স্টুটগার্ট মেইন রেলস্টেশনে প্যাঁচ লেগে গেছে। চারদিক কনস্ট্রাকশনের ইট-সুরকিতে সয়লাব। বিশাল মেরামতির যজ্ঞ চলছে। সেই কোপে পড়ে একটার পর একটা ট্রেনের শিডিউল ভন্ডুল হচ্ছে টপাটপ। লোকজন বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক ছুটছেন। দূরপাল্লার যাত্রীদের অবস্থা আপাতত কেরোসিন। আমার ট্রেনও যে আজকে ফেল মারবে, এ তো জানা কথা। কিন্তু আজ রাতের ভেতর মুন্সটার শহরে পৌঁছাতে না পারলে কাল কনফারেন্সটাই যে ভেস্তে যাবে।
যাচ্ছি জার্মান প্যাথলজি সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলনে। একেকবার একেক শহরে বসে এই আয়োজন। স্টুটগার্টে এসেছিলাম বন্ধুর বাড়িতে। তাই এখান থেকেই ব্যাকপ্যাক কাঁধে রওনা দেওয়া। মিউনিখের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক হিসেবে যোগ দেব। কনফারেন্স-টনফারেন্স ওসব অজুহাতমাত্র। যাচ্ছি তো আসলে নতুন এক শহর দেখব বলে। বিজ্ঞানী জীবনের এই এক মজা।
মুন্সটার নাকি ফরমালিনে চোবানো এক শহর। মানে, তেরো শ শতকের সাবেকি চেহারা নিয়ে এখনো অবিকল ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। কোনো অদলবদল নেই। মধ্যযুগের আদলে গড়া গথিক ইমারতগুলো নাকি পর্যটককে হ্যাঁচকা টানে টাইম ট্রাভেলে নিয়ে যায় কয়েক শ বছর পেছনে। কিন্তু আজকে এই বেরসিক শিডিউল বিপর্যয়ের চিপা থেকে কে বাঁচাবে হ্যাঁচকা টানে?
হতাশ হয়ে চোয়াল ঝুলিয়ে বসে আছি আরও যাত্রী বেচারাদের সঙ্গে। এরই মধ্যে স্টেশনের স্বচ্ছ অ্যানাউন্সমেন্ট বক্সের ভেতর হালকা নড়াচড়া দেখা গেল। পেটমোটা রেল কর্মকর্তা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সিধে হয়ে বসল। ট্রেন লেট হওয়া বিষয়ক ঘোষণা আছে নির্ঘাত। তবে তার আগে টেবিল হাতড়ে চিপসের প্যাকেট খুলে বিশাল এক মুঠো মুখে পুরে দিয়েছে কর্মকর্তা সাহেব। কোনো জরুরি ঘোষণার আগে বিস্কুট কিংবা চিপস মুখে চালান দেওয়াটা জার্মান রেল কর্মকর্তাদের একধরনের আচার। তাতে নাকি ঘোষণায় একটা জোশ আসে।
শুরু হলো ঘোষণা, ‘অ্যা, ইয়ে, আহেম্, স্টুটগার্ট-টু-মুন্সটারগামী অমুক নম্বর ট্রেন আজকে তমুক সময়ের বদলে এত মিনিট দেরি করে আসবে।’ কিন্তু চিপস চিবানোর প্রবল কচরমচরের চোটে বেকুব বনে যাওয়া যাত্রী আমরা অমুক নম্বর, তমুক সময় আর কত মিনিটের অপেক্ষা—এতগুলো দরকারি তথ্যের একটারও নাগাল পেলাম না। রেল মাস্টারের তাতে বয়েই গেল। সে ততক্ষণে কোকের বোতলে ঘাউৎ ঢেকুর তুলে একটা চাইনিজ পাওয়ার ন্যাপের আয়োজন করছে। বেখেয়ালে মাইক্রোফোন ‘অন’ থাকায় সুউচ্চ হুংকারে পুরো প্ল্যাটফর্ম কেঁপে উঠল, ‘ঘাআআউৎ’...!।
