মিনিট পনেরোর মাথায় হোটেলটা সামনে ভেসে উঠল। হুসহাস গাড়ি হাঁকানো ব্যস্ত চৌমাথায় নিরীহ চেহারার সাধারণ বাজেটের হোটেল। মুন্সটার শহরে এসেছি এক দিনের অতিথি হয়ে। কোনোমতে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই হলো। তা ছাড়া হোটেল নামের চারকোনা বাক্সে থেকে সময় নষ্ট করার ইচ্ছা নেই। ঝটপট চেক ইন পর্ব সেরে যাত্রাপথের ধুলাবালু হটিয়ে আবার তরতাজা হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
লিউয়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে। লিউ পুরোনো কলিগ। মিউনিখ টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্টিস্ট হিসেবে ছিল একই ল্যাবে। এখন সে মুন্সটারে এসেছে নতুন চাকরি নিয়ে। লিউ ঠিক সাড়ে পাঁচটায় এক রেস্তোরাঁয় অপেক্ষায় থাকবে। রেস্তোরাঁর নাম 'ক্লাইনার কিপেনকের্ল'। নাম পড়তে গিয়ে দাঁত নড়ে গেল। এখন এই ঠিকানা খুঁজে পেলে হয়। এটা নাকি তিন শ বছরের পুরোনো রেস্তোরাঁ। মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একেবারে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। পরে ১৯৫৫ সালে আবার তার দরজা খুলেছে অতিথি আপ্যায়নে। লিউ খুব আগ্রহ নিয়ে এই রেস্তোরাঁয় টেবিল বায়না দিয়ে রেখেছে। কিন্তু চিন্তা অন্যখানে। এই খানদানি রেস্তোরাঁর খানাপিনায় আজকে কত টাকা বেরিয়ে যাবে, সেটা ভেবে চোখ সরু হয়ে আসছে।
বার দুই বাস বদলে নেমে পড়লাম। এলোমেলো এদিক-ওদিক খুঁজতেই পাওয়া গেল ক্লাইনার কিপেনকের্ল। লাল ইটের বনেদি বনিয়াদ। তার সামনেই ধাতব ভাস্কর্য। মূর্তির পরনে সেকেলে ঢিলেঢালা পোশাক, গলায় স্কার্ফ, মাথায় টুপি আর মুখে একটা অদ্ভুতদর্শন পাইপ ঝুলছে। সেটা দিয়ে বিড়ি টানা হয় নাকি হুইসেল বাজাতে কাজে লাগে, ঠিক বোঝা গেল না। আর কাঁধে ব্যাকপ্যাকের কায়দায় ঝোলানো দশাসই এক ঝুড়ি। ভেতরে ধাতব আলুটা-মুলোটা দেখা যাচ্ছে।
এ লোক তাহলে বোধ হয় তরিতরকারি ফেরি করে বেড়ায়। হঠাৎ মনে পড়ল এ রকম ঝুড়ির জার্মান নাম 'Kiepe' বা 'কিপে'। হোটেলের 'কিপেনকের্ল' নামটা কি এই ভাস্কর্যের সঙ্গে মিল রেখে রাখা হয়েছে? রেলস্টেশনের স্যুভেনির শপে এ লোকের মিনিয়েচার পুতুল চাবির রিংয়ে ঝুলতে দেখেছি। ইনি তো দেখছি এ শহরের ট্যুরিস্ট আকর্ষণ গোছের কিছু হবেন।
জার্মান পাংচুয়ালিটি মেনে ঘড়ি ধরে ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় কিপেনকের্ল রেস্তোরাঁয় উদয় হলাম। লিউ চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে উঠে এল এদিকে। প্রবল বেগে জাপটে ধরে উচ্ছল হাসিতে বলে উঠল, 'উফফ্, কত দিন পর!'।
