শিম্বুলাক ২: পাহাড় আর ঘোরের বাসিন্দা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমার ব্যাগে পিকনিকের সরঞ্জাম সব সময় থাকে। আমি দুপুরের খাবার বের বেশ আয়োজন করে খেলাম। এমন পরিবেশ অনেক দিন পর পেয়েছি—খোলা আকাশ, পাহাড়ি সবুজ, ঢালু তরঙ্গ, বাতাসে বরফের গন্ধ, একটু একটু হিম হতে হতে চোখ মেলে পাহাড়ের উদারতা দেখা।

আরও কিছুক্ষণ বসে আমি কেব্‌ল কার স্টেশনে গেলাম নিচে নামার জন্য।
সমতল আর চূড়ার মাঝামাঝি জায়গায় যে টুকরা বনভূমি আছে, সেখানে নেমে গেলাম। এখানে ওপরের চেয়ে ট্যুরিস্ট বেশি। অবশ্য আমি জানি কোথায় একেবারেই মানুষ নেই। পাহাড় বেয়ে সামান্য ওপরে উঠে দেখি, এখানে নানা রঙের বুনো ফুল বসন্ত নামিয়ে দিয়েছে। ফুল আর ঝোপঝাড় এত তাজা যে এখানে গড়াগড়ি দিয়ে এ বেলা পার করে দেওয়া যাবে। জনমানবহীন একটা জায়গায় এসে পড়েছি, আরেকটু সামনে যাওয়াই যায়, কারণ সামনে বাঁ দিকে দূরে একটা কটেজ দেখা যাচ্ছে। সেটা যদি হোটেল বা গেস্টহাউস হয়, তাহলে আমি এ জায়গায় থাকার লোভ আর সামলাব না।

বিজ্ঞাপন

পাহাড় বেয়ে চলাফেরা করার অভ্যাস একেবারে চলে গিয়েছে। তা–ও ফুল ডিঙিয়ে, নতুন ঘাস মাড়িয়ে কটেজের সামনে এসে পড়লাম। ট্যালি করা চৌকোনা লাল ছাদ আর সাদা দেয়াল নিয়ে বেশ দেখতে কটেজটা। আশপাশে কেউ নেই। আমি যে জনহীন এতটা পথ চলে এসেছি, তা–ও কেউ জানে না। অন্যের প্রপার্টিতে বিনা অনুমতিতে অনুপ্রবেশের শাস্তি আবার না পেতে হয়। ব্যাঙ্গালোরে একটা রাস্তার ধারের দেয়ালে লেখা দেখেছিলাম, ‘এটা সেনাবাহিনীর সম্পত্তি, এখানে পা দিলে গুলি করা হবে।’ কী ভয়াবহ কথা! কে দেবে পা ওসব অলক্ষুনে জায়গায়!

আশপাশে প্রাকৃতিক ফুলবাগান
আশপাশে প্রাকৃতিক ফুলবাগান

তার চেয়ে আমি কটেজের দিকে মনোযোগ দিই। পেছনে পাহাড় ঘন হয়ে জলপ্রপাতের মতো উছলে পড়ছে। আশপাশে প্রাকৃতিক ফুলবাগান আর ধীরে বয়ে যাচ্ছে সূক্ষ্ম মেঘ আমাকে ঘিরে। কিন্তু কটেজের আশপাশে বা ভেতরে কেউ নেই। খুব সম্ভবত নতুন তৈরি করা হয়েছে। আমি ফিরে গেলাম আমার পাহাড়ি ফুলের বনে। এখানে এই ছোট ছোট গুল্মে শিশির লেগেছে। বসলে যদি ফুলেরা আঘাত পায়, তাই এক পাশে ঘাসের ওপর বসলাম। অনেকখানি নিচে কেব্‌ল কার স্টেশনে মানুষের জটলা। আমার বাঁ পাশে বেশ দূরে গুচ্ছ গুচ্ছ বরফ জমাট বেঁধে আছে।

রেশমের নানা রংয়ের গালিচা যেন পাহাড়ের ঢালে বিছিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি
রেশমের নানা রংয়ের গালিচা যেন পাহাড়ের ঢালে বিছিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি

