মাদার তেরেসার স্মৃতিময় বাড়িতে
শেয়ার করুন
ফলো করুন
বিজ্ঞাপন

পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো আয়তনে অন্য অঞ্চলগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট। এটা পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াতের জন্য বাসের ওপরই ভরসা করে সবাই। আমি মন্টেনিগ্রো থেকে কসোভোর পথে মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপিয়ের ওপর দিয়েই যাচ্ছিলাম। জানা ছিল, মেসিডোনিয়ায় ‘মেরি তেরেসা’ তথা পরবর্তী সময়ে ‘মাদার তেরেসা’র শৈশব আর কৈশোর কেটেছে।

মেসিডোনিয়া স্কোয়ারে ফিলিপের ভাষ্কর্য
মেসিডোনিয়া স্কোয়ারে ফিলিপের ভাষ্কর্য

ফলে আমি বাস থেকে নেমে যাই। আর সেই সাতসকালে শহরের কেন্দ্রস্থলে বাস থেকে দুই কিলোমিটারের হাঁটাপথে যাই মেসিডোনিয়ার জাতীয় জাদুঘরে। ভাবছিলাম মাদার তেরেসার বাড়ি সম্পর্কে কিছু ধারণা নেওয়া যাবে। সকাল ১০টা বাজতেই জাদুঘরের আশপাশের স্যুভেনিরের দোকানগুলো মাত্র খুলছে, একটি দোকানে মাদার তেরেসার স্মরণিকায় চোখ পড়তেই এলজা নামের একটি মেয়ের কাছে মাদারের বাড়ি সম্পর্কে জানতে চাই।

বিজ্ঞাপন

পাশ্চাত্যের ঐতিহ্যবাহী বড় বড় স্থাপনা, কয়েকটি ভাস্কর্যের অপরূপ সৌন্দর্যের মেসিডোনিয়া স্কয়ার দেখিয়ে দিয়ে মেয়েটি আমাকে বলে, সেখান থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরত্বে মাদার তেরেসা মেমোরিয়াল হাউস। একটু শিউরে উঠি।

নবম শতকের বুলগেরিয়ান সম্রাট স্যামুয়েলের মূর্তি (বাঁয়ে) ও ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সোচ্চার আনদোনভের মূর্তি
নবম শতকের বুলগেরিয়ান সম্রাট স্যামুয়েলের মূর্তি (বাঁয়ে) ও ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সোচ্চার আনদোনভের মূর্তি

দারুণ হবে, আমি প্রথমেই মাদার হাউসে যাব। ওখান থেকে কিছু স্মারক সংগ্রহ করব। এলজাকে বললাম, ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মাদারের দেহাবসানের দিনে আমি কলকাতাতে ছিলাম। মিশনারিজ অব চ্যারিটির পাশ দিয়ে সকালে ট্রামে যাওয়ার সময় যাত্রীদের কানাঘুষায় শুনছিলাম গত রাতে মাদার বিদায় নিয়েছেন। অত ভোরে নিরাপত্তাবলয় না থাকায় আমি হাউসের ভেতরে ঢুকে মাদারের কফিন ছুঁতে পেরেছিলাম। মেয়েটিকে করজোড়ে সম্ভাষণ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

হ্যাঁ, মাদার তেরেসার মানবতার জয়গান অন্য সবার মতো আমিও শুনতাম, মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে তাঁকে দেখা এবং সপ্তাহ বাদে সেদিন ছিল শনিবার, নেতাজি সুভাষচন্দ্র স্টেডিয়ামে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান টেলিভিশনে দেখে আমি হতবাক। ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেদিন উপস্থিত ছিলেন সেই শোকানুষ্ঠানে। সেই থেকেই মাদার তেরেসার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে যায়।

মা অলিম্পিয়াসের সঙ্গে শিশু আলেকজান্ডার
মা অলিম্পিয়াসের সঙ্গে শিশু আলেকজান্ডার

মেসিডোনিয়া স্কয়ারের চোখধাঁধানো ভাস্কর্যগুলোও আমাকে অতটা টানছিল না, বিশালাকৃতির মূর্তিতে ফিলিপ অব মেসিডোনিয়া বা তাঁর বাবা আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের থেকেও আমি মাদার হাউসকে বেশি গুরুত্ব দিই।

স্কয়ার পার হয়ে দুই শ মিটার দূরত্বে এই মাদার হাউসের অবস্থান। বাউন্ডারি দেয়াল নেই। প্রবেশে কোনো খরচ নেই। একটি ট্যুরিস্ট গ্রুপ ও গাইড আমার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বোঝালেন। দেখলাম অসংখ্য বিশ্বনেতার মন্তব্য আছে ওই পরিদর্শন বইতে।

মিউজিয়ামে মন্তব্য বই
মিউজিয়ামে মন্তব্য বই

এটা একটা দোতলা বাড়ি। কোন সীমানাপ্রাচীর নেই। তবে এই বাড়ির কাছেই অন্য একটি বাড়িতে তার জন্ম। আর এই বাড়ির ওপরের তলায় রয়েছে মাদার তেরেসার ব্যবহৃত জিনিসপত্র। আর রয়েছে তাঁর নানা স্মৃতি। নিচের তলায় স্যুভেনির শপ। আর রয়েছে একটা বৃত্তাকার খোলা জায়গা। দেখে মনে হয় এটা প্রার্থনার জন্য।

এই শহরে তাঁর কোনো আত্মীয়–পরিজন থাকে না। কারণ, তাঁর পূর্বপুরুষ আলবেনিয়ান। সেখান থেকেই তাঁর পরিবার এখানে এসেছিল। তবে এই শহরে মাদার ছিলেন ১৯১০ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত। বিখ্যাত মেসিডোনিয়া স্ট্রিটেই এই মেমোরিয়াল হাউসটি অবস্থিত। এর পাশেই রয়েছে স্যাকরেড হার্ট অব জেসাস রোমান ক্যাথলিক চার্চ। এখানেই দীক্ষিত হন মাদার। ২০০৮ সালে কাজ শুরু এই মেমোরিয়াল হাউসের। আর ২০০৯ সালের ৩০ জানুয়ারি এর দ্বারোদ্‌ঘাটন হয়।

মিউজিয়ামে মাদারের মূর্তির পাশে লেখক
মিউজিয়ামে মাদারের মূর্তির পাশে লেখক

এই বাড়িটির পাশেই রয়েছে মাদারের একটি ভাস্কর্য। উদ্বোধনের পর প্রথম তিন দিনেই এই মেমোরিয়াল হাউসের দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের ওপরে। তখন টিকিট কেটেই ঢুকতে হতো। তবে এখন আর সেটা হয় না। তবে এখন ছুটির দিনগুলো বন্ধ এবং বাকি দিনগুলোতে সবার জন্য উন্মুক্ত। বাড়ির আশপাশ ঘুরে, নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝি, এই মেমোরিয়াল হাউসকে ঘিরে ট্যুরিজম ব্যবসাটাও বেশ জমজমাট।

মানবসেবায় যে উদাহরণ মাদার তেরেসা আমাদের মাঝে রেখে গেছেন, তার চর্চা এবং তাঁকে অনুসন্ধান করতে একবার ঘুরে আসা যেতে পারে মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কেপিয়ায়, মাদার হাউসে।

লেখক: ইতালিপ্রবাসী বাংলাদেশী পর্যটক।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১৬: ০০
বিজ্ঞাপন