শান্তিনিকেতনকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ ঘোষণায় দুই বাংলায় খুশির আমেজ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

পথচলাটা শুরু হয়েছিল সেই ১৯০১ সালে। বহু ঘাত-প্রতিঘাত, আর্থিক সমস্যা পার করে তিলে তিলে গড়ে উঠেছিল ‘প্রাণের আরাম’ শান্তিনিকেতন আশ্রম। পরে বিশ্বভারতী।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নের, আদর্শের বিশ্বভারতী বরাবরই বিশ্বের দরবারে সমাদৃত তার শিল্প, সংস্কৃতি, কৃষ্টির জন্য। তবে ইউনেসকো যখন সেই শান্তিনিকেতনকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ বা ‘বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান’-এর তকমা দিল, সে যেন আপামর বাঙালির কাছে বাড়তি পাওনা।

এটা যে শুধু ভারতবর্ষের গর্বের বিষয় তা নয়, দুই বাংলাই শান্তিনিকেতনের ডোরে বাঁধা বিশ্বকবির হাত ধরে। তাই স্বাভাবিকভাবেই খুশির হাওয়া দুই বাংলার আকাশে, বাতাসে। দুই দেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতার প্রাণের আরামের শান্তিনিকেতনের মুকুটে যুক্ত হলো আরও একটি পালক।

১৮৬৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে ২০ একর জমি ইজারা নিয়েছিলেন। তবে সে সময় ‘শান্তিনিকেতন গৃহ’টি ছিল। কিন্তু, মতান্তর আছে যে শান্তিনিকেতন নামকরণটি ওই গৃহ থেকে আগেই হয়েছে, নাকি মহর্ষি গৃহটির নামকরণ করেছেন, তার থেকে ‘শান্তিনিকেতন’ নাম হয়েছে আজ! মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৮৭৮ সালে প্রথম শান্তিনিকেতনে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বিজ্ঞাপন

১৮৮৮ সালে একটি ট্রাস্ট তৈরি করে এখানে ‘ব্রহ্ম আশ্রম’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যদিও শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্চা ও উপাসনা শুরু হয় ১৯০১ সালে। ধীরে ধীরে শান্তিনিকেতন পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পদক পান। তারপর কবির শান্তিনিকেতনের নাম বিশ্বের দরবারে জ্বলজ্বল করতে শুরু করে। ব্রহ্ম আশ্রমের পাশাপাশি ১৯২১ সালে গুরুদেব প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী।

এখানে বলে রাখা ভালো যে আর পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন গুরুদেব। কারণ, বাঁধাধরা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি গুরুদেবের অনিহা ছিল চিরকালই। ‘তোতাকাহিনী’, ‘অচলায়তন’ প্রভৃতি লেখায় তিনি গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাই কবির শান্তিনিকেতন হলো প্রকৃতির সান্নিধ্যে পাঠদান। গাছের তলায় বসে পঠন-পাঠন, যেখানে শিল্প ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কবির ভাবনার ‘সংগীত ভবন’ ও ‘কলাভবন’ আজও সমান ধারায় প্রকৃতির কোলে শিল্পচর্চা করে চলেছে।

বিজ্ঞাপন

একইভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাষাকে গুরুত্ব দিতে গুরুদেব তিলে তিলে একটি ভাষার ভবন গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বভারতীতে।তাই শান্তিনিকেতন মানেই মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে শিল্পের বিকাশ, সংস্কৃতির আদান-প্রদানের তীর্থক্ষেত্র। কবিগুরুর সময় এখানে যেসব প্রথার সূচনা হয়েছিল, তা আজও বিদ্যমান। যেকোনো অনুষ্ঠানে শান্তিনিকেতনের ছেলেরা সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা এবং মেয়েরা সাদা বা হলুদ শাড়ি পরেন। এখানে ব্রহ্ম উপাসনা, বৈদিক মন্ত্রপাঠ, রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রনৃত্য, আচার্যের ভাষণ প্রভৃতি আচার পালিত হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

এখানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী উপাসনা গৃহ, শান্তিনিকেতন গৃহ, তালধ্বজ, সিংহ সদন, গৌর প্রাঙ্গণ, ঘণ্টাতলা, ছাতিমতলা, কালো বাড়ি, তিনপাহাড়, সংগীত ভবন, কলাভবন, আম্রকুঞ্জ, রবীন্দ্র ভবন প্রভৃতি। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে প্রখ্যাত শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ, নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য, যা অমূল্য সম্পদ।

২০১০ সালে প্রথম শান্তিনিকেতনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা দেওয়ার জন্য দ্য ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশনের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে আরও বেশ কয়েকটি আবেদন করা হয়েছিল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। তারপর ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেসকোর ৭ সদস্যের প্রতিনিধিদল শান্তিনিকেতনে এসেছিল। সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের আধিকারিকেরা। তাঁরা শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী স্থানসহ ভাস্কর্যগুলো ঘুরে দেখে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন।

এ বছরের ১০ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবে ইউনেসকোর ৪৫তম আসর বসেছে। সেখানে বিশ্বকবির শান্তিনিকেতনকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়। এ যেন শান্তিনিকেতনের মুকুটে এক নতুন পালক। ঘোষণা হতেই রীতিমতো উচ্ছ্বসিত বিশ্বভারতীর পড়ুয়ারা থেকে শুরু করে অধ্যাপক, আধিকারিক, শান্তিনিকেতনবাসী, প্রাক্তনী, আশ্রমিকসহ সবাই। আজ নতুন করে বিশ্বের দরবারে শান্তিনিকেতন সমাদৃত হওয়ায় সশ্রদ্ধায় গুরুদেবকেই স্মরণ করছেন সবাই।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪: ১৬
বিজ্ঞাপন