেদের ক্যানভাসে এদেরকে বারবার তুলে আনার মাধ্যমে। দেহত্যাগের পর এখানকার মাটিতেই চিরশয়ানে তাঁরা নিজেরাও মিশে গেলেন এখানকারই পঞ্চভূতে।

কোঁত দা’জো অঞ্চলের নিস শহরে আমি এসেছি শিল্পের এই প্রবাদপুরুষদের পদধূলিধন্য ভূমি আবারও দেখতে। ‘আবারও’ শব্দটি বলছি, কারণ নিস শহরে আমার আগমন এই প্রথম নয়। বছর দুয়েক আগে একবার এসেছি। তবে সেবারে উদ্দেশ্য ছিল মূলত নিস থেকে ঘণ্টাখানেক দূরের ক্ষুদ্র দেশ মোনাকো ঘুরে আসা।

বিজ্ঞাপন

এবারে যে হোটেলে উঠেছি, সেটা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে সাগর। ও নিজেও হোটেলে চাকরি করায় কী যেন একটা সুবিধে কাজে লাগিয়ে বেশ কম দামে এই হোটেলটা বাগিয়েছে। সেই সঙ্গে হোটেলের রিসেপশনিস্টের সঙ্গে খাতির জমিয়ে বাগিয়ে নিয়েছে আগামী দুই দিনের জন্য ফ্রি ব্রেকফাস্ট। আমরা রুম পেয়েছি একেবারে বারো তলায়। জানালা খুলে পর্দা সরালেই ওখানে বিষম খেতে হয়। কারণ, হোটেলের ঠিক উল্টো দিকেই এয়ারপোর্ট। সেখানে বসে আছে সারি সারি ক্ষুদ্র প্লেন। যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেওয়া যায়, এমন দূরত্বে।

হোটেলের জালনা থেকে দেখা যায় এয়ারপোর্ট
হোটেলের জালনা থেকে দেখা যায় এয়ারপোর্ট

নিসে আমরা পৌঁছালাম সন্ধ্যার একটু পর। হোটেলে গিয়ে রুম বুঝে নিয়ে তাই আমাদেরকে ছুটতে হলো রাতের খাবারের সন্ধানে। এদিকটায় দু–চারটে মুদিদোকান ছাড়া তেমন কিছু নেই। হোটেল–রেস্তোরাঁ আছে ওল্ড টাউনের দিকে। এখান থেকে পাঁচ মিনিট পরপরই ট্রাম চলছে ওল্ড টাউন অভিমুখে। আমরাও তেমন একটি ট্রাম পেয়ে টুক করে উঠে পড়ি।

নিসের ওল্ড টাউনে যে ঢুকবে, তাকে হারিয়ে যেতে হবেই। অসংখ্য শীর্ণ গলি। দুপাশের দোকানে উপচে পড়া সাবান; নানা বর্ণের রোজ, কোরাল, ম্যাপল ইয়েলো; কিছু কিছু আবার বাহারি টিনের কৌটায় বন্দী; সেগুলোর ওপরে নকশা করে লেখা—সাভন দ্য মার্সেই। একটির দাম দুই ইউরো, আর তিনটি কিনলে পাঁচ ইউরো। সাবানের দোকান ছাড়াও আছে সুগন্ধির দোকান, জলপাই তেল আর শুকনো ল্যাভেন্ডার পাতার দোকান, জেলাটোর আড়ত কিংবা ফ্যাশনেবল ফুলছাপ পোশাকের আউটলেট।

নিসের কুহ সালেয়া স্কয়ার
নিসের কুহ সালেয়া স্কয়ার

এ গলি–সে গলি পেরিয়ে আমরা একটা খোলা জায়গায় পৌঁছাই। নাম—কুহ সালেয়া স্কয়ার। এখানে দুই পাশে কেবল রেস্তোরাঁ। মাঝ দিয়ে যে চলার পথ, সেটিকে প্রায় রুদ্ধ করে রেখেছে পেতে রাখা চেয়ার-টেবিল। ও পথ দিয়ে হাঁটতে গেলে খানিকটা সতর্ক থাকতে হয়। কারণ, ওই দুই ধারের লোকেদের হাতেই ওয়াইনের গ্লাস। হাতের কাঁটাচামচে দেদার উঠছে সি ফুড, আলফ্রেডো সসে মাখা পাস্তা। একটু জোরে হাঁটলে ঠোকাঠুকি হয়ে তাদের ওই সুখী-সুখী নৈশভোজের বারোটা বাজার আশঙ্কা প্রবল।

