সিকিম সমগ্র
শেয়ার করুন
ফলো করুন

পরদিন সকাল সকাল আমরা হাজির হলাম জাম্বালা ট্যুরসের অফিসে। আগের দিন ওদের মাধ্যমেই গ্যাংটক সিটি ট্যুর করেছি। যাচ্ছি নর্থ সিকিমে, ইয়ুমথাং ভ্যালি। অনেক লম্বা পথ। সারা দিনের যাত্রা। যত তাড়াতাড়ি রওনা দেওয়া যায়, ততই ভালো। কিন্তু গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে সেই নয়টা বাজল। নর্থ সিকিমে যাওয়ার জন্য গ্যাংটকে আছে আলাদা জিপস্ট্যান্ড। সেখানে গিয়েও আবার খানিক ছোটাছুটি। শেষ পর্যন্ত গাদাগাদি করে ৯ জন গাড়িতে উঠলাম বটে, তাতে কি স্বস্তি মেলে! দুই দিন এক রাতের প্যাকেজ। ৯ জনের জন্য ১৬ হাজার রুপি। গাড়ি গ্যাংটকের সীমানা ছাড়াতেই ঘরপালানো বাতাসের শিস শরীর-মনে অনুরণিত হতে শুরু করল।

পাহাড়ি পাকদন্ডীর পথে
পাহাড়ি পাকদন্ডীর পথে
ছবি: লেখক

পাইন বার্চ ফার বাঁশের বনের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা আমাদের নিয়ে চলেছে অচিনপুরে। সেই ঘোরে আমাদের ছেদ ঘটাল পাহাড়ি রাস্তার জন এবং গাড়ি জট। সামনেই বাটারফ্লাই ওয়াটার ফলস। পথের পাশেই ভারী সুন্দর জলধারা। কিন্তু অতি উৎসাহী পর্যটক আর গাড়ির প্যাঁ পুঁ-এর কারণে নষ্ট হচ্ছে মুহূর্ত। তাড়াতাড়ি ক্যামেরায় কয়েকটি ক্লিক এবং গাড়িতে উঠে চম্পট। কিছুদূর যেতেই আবার সেই প্রকৃতির অবারিত দখলে থাকা চিরচেনা সিকিমিজ গ্রাম-বনবাদাড়। দেখতে দেখতে তন্দ্রামতো এসে গিয়েছিল। চোখ খুলেই দেখা মিলল তিস্তার। সমতলে বাংলাদেশের সেই রুক্ষ, হাঁটুজলের জীর্ণ নদীটি নয়। সবুজ, টইটুম্বুর জলধারা মনকে প্রশান্তি এনে দেবে।

বিজ্ঞাপন

সিকিম হিমালয়ের গহিন দুর্গম থেকে জন্ম নিয়ে ক্রমে সে অগ্রসর হয়েছে সমতলের দিকে। কিন্তু এই পাঁচ হাজার ফুটের ওপরের অঞ্চলে তার রূপ নামের মতোই সুন্দর। সাপের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পথ আমাদের নিয়ে গেল একেবারে নদীর বুকে নির্মিত ব্রিজের ওপর। এখানে একটু বিরতি। মেঘ যেন নেমে এসে নদীর জলে লুটোপুটি খেলছে। খালি চোখে দৃশ্য দেখে আশ মেটে না। ক্যামেরার সদ্ব্যবহার এখানেও। তারপর আবার চলা। দুপুরে পথের পাশে ধাবায় জম্পেশ খাওয়া। এরপর চোখজুড়ে গভীর তন্দ্রা। রাস্তার দুর্গতিতে এ ঘুম যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। না পারছি আরামে চোখটা বুঝতে, না পারছি বসে থাকতে। রাস্তার এক জায়গায় কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ পয়েন্ট। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে কিছুটা রক্ষা। কিন্তু ঘুমন্ত বুদ্ধ আর দেখা দিলেন না। মেঘের আড়ালে তিনি হয়তো মুচকি হাসছেন।