কিছু মানুষের আগ্রহ সেদিকে, কিন্তু আমার আগ্রহ এখন হলুদ বাটারকাপ ফুলের গালিচা। রেশমের হলুদ–সবুজ একটা গালিচা যেন পাহাড়ের ঢালে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি সটান শুয়ে পড়লাম। আকাশে এখন মেঘ উড়ন্ত। সূর্য আর বিরক্ত করছে না। পাশে অগুনতি হলুদ ঝলমলের ঝাপটা। স্বপ্ন সত্যি হলেও এতখানি আনন্দ হওয়ার কথা নয়। আমার এখন গড়াগড়ি করার চেয়ে উড়ে যেতে বেশি ইচ্ছা করছে। উড়তে উড়তে পার হব সেসব পাহাড়, যেখান দিয়ে কেব্‌ল কার আমাকে নিয়ে আসেনি। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকা গাছগুলোর রহস্য আমি ছাড়া আর কেউ খুঁজতে আসবে না।

বিজ্ঞাপন

আমি কখন যে ঘোরে চলে গিয়েছি, তা জানি না। ঘোর কাটল একটা মেয়ে আমার দিকে আসছে দেখে। আকাশি মিডি পরিহিত মেয়েটা অবশ্য আমার দিকে না এসে অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। এক ফুট উঁচু গুল্মের মাঝে আমাকে না দেখতে পাওয়ারই কথা। লক্ষ করলাম হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটি কাঁদছে, আরও দূরে চলে যাচ্ছে। আমার মনে হলো মেয়েটিকে কাছে ডাকি, মন খারাপের কারণ না জানলেও অল্প কিছু ভালো সময় তাকে উপহার দিই। আমি মেয়েটির পেছনে ছুট দিলাম। অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে। আমি দৌড়াচ্ছি আর ভাবছি, মেয়েটি যেন আমার কথা শোনে। আমি কাছে গিয়ে বললাম, ‘তুমি কি আমার একটা ছবি তুলে দেবে? এই জায়গা এত নির্জন যে কেউ নেই ছবি তুলে দেওয়ার।’ মেয়েটির নাম মেদিনা। বয়স ২৫ কি ২৬, ইংরেজি পড়ায়।

মেদিনাকে দিয়ে তোলানো লেখকের ছবি
মেদিনাকে দিয়ে তোলানো লেখকের ছবি

বেশ ভালো ইংরেজি জানে। আমি শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তোলালাম মেদিনাকে দিয়ে। মেদিনা আসলেই খুব ভালো ছবি তোলে। এখন অবধি যত মানুষ আমার ছবি তুলে দিয়েছে, তাদের মধ্যে সেরা। আমি উচ্ছ্বসিত স্বরে বললাম, ‘দেখো মেদিনা, ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে কোনো প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার তুলে দিয়েছে।’ মেদিনার মুখে হাসি, চেহারার মেঘ সরে গিয়েছে। ও বলল, ‘আমার কয়েকটা ছবি তুলে দাও।’ আমি হয়তোবা মেদিনার মতো সুন্দর ছবি তুলিনি, তবে ওর ভারাক্রান্ত মন যে হালকা করতে পেরেছি, সে জন্য আজকের দিন সার্থক। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে মেদিনা নিচে নেমে গেল।

এখন সবে বাজে বিকেল পাঁচটা। হাতে অনেক সময় আছে কেব্‌ল কারে করে নিচে পৌঁছানোর। আরও এক ঘণ্টা চুপচাপ ঘাসে বসে জীবন ও যাপন বিষয়ে উতি উচ্চমার্গের কিছু উপদেশ দিলাম পাহাড়কে। কফি খেতে হবে। কেব্‌ল কার স্টেশনের পাশেই কয়েকটা রেস্তোরাঁ আর কফি শপ। কফি নিয়ে আমি আবার কাছের একটা পাহাড়ের কোনায় বসলাম। প্রকৃতি আর কফিকে আলাদা করার দুঃসাহস আমার নেই।
এরপর কেব্‌ল কার ধরার জন্য স্টেশনের দিকে এগোলাম। কেব্‌ল কার একটার পর একটা আসছে আর যে যেটায় ইচ্ছা চড়ে বসছে। এদিকের রক্ষণাবেক্ষণ করছে জিনস আর টি-শার্ট পরা দুই নারী। আচার-আচরণে তারা এত স্মার্ট যে আমি তাকিয়েই থাকলাম।