লিউয়ের বয়স চল্লিশের ওদিকেই হবে। অথচ মসৃণ ত্বক আর সিল্কি কালো চুলে তাকে ত্রিশের বেশি ভাবাই যায় না। লিউ তাইয়ানের মেয়ে। তবে জার্মানিতে আছে প্রায় বছর বিশেক। তাই জার্মানটা বলে চোস্ত। মিউনিখে থাকতে কলিগের বাইরে তার বন্ধুবান্ধব তেমন ছিল বলে জানা নেই। মুন্সটারে এসে তার একা দশা কেটে গিয়ে দোকা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না ইত্যাদি ব্যক্তিগত প্রশ্নে আর যাই না। বরং ব্যক্তি লিউয়ের খোঁজ নিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
লিউ জার্মানে কথা চালাতেই স্বচ্ছন্দ। আমিও আমার ভাঙাচোরা জার্মানের সঙ্গে কটা ইংরেজি শব্দ জুড়ে জোড়াতালি দিয়ে আলাপ সারছি। জার্মান আর ইংরেজির এই কিম্ভূত হাইব্রিডের নাম 'জাংরেজি'। নিজস্ব আবিষ্কার। চিরকাল বাংলা-ইংরেজির মিলিয়ে বাংরেজি দিয়ে উতরে যাওয়া লোক যে জার্মানমুলুকে এসে অনায়াসে জাংরেজি আবিষ্কার করে ফেলবে, এ তো জানা কথা। সমস্যা একটাই, জাংরেজির সঙ্গে এক বিশেষ বস্ত্রের দেশীয় নামের মিল আছে।
যাহোক, কোনার টেবিল থেকে বছর ষাটেকের রাগী চেহারার এক ভদ্রমহিলা চোখ রাঙানি দিল যেন বার কয়েক। ভুল ব্যাকরণ আর বিদঘুটে উচ্চারণে যেভাবে তার মাতৃভাষার জাত মারছি, তাতে রাগ লাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু 'অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী' এই বাঙালই বা কী করবে। ভদ্রমহিলার অগ্নিচক্ষু উপেক্ষা করে হটরবটর জাংরেজি চালাতে লাগলাম থোড়াই কেয়ার করে। উপরন্তু, হটরবটরের সঙ্গে বোনাস হিসেবে জুসের গ্লাসে বিচ্ছিরি সুড়ুৎ টান।
মেনু ধরে কয়েক রকমের মাছের গ্রিল আর কয় প্লেট পাস্তা উড়িয়ে গল্পে-আড্ডায় সময় কাটিয়ে কিপেনকের্ল রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এলাম ভরপেটে হাত বোলাতে বোলাতে। যে রকম একটা চক্ষু-চড়কগাছ বিল গছিয়ে দিয়েছিল ওয়েটার, তাতে মাথাটা বোঁ বোঁ করছে। বোঁ কাটানোর জন্য মুন্সটারের পথে পথে কয়েকটা ভোঁ-চক্কর মারতে হবে। যদি বিষে বিষ ক্ষয় হয় আরকি! লিউ পাশ থেকে চিঁ চিঁ করছে তাকে বিলে ভাগ বসাতে দেইনি বলে। কথা ঘোরানোর জন্য তাকে শুধালাম, 'এই, তোমার গাইডগিরি শুরু করো তো। শহরটা ঘুরিয়ে দেখাও চটপট।'