এ ধরনের ফরাসি খাবারে আমাদের এই মুহূর্তে মতি নেই। আমরা খুঁজছি তুর্কি কেবাব র‍্যাপ ধরনের কিছু। একটু খোঁজাখুঁজি করে পেয়েও যাই তেমন একটি দোকান। এখানেও সেই বাইরে বসার ব্যবস্থা। তাতে অবশ্য ভালোই হয়। মানুষ দেখার একটা ভালো বন্দোবস্ত হয়।

আজ রাতের আকাশটা একটু অদ্ভুত। কালচে নয়। প্রুসিয়ান ব্লু। সে আলোর সঙ্গে পথের হলদে স্ট্রিটলাইট মিশে সৃষ্টি করেছে চমৎকার গ্রীষ্মকালীন আবহ। খাবার আসতে দেরি হওয়ায় দোকান থেকে চেয়ে নিই ‘সিত্রন প্রেস’। এটা ঠিক লেমনেড নয়। আবার মিষ্টি কমলার জুসও নয়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিত্রনের শরবত। একটু টক। চিনি মেশানো। এমন গরমে খেতে মন্দ লাগে না। শরবতের গ্লাসে চুমুক দেওয়ার সময়টায় পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষদের স্টাডি করার কিছুটা ফুরসত পাওয়া যায়।

ইলেকট্রিক বাইক নিয়ে ঠিক ওই সময়ে এদিকপানে হনহনিয়ে এগিয়ে আসে এক তরুণী। পায়ে চামড়ার ওয়েজ হিল। ঊর্ধ্বাঙ্গে সান ব্লিচড টিউনিক। উজ্জ্বল গোলাপি বর্ণের, ফুলছাপ দেওয়া। লো কাট। শুধু ‘লো’ বললে হয়তো একটু কম বলা হয়। বেশ ভালোই ‘লো’। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দ্রুত হাঁটলে যেমন চা ছলকে যাওয়ার উপক্রম হয়, মেয়েটিও শশব্যস্ত ভঙ্গিতে দ্রুত হেঁটে যাওয়ায় ওই গভীরে তৈরি হয় সাগরে আছড়ে পড়া ঊর্মি। সেদিকে ইঙ্গিত করে সাগর বলে, ‘ফরাসি মেয়েরা সাধারণত একহারা গড়নের। ওদের ওরকম শীতের শিশির পেয়ে তেড়েফুঁড়ে বেড়ে ওঠা ফুলকপির মতো বক্ষসম্পদ থাকে না। ওটা থাকে যখন ফরাসি রক্তের সঙ্গে মিশ্রিত হয় খানিকটা আফ্রিকান রক্ত। নিসে প্রচুর উত্তর আফ্রিকান আছে—তিউনিসিয়ান, মরোক্কান। এই মেয়েটিও তেমনই কোনো মিশ্র পরিবারের।’

রাতের খাবার শেষ করে আমরা পুরোনো শহরের সীমানা পেরিয়ে সৈকতে আসি। সৈকতের পাশেই হাঁটার রাস্তা—প্রমেনাদ দ্য অংলে। সেই অষ্টাদশ শতকের শুরুর একসময়ে একবার এ শহরে খুব ঠান্ডা পড়েছিল। যেটা সচরাচর পড়ে না। সেই তীব্র শীতে বরবাদ হয়ে গেল সেই বছরের কমলার ফলন। কাজ হারালেন কমলা-উত্তোলক শ্রমিকেরা। সে সময়ে তাঁদের বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে এল এক ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা। ঠিক হলো, কাজ হারানো শ্রমিকেরা সাগরের পাশে একটি সড়ক তৈরি করবেন, বিনিময়ে সেই দাতব্য সংস্থার কাছ থেকে পারিশ্রমিক পাবেন। আর সেভাবেই প্রায় দুই শ বছর আগে তৈরি হয়েছিল এ সড়ক। নামের শেষের ওই ‘দ্য অংলে’টা ব্রিটিশদের ওই অবদানের কথা মাথায় রেখেই দেওয়া।