নিচে বরফগলা নদী
নিচে বরফগলা নদী

নিচে নেমে আমি বরফগলা নদীর দিকে হাঁটতে থাকলাম। বেশি দূরে নয়, কেব্‌ল কার স্টেশনের উল্টো পাশেই বিশাল গর্জন তুলে শুভ্র নদী বয়ে চলছে। নদীর পাড়ে কয়েকজন ছবি তুলছে। আমি একটা নির্জন জায়গা খুঁজছি। মূল সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকখানি এসে দেখি শুধু পাহাড়, নদী ও আলমাতি ফিরে যাওয়ার সড়ক ছাড়া আর কেউ নেই। পাহাড়ি ঢালে নদী। সেদিকে গড়িয়ে পড়লে আজ নদীর স্রোতে ভেসে যেতে হবে। নিচের দিকে যাওয়ার পথ আগাছা–গুল্মে–শিশিরে স্নান করে আছে, আলাদা করে পথের চিহ্ন নেই। তার মানে এখানে কেউ সচরাচর আসেও না।

আমি মুহূর্তে ক্রিস্টোফার কলম্বাস হয়ে গেলাম। এক এক পা ফেলে, একটু হামাগুড়ি দিয়ে হলুদ, বেগুনি ও গোলাপি ফুল পেরিয়ে চলে এলাম নদীর ধারে। সাদা সাদা ঢেউ যেন নদী ছেড়ে আমার কাছে ধরা দিতে চাইছে। নদীর অপর পাশে বন। অনেক দূরে সবুজের মাঝে সাদা মেঘ দেখা দিতে দিতে মিলিয়ে যেতে চাইছে। সবুজ তাজা গাছপালার ঘ্রাণ প্রাণভরে নেওয়ার জন্য আমি যেকোনো পথ পাড়ি দিতে পারি।

একটি কাজাখ পরিবার
একটি কাজাখ পরিবার

নদীটা সামনে এগিয়ে ডানে বাঁক নিয়েছে। নদীর পাড় বড় বড় পাথর দিয়ে বাঁধানো। তবু আমি পাথর গলে নদীর কাছাকাছি গেলাম। খরস্রোতা নদী, পা ফসকে নিচে পড়লে আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনিতেই কেউ নেই। আর আমি যে সড়ক ধরে এসেছি, সেটি হাইওয়ে। কখনো কোনো গাড়ি বা বাস থামে না, শাঁই শাঁই করে চলে যায়। এত নিচে আমি চলে এসেছি যে সড়ক থেকে খুব খেয়াল না করলে দেখাও যাবে না। আমার ভয় করে না, কোনো এক নতুন দেশ জয় করার আনন্দ জাগে।

মাঝারি আকারের একটা পাথরের ওপর ফুলের জগতের মাঝখানে বসে নদীতে সাঁতার কাটার ইচ্ছাকে দমন করলাম। ওপারে পাইন ও বার্চগাছ ছাড়া আর কিছুই নেই, তবু যেখানে যাওয়া যায় না বা যেখানে যেতে মানা, সে জায়গা আমাকে খুব টানে। এ জায়গায় সূর্য মাঝে মাঝে আছে আবার নেই হয়ে যাচ্ছে, মেঘ ঢেকে দিচ্ছে পুরো আকাশকে। তাই সূর্যাস্ত দেখতে চাইলেই যে দেখা যাবে, তা–ও জানা নেই।

বসে থাকতে থাকতেই টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। এই পাথরের আসনে মাথার ওপর ছাতা ধরে থাকা কোনো গাছও নেই। উল্টো বৃষ্টি বাড়লে ফেরার পথ পিচ্ছিল হয়ে যাবে। তাই ধীরে ধীরে আবার মূল সড়কে উঠে পড়লাম। ততক্ষণে বৃষ্টি উধাও। আমি আসার সময় দেখেছি, এখানে দুই কিলোমিটার পরপর বাসস্ট্যান্ড আছে। খানিক এগিয়ে বাসস্ট্যান্ডও পেয়ে গেলাম, ছাউনিও পেলাম। ২০ মিনিট পাহাড় দেখতে দেখতে একটা বাস এসে গেল।

তবে আমি আর শিম্বুলাক এক হয়ে রইলাম পাহাড়ের গায়ে মিশে, গাছের তাজা ঘ্রাণের সঙ্গে, বুনো ফুলের রং আঙুলে মেখে। (শেষ)

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ০০
বিজ্ঞাপন