সরু গলি ফেলে বড় রাস্তায় পা ফেলতেই মুন্সটার শহর স্বরূপে দেখা দিল যেন। চওড়া রাজপথের সবটা জুড়ে সাইকেলের রাজত্ব। গাড়িঘোড়ার প্রতাপ বড্ড কম। নর্থ-রাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের এই শহরকে বলা হয় জার্মানির বাইসাইকেলের রাজধানী। ওদিকে বায়ার্ন রাজ্যের রাজধানী মিউনিখ থেকে আসা লোক আমি গাড়ির ধুলা-ধোঁয়া আর ট্রাফিক জ্যামেই বেশি অভ্যস্ত। একধরনের মুগ্ধতা নিয়ে ধোঁয়াবিহীন শুদ্ধ বাতাস টেনে নিতে নিতে ডাউন টাউনের দিকে এগোলাম আমরা।
একটু পরপরই গির্জার ঘণ্টা কানে এল। জিজ্ঞাসু চোখে লিউকে শুধাতেই সে খুব উৎসাহে জবাব দিল, 'জানো, মুন্সটার নিয়ে একটা কথা চালু আছে। “হয় এ শহরে বৃষ্টি হচ্ছে, নয় তো চার্চে ঘণ্টা পড়ছে, আর যদি দুইটায় চলে, তাহলে ধরে নিতে হবে দিনটা রোববার।” বুঝলে ব্যাপারটা, হা হা...।' উচ্চমার্গীয় জার্মান রসিকতার মাথামুণ্ডু না বুঝেই বোকাটে হাসলাম, 'হে হে, তাই নাকি?' তবে এটুকু বোঝা গেল, এ শহরে বৃষ্টির আনাগোনা বড্ড বেশি।
পায়ে পায়ে ঘণ্টার উৎসে পৌঁছে গেলাম। অতিকায় সাধু পলের গির্জা দাঁড়িয়ে আছে। সেই তেরো শতকে গড়া। রোমান আর গথিক নকশার মিশেলে একাকার। সিমেট্রিক আদলে গড়া গম্বুজে সরল সোজা গড়নে রোমানেস্ক ছাপ স্পষ্ট। আবার কোনো দেয়ালের মাথায় চোখা গথিক আর্ক যেন মুকুট হয়ে চেপে বসেছে। এই গির্জার ঘড়ির ঘণ্টাই এলাকা সরগরম রাখে। এই ঘড়ির বয়স প্রায় পাঁচ শ বছর। ১৫৪০ সালের দিকে প্রকাণ্ড এই ঘড়ি আস্তানা গেড়েছে চার্চের ঠিকানায়। সময়ের কাঁটা ঘুরে মাঝে বয়ে গেছে অযুত লক্ষ দিন। না জানি কত কালের সাক্ষী হয়ে আজতক বেজে চলছে বিরতিহীন।
ফুটপাতে অলস পা ফেলে আরেক প্রকাণ্ড চার্চের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সাধু ল্যামবার্টের গির্জা। আরেক দুর্দান্ত মধ্যযুগীয় সিগনেচার। কোমল আদলের গম্বুজটম্বুজ নেই এখানে। ইট-সুড়কির পরতে পরতে গথিক ছাপ প্রকট। তীক্ষ্ণ মিনার উঠে গেছে আকাশ ফুঁড়ে। কিন্তু খাঁচার মতো ওগুলো কি ঝুলছে খুব উঁচু থেকে? নিশ্চয়ই কোনো অঘটন জড়িয়ে আছে খাঁচার শিকলে। মধ্যযুগ বলে কথা। লিউকে খোঁচা দিতেই কাজ হলো। সে ভারিক্কি সুরে ইতিহাস বলা শুরু করল।
সাল ১৫৩৪। ইয়ান ভ্যান লিডেন নামে জাতে ডাচ এক ভদ্রলোক নেদারল্যান্ডস থেকে উড়ে এসে মুন্সটার শহরে জুড়ে বসল। ইয়ান ছিল পেশায় রুটির কারিগর। বেকারি চালাত। আরেকটা গুণ ছিল তার। কথাবার্তায় ভীষণ চৌকস। লোকে মুগ্ধ হয়ে শুনত তার কথা। ইয়ান একদিন ভাবলো, 'ধুর্, এত রুটি বেলে কি হবে। লাইন বদলে এবার একটু ধর্ম-কর্ম করে দেখি। বাইবেল তো পড়াই আছে দুই পাতা। ওতেই চলবে।' দুই পাতা বাইবেলজ্ঞান নিয়ে ইয়ান রীতিমতো হুলুস্থুল লাগিয়ে দিল। নিজেকে প্রফেট দাবি করে প্রচার করতে লাগল কেয়ামত নাকি ঘনিয়ে আসছে। যিশুখ্রিষ্টের দুনিয়ায় ফিরে আসার সময় হয়েছে। মুন্সটারকে ঘোষণা করল নতুন জেরুজালেম হিসেবে। এখান থেকে নাকি বাকি পৃথিবী জয়ের যাত্রা শুরু হবে। গরু-বাছুর চরানো সরল-সহজ মুন্সটারবাসী চতুর ইয়ানের এসব ভুং চুং-জাতীয় কথাবার্তা মচমচে রুটির মতোই গোগ্রাসে গিলল।
