ভোর হতেই আমি তোড়জোড় শুরু করলাম কাছের পাহাড়ে যাওয়ার। শিম্বুলাক নাম জায়গাটির। কাজাখস্তান একটি পাহাড়ি অঞ্চলের দেশ। আলমাতি এয়ারপোর্ট থেকে গেস্টহাউসে আসার পথে দেখেছি সারি সারি পাহাড়।
আগের দিনই গেস্টহাউসে বলে রেখেছিলাম আমার জন্য ভোরে নাশতা বানিয়ে রাখতে। এখানে আমি ইউরোপীয় নাশতা পাই।
নাশতা করে ট্যাক্সি ডেকে চললাম শিম্বুলাক। বারো মাইল পথ। চালক অল্প ইংরেজি জানে। যেই শুনল আমি ভারত উপমহাদেশ থেকে এসেছি সঙ্গে সঙ্গে বলিউডের গল্প শুরু করল। আমি এ ক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়ি সব সময়। অবশ্য অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খানকে চিনি, তাই অল্পবিস্তর চাপা মারাই যায়। বাকিটা আন্দাজের ওপর চালিয়ে দিই। ট্যাক্সিচালকের নাম ইরাম। হঠাৎ দেখি ভিডিও কল করেছে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় করে দেওয়ার জন্য। মেয়েটি খুব মিষ্টি, ওদের বাচ্চার বয়স ১১ মাস। আমি ইরামকে বললাম, ‘তোমাকে দেখে কুড়ি বছরের বেশি বয়স বলে মনেই হয়নি আর তুমি বিয়ে করে বসে আছ!’ সে বলে, ‘আমার বয়স ২৪।’
স্ত্রীর পর পালা আসে ইরামের বোনের সঙ্গে কথা বলার। বোনটির একটি মুদিদোকান আছে, দোকানে বসেই গল্প শুরু করল। সে অল্প ইংরেজি জানে। সেও খুব খুশি আমার সঙ্গে কথা বলে। বলিউডের এত শক্তি, জানতাম না তো! জানলে খানকয়েক সিনেমা দেখেই ফেলতাম।
ধীরে ধীরে ট্যাক্সি আরও নির্জন পথের দিকে যেতে লাগল। দুই পাশে পাহাড় আরও ঘন হচ্ছে, আরও সবুজ হচ্ছে চারপাশ। এমন নির্জনতায় পাহাড়ের আসলে অনেক কিছু বলার থাকে। জানান দিতে পারে না, মেঘের মতো গমগম শব্দ তুলতে পারে না৷ বৃষ্টির মতো আছড়ে পড়তে পারে না নদীতে। কিন্তু পাহাড়ের নিত্যসঙ্গী এই মেঘবৃষ্টি তার হয়ে কথাগুলো বলতে শুরু করে। কেউ না থাকলে ঠিক পাহাড়কে নিয়ে উড়াল দেয়। আবার কেউ থাকলে মেঘই পাহাড়কে ঢেকে দেয়।
ইরাম আমাকে জায়গামতো নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। জায়গাটা এত নিরিবিলি, আশপাশে কোনো লোকজন নেই। যত দূর ইচ্ছে পাহাড়ের হাত ধরে ধরে হাঁটা যায়।
আমি তো যেতে চাই পাহাড়ের একদম চূড়ায়। সেখানে যেতে হলে কেবল কারে করে যেতে হয়। আমি কেবল কারের দিকে চললাম। যেখানে টিকিট বিক্রি হয় তার পাশেই কফিশপ। এখানকার তাপমাত্রা আলমাতি শহরের চেয়ে কম। তাই এক কাপ কফির আবদার করাই যায়।
কফিশপটি খোলা আকাশের নিচে। সোফায় বসে পাহাড় দেখতে দেখতে আরাম করে কফি খাওয়া যায়। মেঘাচ্ছন্ন বলে আরও আদুরে হয়েছে আবহাওয়া। অবশ্য রোদ থাকলেও পাহাড়ে তাতিয়ে ওঠে না সে। এ দেশের জনসংখ্যা এতই কম যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই কফিশপে। ছুটি কাটানোর জন্য এ রকম নির্জন জায়গা আমি আর কোথাও পাইনি।
পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়ার জন্য টিকিট কেটে নিলাম। রাত আটটার আগেই ফিরে আসতে হবে। মাঝখানে একবার কেব্ল কার বদলাতে হবে। পাহাড়ের একদম মাথায় নাকি এখন যাওয়া যায় না। না হোক যত দূর যাওয়া যায় তত দূরের টিকিট নিলাম। টিকিট চেকারকে দেখে আমার বেহুঁশ হওয়ার দশা। এত সুদর্শন যে হলিউড হিরোকেও হার মানায়। কয়েক সেকেন্ডের বেশি দেখার সুযোগ হলো না। আমার দুশমন কেব্ল কার এসে হাজির। কেব্ল কার আমাকে নিয়ে পাড়ি দেবে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ। একটা গাড়িতে আমি একাই চড়ে বসলাম। চলতে লাগল আমার গাড়ি পাহাড়ের পাশ কাটিয়ে, বরফগলা শুভ্র নদীর ওপর দিয়ে। আশপাশে এখন শুধুই পাহাড় আর ঘন বন। কোথাও কোনো জনমানব নেই। কখনো পাহাড়ের সবুজ গাছের লকেট পরে সাদা নদী আলসেমিতে শুয়ে আছে, কখনো গাছগুলোই একেকটা নদী হয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে আরও দূরের পাহাড়ের দিকে।
আজ আবহাওয়া ভালো, খুব বেশি ঠান্ডা নেই। নিচের দিকে আলমাতি শহরে তো এখন গরমকাল। যদিও দূরদূরান্ত অবধি পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ পায়ের নিচে শূন্যোদ্যান মানে অনেকখানি ওপরে এসে গিয়েছি। শুধু পাহাড়ই নয়, পাহাড়ের মাঝে এঁকেবেঁকে চলা পথও দেখছি। দূরে ছোট ছোট কটেজের মতো বাড়ি। পাহাড়ে সাঁতার কাটতে কাটতে বাড়িগুলোর ওপর দিয়ে মেঘ হয়ে উড়ে যাচ্ছি৷ এ রকম জায়গায় একটা বাড়ির স্বপ্ন আমি সব সময় দেখি৷ চুপচাপ লনে বা বারান্দায় বসে বসে পাহাড়ের সঙ্গে গল্প করা যায়। নাগরিক ঝাঁ–চকচকে জীবন আমায় টানে না। একটা পাহাড়ে আট-দশটা বাড়ি আছে। পাশের রাস্তায় একটা গাড়ি চলছে। বোধ হয় এই বাড়িগুলোর একজনের গাড়ি। একেবারে মনুষ্যবিবর্জিত এলাকা। চারপাশে সারি সারি পাহাড়। সূর্য এখন একটু পেখম মেলেছে, উষ্ণ করছে পাহাড়কে। আর পাহাড় তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে, যেন ছেড়ে না যায়।
প্রায় আধঘণ্টা আমি কেব্ল কারে বসে উঁচুতে উঠতে উঠতে পাহাড় দেখছি। আগে যখন মাউন্টেইন ক্লাইম্বিং করতাম তখন তো পাহাড় বেয়ে এই উচ্চতা ভেদ করতাম আরও অনেক উচ্চতার মাটি ছোঁব বলে, পাহাড়কে আরও কাছে পাব বলে, পাহাড়ের নিখাদ সবুজ গন্ধ গায়ে মাখব বলে। পাহাড়ে আমার কত যে গল্প আছে! পাহাড়ের সঙ্গে আমার আরও কত গল্প বলার আছে!
কয়েকটা পাহাড় পরপর একটা-দুটো বাড়ি দেখা যায়। আমার ঘর খুঁজে পাই। ঘর কি কখনো পর করে দেয়! দেয় না। তাই তো পাহাড়কে আমার সব সময়ই নিজের ঘর বলে মনে হয়। মেঘ পাহাড়কে ছুঁয়ে ছুটে যায়। কখনো ঘরের বারান্দা ভরে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ চুপ করে লুকিয়ে থাকে, কখন সূর্য তাড়া দেয়, মেঘ পালায়। আবার সূর্যকে ঠিক দেখে নেবে বলে দিয়ে ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরায়। ঝমঝম করে ওঠে পাহাড়ের মন। সে তখন সবুজ পরি ওড়ানোয় ব্যস্ত থাকে। আমার মতো অবোধ মানুষের কৈশোর ফিরিয়ে দিতে দিতে সে ধীরে ধীরে মুছে যায় দৃশ্যপট থেকে। তখন সামনে আসে নতুন এক ভুবন। আমি আরও এগিয়ে যেতে থাকি ফিনিক্স পাখির পিঠে চড়ে।
সামনের দিকে পাহাড় একাকী আমায় এগিয়ে নিয়ে যায়। এখন আর কারও বাড়ি নেই। দুপাশে নিবিড় পাহাড়ের জড়াজড়ি, সতেজ গন্ধ।
এসব দেখতে দেখতে কেব্ল কার আমাকে প্রথম গন্তব্যে নামিয়ে দিল। কেব্ল কার স্টেশন ফেলে ডাইনে–বাঁয়ে শুধু পাহাড়। সামনে আরেকটু ওপরে যাওয়ার ভিন্ন কেব্ল কার। আমি আরও ওপরে উড়তে চাই। বরফের দেশে যেতে চাই। যে বরফ দূরের পাহাড়ের চূড়াকে ঢেকে দিয়েছে, সেই বরফকে দখল করতে চাই। বরফকে দখল করলে কি সে আমার হবে, না গলে যাবে?
