ভিয়েতনামের কোয়াং নাম প্রদেশের হই আন শহরে নেমেই কেমন যেন একটা গভীর সুপ্রাচীন বাতাসের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগল। তাতেই টের পেলাম আমার পা পড়েছে ভিয়েতনামের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক এক শহরে। ভিয়েতনামের এই পুরোনো শহরের বয়স ২০০০ বছর। প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার লোকের বসবাস, ছবির মতো সাজানো গোছানো সুন্দর এই শহর। দিনভর এই শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকাই থাকে। একসময়ের বাণিজ্যবন্দর হিসেবে প্রসিদ্ধ এই শহর এখন ইউনেসকোঘোষিত ঐতিহ্যবাহী শহর। এই শহরকে ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
বন্ধু ড্যান কুওয়াংয়ের মোটর বাইকে ঘুরতে ঘুরতে এই শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুভব করেছিলাম। শহরের অলিগলিতে নানা প্রাণের সমারোহ মুগ্ধ করার মতো। কেউবা অলস বসে আছে, কেউবা ফুটপাতে বসে আইসক্রিম, কলা-পাউরুটি, শাকসবজি, ফুল, ফল, খেলনা, তৈজস, পোশাক, নানা ধরনের খাবার বিক্রি করছে। অনেকে আবার রাস্তায় পশুপাখি দিয়ে খেলা দেখিয়ে, বাঁশি, গিটার ও নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। এই শহর যেন একই সঙ্গে নানাবিধ জীবনের রূপ ও রং নিয়ে হাজির হয়েছে।
শহরের বাড়িগুলোর দিকে তাকালে ভীষণ মুগ্ধ হতে হয়। রূপ ও রঙে প্রতিটা বাড়িই যেন একে অন্যকে ছাপিয়ে যায় এবং একই সঙ্গে ঐতিহ্যকেও ধারণ করছে। বাড়ির দরজা, জানালা, চাল ও বাহ্যিক গঠন যেন হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যকে বয়ে নিয়ে আসছে। শহরজুড়ে একতলা, দোতলা এসব বাড়ির সামনে ও লাল চালে নুয়ে পড়ে ফুলের গাছ। কোনো ফুল শুধুই সৌন্দর্য আবার কোনো ফুল সুঘ্রাণ দিয়ে বাড়ি ও বাড়িতে বসবাসকারী ব্যক্তিদের একটা মায়াবী আবেশে বেঁধে রেখেছে। এই শহরের পুরোনো অংশগুলো এমনই মোহনীয়, নম্র ও অনুচ্চকিত সৌন্দর্যে সবাইকে আবিষ্ট করে রেখেছে।
শহর ঘুরে দেখার একপর্যায়ে চলে এলাম ১৮ শতকের পুরোনো স্থাপনা জাপানি সেতুর কাছে। এটি এই শহরের অন্যতম আকর্ষণীয় ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ধারণা করা হয়, এটি জাপানিরা তখন হই আনের নদীর পাড়ে বসবাসরত চীনা কোয়ার্টারে পৌঁছানোর উপায় হিসেবে তৈরি করেছিল। সেতুটি ১৭১৯ সালে এনগুইন ফুচ চু লর্ড উদ্বোধন করেছিলেন। এর দরজায় তিনটি চীনা প্রতীক খোদাই করা আছে। সেতুতে দুটি কুকুর এবং দুটি বানরের প্রতীক প্রথাগতভাবে জাপান সম্রাটদের জন্ম ও শাসনের বিষয়কে প্রকাশ করে। যা–ই হোক, কালের পরিক্রমায় এখন এই নান্দনিক সেতু হই আন শহরের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