আর এই সুযোগে ইয়ান ঢালাওভাবে অ্যানাব্যাপটাজমের প্রচার চালাতে লাগল। অ্যানাব্যাপটাজম খ্রিষ্টধর্মের একটা কড়া ধাঁচের ধারা। যে ধারা ছিল ক্যাথলিক মতের ঘোরবিরোধী। জনমতের জোরে সে সময়ের ক্যাথলিক বিশপ, ফ্রাঞ্জ ফন ওয়ালডেককে টশকে দিয়ে মুন্সটারের রাজা বনে বসল ইয়ান। তলেতলে চলতে থাকল লোকের টাকা আর সম্পত্তি ক্রোক করে নেওয়া। বাইবেল বাদে সব বই পুড়িয়ে দেওয়া, ক্যাথলিকদের জোর করে ব্যাপটাইজ করা নয়তো গর্দান নেওয়া—এ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। ওদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকল পাল্লা দিয়ে। মোটকথা, চারদিকে তখন ত্রাসের রাজত্ব।
পরিস্থিতি যখন তুঙ্গে, তখন সেই নির্বাসিত বিশপ ফ্রাঞ্জ দলবল নিয়ে আচমকাই মুন্সটার আক্রমণ করে বসল। ইয়ান তার শিষ্য-শাগরেদসমেত ধরা পড়ল হাতেনাতে। টেনেহিঁচড়ে তাদের আনা হলো শহরের সদর বাজারের মাঝখানটায়। সবার সামনে লোহার শিক আগুন গরম করে তাই দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হলো ভয়ংকরভাবে। এখানেই শেষ নয়। জিব কেটে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো গায়ে। ইয়ান আর তার দুই সঙ্গী ভূত হয়ে গেলে খাঁচায় পুরে ঝুলিয়ে রাখা হলো সেন্ট ল্যামবার্ট গির্জার গায়ে। সেখানেই তারা ঝুলে থাকল ৫০ বছর। যেন লোকে চাইলেও এই ঘটনা ভুলতে না পারে। পরে একসময়ে অবশ্য হাড়গোড় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে সযত্নে। শুধু শূন্য খাঁচা তিনটা রয়ে গেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। শহরে নতুন আগুন্তকের চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে।
গায়ে কাঁটা দেওয়া গল্প শুনে মনে হলো, বাতাসে যেন এখনো পোড়া মাংসের কটু গন্ধ ভাসছে। লিউকে তাড়া দিলাম, 'এখান থেকে গেলে হয় না?' লিউ হাসতে হাসতে মাথা নাড়ল, 'তোমাকে এত ডিটেইলস বলা ঠিক হয়নি। আর ঘ্রাণ তো আসছে ওই বড় রেস্তোরাঁ থেকে। ভুরভুরে ভাজা মাংসের ঘ্রাণ।' ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক দল ট্যুরিস্ট স্টেক আর রেড ওয়াইন নিয়ে বসেছে রেস্তোরাঁর শামিয়ানার নিচে। পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, গাইড ছোকরা গলা খাঁকরি দিয়ে বলছে, 'এখন শোনাবো আমাদের মাথার ওপর ঝুলে থাকা খাঁচাগুলোর রহস্য। সালটা ১৫৩০...।' গল্প শুনে তাদের স্টেক খাবার ইচ্ছা মরে না গেলে হয়।
