শুরুতে প্ল্যান ছিল, একটু প্রচলিত গন্তব্যগুলো এড়িয়ে নিভৃতে ছুটি কাটিয়ে আসার। সেভাবেই ৯ দিনের ট্যুর সাজাই দুজনে মিলে। প্রথমে পূর্ব সিকিমের রংলি হয়ে দুই দিনের জন্য রোলেপ। আউটডোর ক্যাম্পেইনের জন্য অসাধারণ জায়গায়। রংপো খোলা নদীর পাশে দিন ও রাত মিলিয়ে দারুণ ক্যাম্পেইনের বুকিং কনফার্ম করলাম। সেভাবেই রওনাও হলাম।
৯ ফেব্রুয়ারি রাতে মিথিলা এক্সপ্রেসে রওনা দিয়ে পরদিন সকালে শিলিগুড়ি। সেখানে নেমেই ছুটলাম ফিরতি টিকিট কাটতে। বাংলাদেশে টিকিট কাটতে সময় লেগেছিল ১৫-২০ মিনিট। সেখানে প্রায় ২ ঘণ্টা লাগল। টিকিট নিয়ে ছুটলাম এসএনটি। শিলিগুড়ি থেকে বাসে করে রংপো; সেখান থেকে শেয়ার্ড জিপে রংলি; এরপর রিজার্ভ গাড়িতে রোলেপ।
এসএনটি পৌঁছাতে বেজে যায় বেলা দুইটা। এর মধ্যে সকালের নাশতাও করা হয়নি। রংপো যেতে সময় লাগবে ৪-৫ ঘণ্টা। শিলিগুড়ি এসএনটি থেকে সিকিমের পারমিশন নেওয়া যায়। সিদ্ধান্ত নিলাম এই পারমিশন রংপো থেকেই নেব আমরা। তাই দেরি না করে রানিং একটি বাসে উঠে যাই। পথে কন্ডাক্টরকে বলে এক প্লেট মোমো পার্সেল করে নিলাম। তখন প্রায় বিকেল ৪টা, সকাল ও বিকেলের খিদে তখন আর নেই। মেঘ ছড়িয়ে আছে পাহাড়ে পাহাড়ে, রাস্তার কাজ চলছে। সূর্যও যেন আমাদের মতো ক্লান্ত হয়ে পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বাজে, আমরা রংপোর চেকপোস্টে পারমিশন নিচ্ছি। আমি ছুটলাম ডাইরেক্ট রোলেপের গাড়ি খুঁজতে। এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে পেয়ে গেলাম ছোট্ট একটি গাড়ি। সাতটায় রওনা হলাম অজানা রোলেপের উদ্দেশে। সোয়া আটটার দিকে আমরা রংলি পৌঁছালাম। হাতের কাছের একটি নাশতার দোকানে ঢুকলাম। ক্লান্তি ও ক্ষুধা তখন চরম মাত্রায়। প্রায় ২৪ ঘণ্টা জার্নি করছি। এখন পর্যন্ত কোনো কিছু টাইমমতো হচ্ছে না। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় কাজ চলছে। কোনো রকম দুই-তিন ভাষা মিলিয়ে অর্ডার করতে গিয়ে জানতে পারলাম দোকানের মালিক বাংলাদেশি। আজ থেকে ২০ বছর আগে তাঁর বাবা এখানে এসে থেকে যান। এর মধ্যে একটি মজার ও কাকতালীয় বিষয় ঘটল। আমাদের রিজার্ভ গাড়ির ড্রাইভারের নাম, আমার নাম ও দোকানের মালিকের নাম এক।
রংপো থেকে রওনা হওয়ার সময় হোমস্টে মালিকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। রংলিতে এসে কথা হয়, রাত হয়ে যাওয়ায় তিনি চিন্তা করছেন। রংলি থেকে দুটি রাস্তায় রোলেপ যাওয়া যায়। হোমস্টের মালিক আমাদের শর্টকাটে আসতে বললেন। আমরা সেভাবেই রওনা হলাম হালকা নাশতা সেরে। তিনি এটিও জানিয়ে দেন যে রাতের ডিনার তৈরি হচ্ছে।
শর্টকাট রাস্তা ধরে যাচ্ছি। সাধারণত সিকিমের দোকানপাট রাত আটটায় বন্ধ হয়ে যায়। আর এদিকে কিছুদূর পর পর ছোট্ট গ্রামের মতো কিছু এলাকা, সেগুলো এখন পুরোপুরি বন্ধ। রাস্তায় শুধু আমাদের গাড়ির হেডলাইটের আলো। এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। আমার পাশেই ক্লান্ত হয়ে একরকম শুয়ে আছে আমার স্ত্রী। আর এই অন্ধকার পাহাড়ে হেডলাইটের আলোর সঙ্গে আমার চোখ একবার ডানে আরেকবার বাঁয়ে ঘুরছে।
রাত তখন সোয়া নয়টা, আমরা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যে ড্রাইভার পর্যন্ত এই রাস্তায় এগোনোর সাহস পাচ্ছে না। এদিকটায় রাস্তার অবস্থা খুব বেশি খারাপ। পাহাড় কেটে পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে। হালকা বৃষ্টিভেজা কোপানো মাটির রাস্তা। এই ছোট্ট গাড়িটি যদি এটুকু জায়গা পার হতে না পারে। কাল সকালের আগে কেউ জানবে না আমরা কোথায় আছি। ফোনে নেটওয়ার্কও নেই। দুই মিনিটে সিদ্ধান্ত নিলাম রংলি ব্যাক করব। ফিরতি পথে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি জানালেন আর মাত্র ৮ কিলোমিটার গেলেই রোলেপ পৌঁছে যেতাম আমরা। সেদিন রাত ১০টায় আমরা রংলিতে পৌঁছে হোটেলে উঠলাম।
পরদিন গেলাম গ্যাংটকে। আমাদের দ্বিতীয় টার্গেট ছিল দুই দিন লাচেন থাকা। কিন্তু সেটাও হলো না। বিদেশিদের অনুমতি নেই আপাতত। তাই গন্তব্য বদলে লাচুংয়ের বুকিং দিলাম। পরদিন বেলা ১১টায় আমরা লাচুংয়ের উদ্দেশে রওনা হলাম। পথে পথে গাড়ি থামিয়ে আমরা বিভিন্ন ঝরনা, পার্ক, ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি।