এই রাতের আঁধারেও কিছু মানুষ সাঁতার কেটে ফিরছেন। কেউ কেউ আবার সাগরজলে ছুড়ে দিচ্ছেন কুড়িয়ে পাওয়া নুড়ি। একটি দল আবার ক্যাম্প ফায়ার করে সমানে বিয়ারের বোতল ধ্বংস করছে। আমাদের সঙ্গে না আছে সাঁতার কাটার সুইম ট্রাংক, না আছে ওরকম আড্ডা দেওয়ার দল। তাই এখানে না থেকে এরপর ঠিক কোথায় যাওয়া যায়, তা নিয়ে সাগরের মতামত জানতে চাই।

`বোয়াত দ্য নুই’তে চলুন।’
গোঁফের ফাঁক দিয়ে একটা ফিচকে হাসি ছুড়ে দিয়ে সাগর বলে।

 ‘বোয়াত দ্য নুই’ মানে নাইট ক্লাবে যেতে আমার আপত্তি নেই; কিন্তু মুশকিল হলো, আজ সারাটা দিন বেশ ঘোরাঘুরি হয়েছে। কালও সাতসকালেই কাগ্নে সুহ মেহ নামক কাছের এক গ্রামাঞ্চলে যাওয়ার ইচ্ছে। মাঝরাত অবধি ডিসকো মিউজিকের সঙ্গে নেচে কাটালে কাল প্রায় অর্ধেক বেলা ঘুমিয়েই কাটাতে হবে। সাগরকে তাই বলি, ‘এর চেয়ে চলো ফিরে যাই। কাল কোথায় যাব, সেটা ম্যাপ দেখে একটু আগেভাগে ঠিক করে রাখতে হবে।’

পরদিন সকাল। মিষ্টি সতেজ আলো চারধারে। সাগরের ধার দিয়ে ছুটে চলা সেই সড়ক ধরে আমরা চলেছি দক্ষিণে। গাড়ির হুইলে আমি। সাগর পাশে বসে পথনির্দেশ দিচ্ছে। ওর হাতে একটা বই। এটা ও এবার প্যারিস থেকে আসার সময়েই নিয়ে এসেছে। ভ্রমণের সময়ে পড়বে বলে। বইটির নাম ‘পিকাসোর লিথোগ্রাফি’। এই লিথোগ্রাফি ব্যাপারটি নিয়ে নাকি ইদানীং ওর বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। লিথোগ্রাফি হলো কোনো বিখ্যাত চিত্রকরের মূল চিত্রের বা স্কেচের কপি। তবে এই কপি করাটার কিছু বিশেষ পন্থা আছে। বিশেষ ধরনের বেলে পাথরের ওপর প্রথমে মূল চিত্রটি এঁকে তারপর বেশ কিছু পন্থার মাধ্যমে তার ওপর একের পর এক কাগজ সেঁটে কপি তৈরি করা হয়।

শাতো গ্রিমালদির সিঁড়িতে লেখক
শাতো গ্রিমালদির সিঁড়িতে লেখক

এতে শিল্পীর পরিশ্রম বাঁচে। তাঁকে বারবার একই ছবি আঁকতে হয় না। প্রথম ছাঁচটি তৈরির পর তা থেকে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটি কপি অনায়াসে তৈরি করা যায়। সবশেষে মূল শিল্পী সেই কপিগুলোতে একটা সাইন করে দেন। আর এভাবে যে কপিগুলো তৈরি হয়, সেগুলো ওই শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মূল্যের চেয়ে অনেক অনেক কম। এমনকি কয়েক শ ইউরো হলে নাকি পুরোনো জিনিসের অনলাইন স্টোর থেকে পিকাসোর লিথোগ্রাফিক ছবিও আজকাল পাওয়া যায়।

আড়চোখে তাকিয়ে দেখি সাগর ওই বইয়ের একটা ছবি বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে। চেয়ারে উপবিষ্ট এক নারী। মাথায় সান হ্যাট। পরনে বিচিত্র বর্ণের একটি পোশাক।
 —পিকাসোর নারীকে নিয়ে আঁকা এই ছবিগুলো দেখে প্রথমেই ঠিক কোন ব্যাপারটি তোমার চোখে পড়ে? পথের দিকে কড়া নজর রেখে সাগরকে বলি।