জুন মাসের দীর্ঘ সন্ধ্যা ফুরোয় না সহজে। পড়ন্ত রোদের ঘোর লাগা আলোয় উঁচু গথিক দালানের সারিকে অদ্ভুত দেখাতে থাকে। কোথাও বেমানান স্কাইস্ক্র্যাপার আকাশ ফুঁড়ে বেখাপ্পা গজিয়ে নেই। তাই বোধ হয় এ শহরে অতীত আর ইতিহাস খুব আরামে জাঁকিয়ে বসতে পেরেছে বর্তমানের সমান্তরালে।
হঠাৎ লিউয়ের ইশারায় আঙুল বরাবর তাকালাম। দূরে ল্যাম্পপোস্টের থাম্বায় রাস্তার নেমপ্লেট ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। 'ওই যে ওদিকে', লিউ এবার হাত ধরে টেনে নিয়ে এল ল্যাম্পপোস্টের খুব কাছে। ইতিউতি চাইতেই খুব ছোট্ট একটা পুতুলের মতো দেখলাম যেন। নেমপ্লেটের ওপর খুব সাবধানে দাঁড়িয়ে। বোতলের ছিপি দিয়ে বানানো পলকা শরীর। লিকলিকে হাত-পা। চিত্তিরবিত্তির রঙে রাঙিয়ে তাকে বিচিত্র একটা চরিত্র দেওয়া হয়েছে।
লিউ পেশাদার গাইডের সুরে এক নিশ্বাসে বলে গেল, 'এই হলো স্ট্রিট ইয়োগি। কেউ বলে কর্ক-মেনশ্যেন (Korkmännchen)। শহরের আনাচকানাচে দেখা মেলে, যদি কেউ খুব করে খোঁজে।' খটমটে জার্মান কর্ক-মেনশ্যেনকে মোলায়েম বাংলায় 'ছিপি বাবা' বানিয়ে নিলাম মনে মনে। আজকে স্টেশনে বিয়ারের বোতল হাতে যেসব ছিপি বাবাকে ফুটপাতে গড়াতে দেখেছি, এই বাবা তাদের থেকে খানিকটা আলাদা। খুঁটিয়ে দেখতেই চোখে পড়ল বাবার এক হাতে ইউক্রেনের নীল-হলুদ পতাকা আর হাতে শান্তির প্রতীক জাতীয় সংকেত উঁচানো। এই ছিপি বাবার কাজ নাকি যোগাসনের নানান ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে নীরবে অহিংসা ঘোষণা করা।
ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে এক শিল্পীর হাত ধরে বেশ বছরখানেক আগে ছিপি বাবাদের যাত্রা শুরু। তাই দেখে 'জোসেফ ফুস' নামের এক যোগব্যায়ামের শিক্ষক বার্লিনে রাতের আঁধারে ল্যামপোস্ট বেয়ে বেয়ে উঠে ছিপি বাবা বসিয়ে রেখে আবার চুপিসারে সরে যেত। লন্ডনের ছিপি বাবারা এভাবেই আস্তে বার্লিন, তারপর বার্লিন ছেড়ে মুন্সটার, এভাবে গোটা জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আর গজিয়েছে অনেক অনেক জোসেফ ফুস।