এবার কেব্ল কারে চড়ে আরও ওপরের দিকে উঠে গেলাম। পথে পেলাম বরফে তৈরি করা পথ, আমার পায়ের নিচ দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে সাদা পথ। দেখে মনে হয় কেন যেন বেলিফুল ছড়িয়ে দিয়ে পথ করে রেখেছে। ওপরের দিকে উঠতে উঠতে আরও বরফ দেখা গেল। এখন জুন মাস, আলমাতিতে গ্রীষ্মকাল। শহরে আমাদের দেশের মতো এত গরম পড়ে না তবু গরমকালই মনে হয়। কিন্তু এখানে তো একেবারে বরফের দেশে নিয়ে এসেছে। এই বরফ এখন আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল পাহাড়ের আরও ওপরে।
কেব্ল কার স্টেশন থেকে বের হয়ে দেখি বরফে বরফে ছেয়ে গেছে চারদিক। এখানে বেশ কিছু দেশি–বিদেশি ট্যুরিস্ট জমা হয়েছে। ভারতীয় একটা পরিবারও দেখলাম। প্রচণ্ড চিৎকার করে এই শান্ত পরিবেশের বারোটা বাজাচ্ছে। বেশির ভাগই বরফে হেঁটে হেঁটে আরও ওপরে পাহাড়ে যেতে চাইছে। অনেক দূর পর্যন্ত ওঠার অনুমতি নেই। ওপরে নিশ্চয়ই আরও ঠান্ডা আর নির্জন। আমিও পা টিপে টিপে বরফের কোমল ফুলেল শরীর পেরিয়ে আরেকটু ওপরে হেঁটে বেড়ালাম। বিদেশি ট্যুরিস্টদের চেয়ে দেশিরাই দেখি বরফ দেখে বেশি উল্লসিত। শীতকালে এখানে অনেকেই স্কি খেলতে আসে।
এখন খুব বেশি ঠান্ডা লাগছে না, কারণ সূর্য মেঘকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বরফে তাই একটু গড়াগড়ি দিতে মন চাইল। কয়েকটা বাচ্চা আমার পাশ দিয়ে স্লেজ গাড়ির মতো ঢালের দিকে নেমে গেল। এই ছোট ছোট বাচ্চারা পারে আর আমি পারব না, এমন কখনো হয়নি। আমিও স্লেজ হলাম কিছুক্ষণের জন্য। বাচ্চাদের নকল করছি ভেবে ওরাও খুব খুশি। ভাগ্যিস, দেশটা কাজাখস্তান, কোনো গম্ভীর স্বভাবের দেশ নয়, যেখানে অন্যের বাচ্চাদের পা ধরে টানাটানি করা, গালে বরফ মাখানো অনুচিত। বাচ্চারা আমাকে ছাড়ছিল না, আমি চলে এলাম। অনেক বছর পর এত কাছ থেকে, অনেক ওপর থেকে পাহাড় দেখছি। আমার রক্তে এখনো পাহাড় জয় করার নেশা।
আমি কেব্ল কার স্টেশনের অন্য পাশে চলে গেলাম। আগেই দেখেছি এখানে কোনো মানুষ নেই। এপাশটায় বরফও নেই তেমন। একটু একটু ঠান্ডা লাগছে। জ্যাকেট পরে এক সারি পাহাড়ের মুখোমুখি বসলাম। অনেক জন্মের কথা বাকি আছে, বলার আছে গত কয়েক জন্মে আমি কী ছিলাম, কী হয়েছিল তারপর। তারপর এই অক্ষয় পাহাড় বলবে তার কাছে আমি ছাড়া আর কে এসেছিল এমন ব্যাকুল হয়ে। আমি চোখ মেলে দেখি, সামনের দিকের পাহাড় সবুজের ছড়াছড়ি, নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে।
এ রকম সবুজ পাহাড় যদি পোশাক হতে চায়, তাহলে আজীবন আমি তাকে আঁকড়ে ধরে থাকব। পৃথিবীর সব সুগন্ধের চেয়ে সবচেয়ে মোহময় সুগন্ধ হলো সবুজ গাছের সুগন্ধ, লম্বা লম্বা পাইন, বার্চ, কলকি বা উইলোগাছের তাজা সুগন্ধ৷ ইচ্ছে করে কয়েকটা ডাল নিয়ে গন্ধ শুঁকতে থাকি। কিন্তু এই গাছগুলো আমার এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। সামনে পাহাড় ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে আবার আরেকটা পাহাড় হয়ে উঁচুতে উঠে গেছে, সে পাহাড় থেকে গাছগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর তার ওপরে বরফ।
কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। দেখি এপাশটায় একদল আরব ট্যুরিস্ট এসে গেছে—মা বাবা, দুই ছেলে। মায়ের বয়স বোঝা যাচ্ছে না, ভালো ইংরেজি জানে। ওরা এসেছে ওমান থেকে। ছেলে দুটোও বেশ ইংরেজি জানে, টিনএজ হবে বা একটু বড়। এরা চারজনই এই নির্জনে এসেছে জোহরের নামাজ পড়তে। নামাজ পড়া শেষ হলে আবার চলেও গেল। এখন পুরো প্রকৃতি আমার। (আগামী পর্বে শেষ)
ছবি: লেখক