—চোখ। কিছুটা সময় নিয়ে সাগর বলে। এই ভদ্রলোক নারীর চোখ আঁকতেন এমন একভাবে যেন মনে হয়, একের ভেতর বহু। যেন এক মুখাবয়বে লুকিয়ে আছে দুটি ভিন্ন নারীর দৃষ্টি।

—বেশ ইন্টারেস্টিং অবজারভেশন তো তোমার। আরও একটা ব্যাপার পড়লাম কিছুদিন আগে একটা বইয়ে। পিকাসো তাঁর নারীদের যে ছবিগুলো এঁকেছেন, সেগুলোর প্রায় সবখানেই বক্ষদেশ এঁকেছেন বিড়ালের মাথার আদলে। তোমার সেই গত রাতের উপমা অনুসারে ফুলকপির আদলে নয়।

 —আরে তাই তো দাদা। কোলে লুটিয়ে থাকা বইয়ের ছবিটি নিজের চোখের কাছে টেনে সাগর বলে, কিন্তু হঠাৎ বিড়ালের মাথা কেন?

—পিকাসো খুব সম্ভবত জীবজন্তুর মাধ্যমে মেটামরফোসিসের সাহায্য নিতে চেয়েছেন। আর জীবজন্তু নিয়ে তাঁর এই এক্সপেরিমেন্টটা কিছু শুরু থেকেই ছিল। সে জন্যই ঘুরেফিরে তাঁর নানা আঁকায় এসেছে ঘুঘু, কবুতর, বিড়াল, ঘোড়া, প্যাঁচা, বানর। বিশেষ করে এই ঘুঘু আর কবুতর নিয়ে একটা গল্প তোমার জানা দরকার।

—বলুন শুনি।

১৯৪৭ সাল। পিকাসো তখন প্যারিসে। একটা সুপরিসর অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকেন। ঢোকার মুখে যে লম্বা প্যাসেজ, সেখানে রাখেন তাঁর পোষা কবুতর আর ঘুঘু পাখির ঝাঁককে। এই দুই বিশেষ প্রজাতির পাখির ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই তাঁর রয়েছে পক্ষপাতিত্ব। খেয়ালে-বেখেয়ালে বহু ছবি এঁকেছেন কবুতর কিংবা ঘুঘুর। সেই ধারাবাহিকতা থেকেই সেবার কালো প্রেক্ষাপটে আঁকলেন একটি ঘুঘুর ছবি।

সেটি আঁকার কিছুদিন পর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন বন্ধুবর আহাগ। ইনি ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টির একজন উঁচু পদের নেতা। তা তিনি এসেছেন মূলত আসন্ন পার্টি সম্মেলন উপলক্ষে পিকাসোকে দিয়ে একটা পোস্টার আঁকিয়ে নেওয়া যায় কি না, সেটা যাচাই করে দেখতে। দুই বন্ধুর কথাবার্তার ফাঁকে আহাগের চোখ গেল সেই ঘুঘুর ছবিটির দিকে। মনে হলো, হাতে চাঁদ পেলেন তিনি। ঘুঘুর সেই ছবিটিকেই তাঁর কাছে মনে হলো শান্তি আর কল্যাণের সেরা প্রতীক। পোস্টার হিসেবে ওই ছবিটিকেই বেছে নিলেন তিনি, আদায় করলেন পিকাসোর সম্মতিও। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের নানা প্রোপাগান্ডা পোস্টারেও ব্যবহৃত হতে থাকে সেই শ্বেত ঘুঘুর ছবিটি। পোস্টার, স্ট্যাম্প, ব্যানার—কোথায় নেই সেই শ্বেত ঘুঘু।

মজার ব্যাপার হলো পিকাসো কিন্তু নিজে এই ঘুঘু পাখিকে শান্তির প্রতীক ভাবতেন না। তাঁর বন্ধুর সেই পোস্টার নির্বাচন নিয়ে পরে ঠাট্টা করে বলতেন, ‘আহাগ যে কীভাবে ঘুঘু পাখিকে নম্র, ভদ্র, শান্ত ভেবে নিল কে জানে! আমার পাখির খাঁচায় একবার ভুল করে ঘুঘু আর কবুতরকে একসঙ্গে রেখেছিলাম। কয়েক দিন পর কি দেখলাম জানো? ঘুঘুগুলো সেই কবুতরটার চোখ খুবলে নিয়ে আঁচড়ে–কামড়ে মেরে ফেলে রেখেছে। নির্বিবাদী চেহারার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এমন এক আগ্রাসী পাখিকে কিনা ওরা করে ফেলল কমিউনিজমের প্রতীক? কিছু হলো এটা?’