তিস্তা ড্যামের ওপর লেখক
তিস্তা ড্যামের ওপর লেখক
ছবি: লেখক

কিছুদূর যেতেই দানবাকৃতির নাগা ওয়াটার ফলস। নামের মতো বুনো এ ঝরনা। এত বিশাল যে তার ওপরের অংশ ক্যামেরার লেন্সে জুম করে দেখতে হয়। হাজারো মানুষের মেলা বসেছে। এমন পরিবেশে মানুষের উপস্থিতি আমাকে স্বস্তি দেয় না। কিন্তু নাগা ওয়াটার ফলস আপনাকে বিস্ময়ে অভিভূত করবে, ভয়জাগানিয়া মুগ্ধতা ছড়াবে। এ জন্যই বোধ হয় সিকিম অনন্য। পথের পাশেই এমন সব সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে, অন্যখানে হলে একটি জায়গা দেখতেই পাড়ি দিতে হতো সুদূর দুর্গমে। শেষ বিকেলে আমরা এসে পৌঁছালাম তিস্তা ড্যাম। ড্যামের একদিকে নীল পানির সমুদ্দুর, অন্যদিকে খটখটে নদীখাত। এখান থেকে তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণে জলবিদ্যুৎ। কিন্তু পরিবেশ-প্রতিবেশে কতটুকু অভিঘাত তৈরি করছে এমন বিধ্বংসী আয়োজন, তা নতুন করে সমীক্ষার দাবি রাখে।

বিজ্ঞাপন

চেকপোস্টে কাগজপত্র পরীক্ষার কারণে কিছুটা দেরি হলো। তারপর সন্ধ্যার মুখে পথের পাশে ধাবায় গরম-গরম মোমো আর চায়ে শরীর গরম করে নিলাম। যদিও ঠান্ডার দেশ, কিন্তু এখনো ঠান্ডার দেখা নেই। রাত প্রায় আটটার দিকে আমরা এসে পৌঁছালাম লাচুং। ৯ হাজার ৬০০ ফুট উচ্চতায় বেশ খানিকটা ঠান্ডা আছে। আমরা রাতের লাচুং দেখতে বের হলাম। যদিও সঙ্গী কয়েকজনের ভূতের ভয় আছে। তাদের আপত্তিতে সেই অভিযান বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। পাহাড়ি জনপদ ঘুমিয়ে পড়ে অনেক তাড়াতাড়ি। আমরা দেরি করায় লজের লোকজনের বকুনি খেতে হলো। পরদিন ইয়ুমথাং ভ্যালি। দেখা যাক কপালে কী লেখা আছে।  

ইয়ামথাং উপত্যকার পথে
ইয়ামথাং উপত্যকার পথে
ছবি: লেখক

খুব ভোরে হইচইয়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আলো কিছুক্ষণ আগে ফুটেছে। তীব্র ঠান্ডা উপেক্ষা করে সবাই জানালার ধারে। প্রথম সাদা পাহাড় দেখার উত্তেজনায় রীতিমতো চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। প্রথম সূর্যের ছটা এসে লাগল বরফচূড়ায়। এ দৃশ্য সেই আদি থেকেই পরমানন্দের। লাচুং গ্রামটি চারপাশের পাহাড়ঘেরা এক উপত্যকায় ছড়ানো-ছিটানো। এর চতুর্দিকেই বরফে ঢাকা সব পাহাড়। নদীর সঙ্গে  মিল রেখে এই জনপদেরও নাম হয়েছে লাচুং। আমরা লজের ছাদে উঠে গেলাম। এখান থেকে পুরো উপত্যকা চোখে পড়ে। পটে আঁকা ছবির মতোই চারপাশের দৃশ্যপট। হিমালয়ের হৃৎস্পন্দন টের পাওয়া যায় কান পাতলে। আস্তে আস্তে সূর্যের আবির পর্বতের বাধাকে অতিক্রম করে রাঙিয়ে দিল পুরো লাচুংয়ের আঙিনা।