এঁকেবেঁকে, এই পাহাড় থেকে ওই পাহাড়—গাড়ি ছুটছে আর সঙ্গে ছুটছে পাহাড়ের নীরব গল্প। খরস্রোতা তিস্তা কখনো সবুজ আবার কখনো নীল রং ছড়িয়ে রেখেছে তার পানিতে। লাচুং যাওয়ার পথে ছোট্ট একটা শহরে নেমে লাঞ্চ সেরে নিলাম। প্রতিটি বাড়ির সামনে, রেলিংয়ে, কার্নিশে বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড ও নানান রঙের ফুলগাছ। পথে চলতে চলতে সেই রং এঁকে যায় অদ্ভুত সব আলপনা।
সন্ধ্যায় লাচুং পৌঁছালাম। হাড়কাঁপানো বাতাসে তীব্র ঠান্ডা, ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় রওনা হই ইয়াম্থাম ভ্যালি ও জিরো পয়েন্টের উদ্দেশে। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে পেছনে ফেলি আসি লাচুংকে। একসময় পাহাড়ের ভেতর বনের দেখা পাই। সেখানে জমে আছে গত দিনের তুষার। ইয়াম্থাম ভ্যালি ও জিরো পয়েন্ট জায়গা দুটি রাজদরবারের মতো। পথের দুই পাশেই সুউচ্চ পাহাড়ের গার্ড অব অনার। সৌন্দর্যের কারণে সেই বরফ ও পাথরের রাজ্যে মাথা নুয়ে আসে। অজানা এক ভালো লাগায় প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়।
লাচুং থেকে ফিরে সেদিন থেকে যাই গ্যাংটকে। পরদিন সকালেই রওনা হই তুমলিংয়ের উদ্দেশে। প্রথমে দার্জিলিং, সেখান থেকে শেয়ার্ড জিপে সুখিয়া পোখরি ও শেষ মানেভঞ্জন। ঠিক তিনটা বাজে, এর মধ্যে শুধু সকালের নাশতা হয়েছে। মানেভঞ্জন নেমে জানতে পারি মেঘমা চেকপোস্টে চারটার মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে আজ আর ওপরে উঠতে দেবে না। সিঙ্গালিলা ল্যান্ড রোভার অ্যাসোসিয়েশন থেকে গাড়ি ও গাইড ভাড়া করি। পুলিশ চেকপোস্টে এন্ট্রি করে ছুটে যাই সেনাদের খাতায় এন্ট্রি করাতে, সেখানে কাজ শেষ করে যাই সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কে এন্ট্রি করাতে। দুই বছরে আগেও একজন এক টিকিটে যত খুশি তত দিন থাকতে পারত। এখন প্রতিদিনের জন্য চার গুণ খরচে টিকিট কাটতে হয়।
চারটার একটু বেশি বাজে, আমরা তখন মেঘমার চেকপোস্টে। তেমন কিছুই বলেনি, কিন্তু তুমলিংয়ে থাকার পারমিশন দিল না। তিন কিলোমিটার আগে টংলুতে থাকতে হবে। টংলুতে পৌঁছাই পাঁচটায়; নেমেই নুডলস দিয়ে লাঞ্চ সেরে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ি। ঘণ্টাখানেক হেঁটে এসে হাটের ডাইনিংয়ে আশ্রয় নিই। ১০ হাজার ফিট উচ্চতায় সারা দিন যতটুকু ঠান্ডা থাকে সন্ধ্যার পর তা বাড়তে থাকে। হাটের মালিক আমাদের আগুন পোহানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। আজ অতিথি শুধু আমরা দুজন। ডিনারে চমৎকার নেপালি থালি পরিবেশন করলেন। ডিনারের পর সারা দিনের ধকল জানান দিল কতটা ক্লান্ত আমরা।
তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কারণে ভোরেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ কানে এল কেউ গুনগুন করে গাইছে আর পুরো হাট ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে তখন আলো ফুটছে। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলাম না। কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে নিচে নামতেই সেই ঠান্ডা আবার জেঁকে বসল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলাম। তখনো সেই গুনগুন সুর আমার চারদিকে ঘুরছে। তবে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে সেটা আরও পরিষ্কার হলো। উঠানে এসে হুট করে সব ভুলে গেলাম। টংলু থেকে সবচেয়ে ভালো কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। ঠিক আমার সামনে স্লিপিং বুদ্ধ এখন শুয়ে আছে। একদম স্পষ্ট ও বরফমোড়ানো। সূর্যের আলো এমনভাবে পড়েছে মনে হচ্ছে এখনই ঘুম থেকে জেগে উঠবে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
ঠিক তখনই পাশ দিয়ে হাটের মালিক গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে গাছে পানি দেওয়ার পাত্র নিয়ে বাগানের দিকে গেলেন। আমাকে দেখে হেসে নেপালি ভাষায় বললেন, সুপ্রভাত!
ছবি: লেখক