পিকাসোকে নিয়ে এই যে আমাদের এত আলাপ, এর অন্যতম কারণ হলো আজ আমরা চলেছি পিকাসো জাদুঘরে। শাঁতো গ্রিমালদি নামক একটা দুর্গে এই জাদুঘর। আমাদের কাছে কোনো কাগজের ম্যাপ নেই। সাগর মাঝেমধ্যে কেবল ফোন দেখে বলছে, এ রাস্তা নিন, ডানে গিয়ে ওদিকের পথটা ধরুন—এসব।

সুহ মেহর জনপদ
সুহ মেহর জনপদ

আমরা একটা পাহাড়ি জনপদে পৌঁছাই। সরু পথ। গাছের নিবিড় ছায়া। গতি কমিয়ে সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। বিশেষ করে বাঁকগুলোতে। শাঁতো গ্রিমালদির প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি রাখার একটা ছোট্ট জায়গা পাই। সাকল্যে হয়তো বিশটি গাড়ি রাখা যায় ওখানে। মুশকিল হলো, একটিও ফাঁকা জায়গা নেই। আমরা বোকার মতো গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। একটি ফাঁকা জায়গা আছে বটে, তবে ওখানে রাখা ঠিক হবে কি না জানি না। নোটিশ বোর্ডের লেখাগুলো তরজমা করে সাগর বলল, এটা ডাক্তারের গাড়ি রাখার স্থান। ডাক্তার মানে অ্যাম্বুলেন্স?

না। ডাক্তার। এ অঞ্চলে নাকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী দেখার প্রচলন আছে। বিশেষ করে অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য। সেই ডাক্তাররা এসে যাতে গাড়ি পার্কিং নিয়ে ঝামেলায় না পড়েন, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। আমরা যখন ওখানটায় দাঁড়িয়ে সলাপরামর্শ করছি, একজন ডাক্তার এলেন। হাতে স্যুটকেস। আমাদেরকে হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, আমি এসেছি এক রোগীকে কয়েকটা ওষুধ বুঝিয়ে দিতে। এই মাত্র দশ মিনিটের ব্যাপার। তোমরা অপেক্ষা করো। আমি চলে গেলে এই স্পটেই গাড়ি রেখে দিয়ো। মনে হয় না ঝামেলা হবে।

শাতো গ্রিমালদি
শাতো গ্রিমালদি

ভদ্রলোক বিরাট উপকার করলেন। নয়তো আমরা ভাবছিলাম, এত দূর অবধি এসেও বুঝি শাতো গ্রিমালদির আঙিনায় পা না রেখেই ফিরে যেতে হবে।

গাড়ি পার্কিংয়ের একটা হিল্লে হওয়ার পর আমরা ঢালু পথ দিয়ে শাঁতো অভিমুখে হাঁটি। দুই পাশে পাথরের দেয়াল। দেয়াল উপচে মাথা নুয়েছে ঝোপঝাড়। দু–একটি বাড়ির কাঠের দরজা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য দুই পাশের এই কয়েক শতাব্দী পুরোনো বাড়িগুলোর টালির ছাদে মাথা উঁচিয়ে বসেছে ডিশ অ্যান্টেনার থালা। কয়েকটি বাড়ির জানালায় কুরুশের কাজের পর্দা। যাদের সে পর্দা নেই, তারা নিজেদের আড়াল তৈরি করেছেন জানালায় কিছু মানি প্ল্যান্টের টব বসিয়ে।

শাতোর প্রাঙ্গণে বেল টাওয়ারের পাশেই দুটি প্রকাণ্ড সাইপ্রাসগাছ। উজ্জ্বল সবুজ। পাতাগুলো নিখুঁতভাবে ছাঁটা। যেন একটি প্রকাণ্ড থাম। এই প্রাঙ্গণটি থেকে দূরদিগন্তের দিকে তাকালে ঢেউখেলানো পাহাড় আর মসে ঢেকে থাকা টালির ছাদগুলো একে অপরের সঙ্গে লেপটে আছে বলে ভ্রম হয়।

মিউজিয়ামের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা ছবি। তবে এটা সেই পিকাসো জাদুঘর নয়।
মিউজিয়ামের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা ছবি। তবে এটা সেই পিকাসো জাদুঘর নয়।

‘আপনি কি নিশ্চিত, এই সেই পিকাসো মিউজিয়াম?’