আমাদের আজ ইয়ুমথাং ভ্যালি যাওয়ার কথা। ড্রাইভার দীনেশের দেখা নেই। ফোনের পর ফোন দেওয়ার পর তার অবশেষে দয়া হলো। জানাল, গাড়ির টায়ার নাকি পাংচার হয়েছিল। সে যে মিথ্যা বলছে, গতকাল থেকে তার আচরণে অনুমান করে নিতে কষ্ট হলো না। সিকিমে অনেক ড্রাইভারের মধ্যেই আচরণগত সমস্যা আছে। অভ্যাস আছে মিথ্যা বলা এবং লোক ঠকানোর, যা টের পাওয়া গেল কিছু সময় পরই। আমরা চললাম ইয়ুমথাং ভ্যালির উদ্দেশে। লাচুং থেকে ২৩ কিলোমিটার এর দূরত্ব। চীন সীমান্তের একেবারে ধার ঘেঁষে ১১ হাজার ফুট উচ্চতার ইয়ুমথাং ভ্যালিকে বলা হয়ে থাকে ফুলের স্বর্গরাজ্য।  তার চারপাশ ঘিরেই নাম না জানা সব বরফচূড়া। আমরা চারপাশের সেই মোহনীয় রূপে এমনই বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম, কখন কোলাহলে গাড়ি থেমে গেছে, টের পেতে খানিক দেরি হলো। দীনেশ জানাল, গাড়ি আর যাবে না। বরফের কারণে রাস্তা নাকি বন্ধ। অথচ সামনে যত দূর চোখ যায় রাস্তায় কোনো বরফের অস্তিত্ব নেই। কিছুক্ষণ আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট থেকেও বলা হয়েছে কোনো বরফ নেই।

এ পথ গেছে জিরো পয়েন্টের দিকে
এ পথ গেছে জিরো পয়েন্টের দিকে
ছবি: লেখক

অথচ সব ড্রাইভার একযোগে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। রাস্তা থেকে কিছুটা ওপরে পাহাড়ের ঢালে বরফের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। অগত্যা ইয়ুমথাং ভ্যালি থেকে ১৭ কিলো দূরে থাকতেই এই বিরান ভূমে পাহাড়ের ঢালে বরফে হুটোপুটি শুরু করলেন আবালবৃদ্ধবনিতা।  আমি আর কী করি। শুকনো মুখে তাঁদের বরফ দেখার আনন্দ উপভোগ আর ছবি তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হলো। প্রকৃতির এই নন্দনকানন ততক্ষণে শত শত মানুষের কোলাহলে জেরবার। যেখানেই চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। এর মধ্যে অবশ্য কিছুটা অ্যাডভেঞ্চার করে ফেললাম। কয়েক শ ফুট ওপরে প্রেয়ার ফ্ল্যাগ পর্যন্ত একটু বরফের মধ্যে হাইকিং করা হলো। সঙ্গে যোগ দিল আসিফ ভাইসহ কয়েকজন। তারপর ফিরে আসা।

গাড়িতে উঠতেই দীনেশ একটা প্রস্তাব দিল। সে আমাদের কাটাও নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাকে দিতে হবে অতিরিক্ত আড়াই হাজার রুপি। ইয়ুমথাং ভ্যালি যেতে না পেরে আশাহত সবাই সেই প্রস্তাবেই সায় দিল। লাচুং থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দেড়েকের পথ কাটাও। প্রায় ১৩ হাজার ফুট ওপরে চায়নিজ বর্ডারের একেবারে কাছাকাছি এ এলাকায় সাধারণত ট্যুরিস্টদের অনুমতি দেওয়া হয় না। কিন্তু সেদিন আমরা কোনো বাধার মুখে পড়িনি। প্রায় সবার সত্যিকারের বরফ দেখার অভিজ্ঞতা হলো কাটাওতে এসেই। আলপাইন অরণ্যের ভেতর দিয়ে গেছে পিচঢালা পথ। তার দুই পাশেই টাটকা বরফের ছাপ। কাটাও টপের কিছুটা নিচে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল।

ওই দেখা যায় লাচুং
ওই দেখা যায় লাচুং
ছবি: লেখক

নিচের থেকে মেঘের দমক উঠে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ আঁধার ঘনিয়ে এল এই ভরদুপুরে।  এর মধ্যেই সবার উৎসাহ অন্য মাত্রা দিল। এখানে ভারি সুন্দর একটি ঝরনা আছে। বরফ গলে বিশাল জলধারা কাটাও আসাকে পূর্ণতা দেবে। ঘণ্টাখানিক থাকার পর রওনা দিতে হলো। আজই ফিরতে হবে গ্যাংটক। লাচুং এসে ভরপেট ভেজ লাঞ্চ সেরে আমরা ধরলাম ফিরতি পথে। পথে অমিতাভ বচ্চন ফলসে পাঁচ মিনিটের বিরতি। গ্যাংটক ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা।
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২২, ১৩: ১৮
বিজ্ঞাপন