এই অঞ্চলের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য শহরে চারটি জাদুঘর রয়েছে। এর মধ্যে নুগেইন হু সেন্টে ইতিহাস ও সংস্কৃতি জাদুঘরটি মূলত একটি প্যাগোডা ছিল, যেটি মিন হুং গ্রামবাসী গুয়ানিয়ানের উপাসনার জন্য তৈরি করেছিল। এখানে হ হানহ, ক্যাম্পা, ডাই ভিয়েট এবং দাই নাম সময়কালের মূল ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এটি হই আনের আদি বাসিন্দাদের ইতিহাসের সন্ধান দেয়। নুগ্যেন থাই হক স্ট্রিটে হই আন ফোকলোর জাদুঘরটি ২০০৫ সালে খোলা হয়েছিল এবং এটি পুরোনো শহরের সবচেয়ে বড় দ্বিতল কাঠের বিল্ডিং। এখানে লোকশিল্প এবং হই আনের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবন–সম্পর্কিত নিদর্শনগুলো রয়েছে।
ট্রেড সিরামিক জাদুঘরটি টি ট্রান ফু স্ট্রিটে অবস্থিত, এখানে চীন, থাইল্যান্ড, ভারত এবং অন্যান্য দেশ থেকে পাওয়া জিনিস হই আনকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একটি প্রধান বাণিজ্যবন্দর হিসেবে সাক্ষ্য দেয়। সা হানহ সংস্কৃতি জাদুঘর ট্রান ফু স্ট্রিটে অবস্থিত। এই জাদুঘর ভিয়েতনামের সা হুহান নিদর্শনগুলো প্রদর্শন করে।
পুরো শহর ও এর নানা নিদর্শন ঘুরে দেখতে দেখতে দিন গড়িয়ে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এল টেরই পাইনি। এর মধ্যে চারপাশে তাকিয়ে দেখি এক এক করে লন্ঠন জ্বলে উঠছে, তখনই মনে হয় হই আনের আসল রূপ দেখেছিলাম অপার বিস্ময় নিয়ে। গাছের ডালপালার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা লন্ঠনগুলো জ্বলে উঠে আলো ছড়াতে লাগল।
বাহারি আলো আর রঙে ঝলমল করে উঠল গোটা শহরের পথঘাট। রাতের অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লন্ঠনের আলো সৌন্দর্য বিলিয়ে দিতে লাগল। ভিয়েতনামি নবদম্পতিরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের প্রেমও লন্ঠনের আলোর মতোই এমন আদুরে হয়ে থাকবে আজীবন। পূর্ণিমার চাঁদকে সাক্ষী রেখে রেশমের তৈরি এসব লন্ঠন নিয়ে বড় উৎসবে মাতে হই আন শহরের বাসিন্দারা। এই উৎসবে সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের জন্য বাসিন্দারা একে অন্যের সঙ্গে ফুল, ফানুস, মোমবাতি ও ফলের ঝুড়ি বিনিময় করে।
ঘোরাঘুরির এক ফাঁকে খানেক ক্লান্তি নিয়ে রাতের দিকে হই আনের থু বন নদীর পাড়ে ফাইফো কফি হাউসে বসে যখন বন্ধুর সঙ্গে পদ্মফুলের পাপড়িমিশ্রিত কফি খাচ্ছি, তখন সে গল্পের ছলে এই শহরের আদি ইতিহাস বলতে লাগল। সে জানাল, হই আন শহরের পুরোনো নাম ছিল ফাইফো। বহুকাল আগে এটি ক্যাম্পা সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। মূলত মালায়া পলিনেশিয়ারা এই শহরের মূল রূপকার। তখন এই শহর ক্যাম্পা রাজ্যের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে বিবেচিত হতো। ১৪৭১ সালের দিকে এটি ভিয়েতনামের অধীনে চলে আসে। এই প্রাচীন শহর এখনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে লালন করে আসছে।
ভিয়েতনামি ভাষায় ‘হই আন’ শব্দের অর্থ ‘দেখা করার শান্ত জায়গা’। নদীর পাড়ের মুক্ত বাতাস, রেশমের তৈরি অজস্র লন্ঠনের আলো ২০০০ বছরের প্রাচীন এক শহরের শান্ত সৌন্দর্যের গভীর ছবি মনের মধ্যে এঁকে দিয়েছিল।