—টিকিটঘর থেকে দুটি টিকিট কিনে এনে ওগুলো উল্টেপাল্টে দেখার মুহূর্তে সাগর বলে। ওর হাত থেকে একটা টিকিট নিজের হাতে নিয়ে বুঝতে পারি, এটা মূলত সমকালীন চিত্রকলার জাদুঘর। পিকাসো-সম্পর্কিত কোনো কথা টিকিটে লেখা নেই। তবে কি ভুল জায়গায় এলাম? কিন্তু সেটাই বা কী করে সম্ভব? যত দূর জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পর পর পিকাসো তখনকার বান্ধবী ফ্রাঁসোয়া জিলোকে সঙ্গে করে, এ তল্লাটে এলে এখানকারই মেয়র তাঁকে গ্রিমালদি দুর্গে থেকে ছবি আঁকার বন্দোবস্ত করে দেন। পরবর্তী জীবনে পিকাসো এ দুর্গকে সে সময়ে আঁকা বেশ কিছু চিত্রকর্ম দান করেন; যেগুলো নিয়ে গড়ে ওঠে জাদুঘর। এটা যদি সত্যিই গ্রিমালদি দুর্গ হয়ে থাকে, তবে তো এটাই সেই পিকাসো জাদুঘর!

এটাকে আসলে দুর্গ না বলে পুরোনো জমিদারবাড়ি বলাই শ্রেয়। ব্যালকনির কারুকাজ, খিলান, প্রশস্ত সিঁড়ি—এসব দেখে মনে হয় এটি বুঝি কয়েক শতকের পুরোনো কোনো বনেদি বাড়ি।
 

মুজে গ্রিমালদির চত্বরে লেখক। পেছনে কাগনে সুহ মেহর পাহাড়ি জনপদ
মুজে গ্রিমালদির চত্বরে লেখক। পেছনে কাগনে সুহ মেহর পাহাড়ি জনপদ

দোতলা আর তেতলার ঘরগুলোতে যেসব প্রদর্শনী চলছে, সব কটিই সমকালীন চিত্রকলা কিংবা শিল্প প্রদর্শনী। শীতাতপনিয়ন্ত্রণের বালাই নেই। জানালা খোলা আছে। সেখান দিয়ে আসছে বাইরের হাওয়া, আলো। একটি ঘরে অবশ্য সবকিছু বন্ধ। কেমন যেন ছমছমে আধোভৌতিক পরিবেশ। নানা পদের ক্যামেরার লালচে আলো জ্বলছে-নিভছে। সঙ্গে বাজছে একটু ভয় জাগানো আবহ সংগীত।

বিদ্যুতের ঝলকের মতো চমকে ওঠা আলো। আবার অন্য একটি ঘরে এক সারি কয়লার মাঝে একটি চেয়ার। চেয়ারের মাথায় উজ্জ্বল সাদা করোটি। চেয়ারের হাতলে একটি সেল ফোন। যেন ফোনটি সেই করোটির সকল অভিব্যক্তিকে রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিচ্ছে অন্য কোথাও। প্রতি আর্টেরই তো একটি বক্তব্য থাকে। এগুলোরও নিশ্চয়ই আছে। তবে সেটা আসলে কী, আমি ধরতে পারি না। সাগর বেশ কিছু ছবিটবি তোলে। আমি একটা ফাঁকা ঘরে পৌঁছে জানালা দিয়ে রোদে মুখ করে বসে থাকি।

পাহাড়ি জনপদে দেখা হয়ে যায় এই ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে
পাহাড়ি জনপদে দেখা হয়ে যায় এই ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে

জাদুঘর থেকে বেরোনোর মুখে এর তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর কথায় আমাদের ভুল ভাঙে। গ্রিমালদি দুর্গ নামে আসলে নাকি দুটি দুর্গ আছে। একটি হলো এই কাগ্নে সুহ মেহতে; আরেকটি হলো এন্তেবে শহরে। ওটা এখান থেকে মাইল বিশেক দূরে। ওটাই হলো আসল পিকাসো জাদুঘর। আমরা চলে এসেছি ভুল ঠিকানায়।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৬: ১৫
বিজ্ঞাপন