ফুস ভাইয়ের মতো পাইপ বেয়ে উঠে একটা দেশি ছিপি বাবা দাঁড় করিয়ে রাখতে মন চাইছে খুব। বাবার পরনে থাকবে চেক লুঙ্গি, স্যান্ডো গেঞ্জি আর মাথায় লাল গামছা। তার ভেতর বাবার বদলে চাষি-মাঝি ভাব বেশি থাকবে। সবাইকে যে অহিংসা ছড়ানোর গুরুভার নিতে হবে, এমন তো কথা নেই। লিউকে পাগলামি আইডিয়াটা বলতেই সে লুফে নিয়ে হেসে ফেলল আর জানাল আর কোনো ফুটপাতে নাকি সে এক ছিপি বাবাকে স্কেটবোর্ডে চড়ে 'কুল-ব্রো' সেজে থাকতে দেখেছে। আবার আর কোথায় যেন আরেক বাবা ল্যাম্পপোস্টে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। ছিপি বাবারা এ শহরে নির্মল বিনোদনের খোরাক।
লিউ আর আমি গাড়িবিহীন চওড়া রাস্তা ধরে ইচ্ছেমতো ঘুরছি। ডাউন টাউনের এদিকটা ফ্যাশন স্ট্রিট। দুই পাশে নামীদামি দোকানের সারি। স্বচ্ছ কাচের ওপাশে বিচিত্র ছাঁটের পোশাকে ম্যানিকুইন দাঁড়িয়ে নিশ্চল। প্রাইস ট্যাগ দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। তার চেয়ে বিনা পয়সায় শহর ঘুরে দেখা ভালো। ম্যানিকুইনের ন্যাড়া মাথা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সন্ধ্যানামা ঘোলাটে দিগন্তে তাকালাম। দিগন্তের দেখা মিলল না। সুউচ্চ ধারাল গথিক দেয়াল দিগন্ত আগলে রয়েছে প্রহরীর মতো। লিউকে এই দালানের নাম জিজ্ঞাসা করতে সে সল্টেড ক্র্যাকার্স কামড় দিল যেন। অন্তত তেমনই শোনাল। এর নাম ক্রামারআমট্হাউস (Krameramtshaus)। আরেকবার বলতে গেলে জিবে কামড় খেয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড হবে।
এই রাজকীয় টাউন হলের একটা ইতিহাস আছে। এখানে ১৬৪৮ সালের দিকে একটা শান্তিচুক্তি হয়েছিল। চুক্তির মধ্য দিয়ে ৮০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের ইতি টানা হয়। তখন ডাচ মারছে স্প্যানিশদের তো ফ্রেঞ্চরা ধাওয়া করছে রোমান সাম্রাজ্য। ওদিকে যুদ্ধের জাঁতাকলে পড়ে তত দিনে মিলিয়ন মিলিয়ন লোকের জান খতম অলরেডি। শান্তিচুক্তি না হলে অশান্তির যুদ্ধটা চলতেই থাকত। মানবসভ্যতার ইতিহাস মানেই ঢাল-তলোয়ারের ঝনঝনানি আর ঘোড়ার পিঠ থেকে কাটা মুণ্ডু গড়িয়ে পড়া।
সূর্যটাও কাটা মুণ্ডুর মতোই ক্রামারআমট্হাউসের ওপাশে গড়িয়ে পড়েছে আলগোছে। দূর থেকে সেন্ট পল গির্জার প্রকাণ্ড ঘণ্টা আটবার বেজে জানিয়ে দিল সময়টা। আজকের বিনা পয়সার ট্যুর গাইড, লিউয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে হলো। সে খালি হাতে ছাড়ল না। এক বাক্স সুইস চকলেট গছিয়ে দিল। আর জড়িয়ে ধরে শক্ত করে চাপ।
চকলেটের বাক্স বগলে বাসস্টপ বরাবর পা চালালাম। কিন্তু চোখ থাকল ল্যাম্পপোস্টের ডগায়। মুন্সটার শহরের ছিপি বাবাদের কাউকে যদি আবার চোখে পড়ে। (সমাপ্ত)
লেখক: ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার, মিউনিখ, জার্মানি