এ রকম ভ্রান্তির সময়ে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থেকে মমি হয়ে যাব, নাকি বিকল্প কোনো ধান্দা চিন্তা করব, ভেবে না পেয়ে গাল চুলকাতে থাকলাম। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে। মাত্র ১০ মিনিট বসিয়ে রেখে লাল-সাদায় ছোপানো ‘ডয়েচে বান’ উদয় হলো স্টুটগার্ট স্টেশনে ধুলা উড়িয়ে। ‘হক মাওলা’ বলে লাফিয়ে চড়ে বসলাম সেকেন্ড ক্লাসের কামরায়। লোকে লোকারণ্য বগি। কই যে বসি। কিনেছি তো মাত্র কামরার টিকিট। সিটের জন্য আলাদা বুকিং দেওয়া লাগে আরও চার ইউরো খসিয়ে। নইলে খালি আসনের গ্যারান্টি নেই। ক্যাপিটালিজম দেখি এই জার্মান মুলুকে অলরেডি সুচ হয়ে ঢুকে পড়েছে। পদে পদে পয়সা ছাড়, নইলে থাকো ঝুলে বাদুড়ঝোলা হয়ে তখন। কি আর করা। খাম্বা একটা খুঁজে নিয়ে লটকে পড়লাম।
এদিকে তাড়াহুড়োয় সকালে নাশতা করা হয়নি। চেহারায় অভুক্ত ভ্যাগাবন্ড ভাব জেঁকে বসার আগেই ‘বাগেট’ নামে সরু, লম্বা একটুকরা রুটি বের করলাম ব্যাগ থেকে। এই বাগেট আসলে ফ্রেঞ্চদের আবিষ্কার। স্বাদে নরম আর মচমচে হওয়ার কথা, কিন্তু জার্মানদের হাতে পড়ে তার শরীর হয়েছে মার্সেডিজ গাড়ির বনেটের মতো শক্ত। ভেতর থেকে পনির আর টমেটোর টুকরাগুলো টিপে ফেলে দিয়ে এই বাগেট রুটি বাগিয়ে তলোয়ার বানিয়ে অনায়াসে ডুয়েট লড়া চলে, হাই হুই ঘ্যাচাং! আজীবন তুলতুলে পাউরুটি গেলা আয়েশি দেশি চোয়াল আর্তনাদ করে উঠছে রীতিমতো। এদিকে ট্রেনের রেস্তোরাঁ নাকি কী কারণে বন্ধ। ধোঁয়া ওঠা কফি দিয়ে গলা ভেজাব, সে উপায়ও নেই। অতএব, শুকনা মুখে তরোয়ালের রুটি চিবোতে লাগলাম চোয়াল চালিয়ে।
পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই বাঁ সারির একটা আসন ছেড়ে দিয়ে বয়স্ক ভদ্রমহিলা নেমে গেলেন। তড়িৎগতিতে সেই আসন দখলে নিয়ে ফেলে যাওয়া খবরের কাগজ ঝাড়া দিয়ে পড়া শুরু করলাম। চ্যাংড়া মতো এক ছোকরা সিট দখলের দৌড়ে হেরে গিয়ে মুখটা প্যাঁচা মতো বানিয়ে আমার একটু আগে ছেড়ে আসা খাম্বায় হেলান দিল নিরুপায়। সে যে খচে আছে, সেটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। পেপারব্যাক একটা হাতে নিয়ে সশব্দে পাতা ওল্টাচ্ছে ইচ্ছা করে। এই ছেলে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হালকা পা বাড়িয়ে রাখতে হবে। পাতা উল্টিয়ে জ্বালানোর বনামে বাংলা ল্যাং। ডান পা স্ট্যান্ডবাই পজিশনে রেখে জানালার বাইরে অলস তাকালাম।
সারি সারি শহর-নগর ফুঁড়ে ট্রেন চলছে দুলকি চালে। শহর পেরিয়ে কখনো গ্রাম আর খামারবাড়ি চোখে পড়ছে। দিগন্তজোড়া রাই শর্ষের হলুদ মাঠ দেখে গ্রামবাংলার ক্ল্যাসিক শর্ষেখেত বলে ভুল হতে চায়। কিন্তু গম্বুজ তুলে ক্রুশ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গির্জাটা আবার ভুল ভাঙিয়ে দেয়। ট্রেনের শোঁ শোঁ ছাপিয়ে গির্জার মাঝদুপুরের ঢং ঢং কানে আসছে। আধবোজা গরুর পাল জেগে উঠে আবার জাবর কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জীবন এখানে নির্ঝঞ্ঝাট।
বেশিক্ষণ আরাম করে এই সিন-সিনারি উপভোগ করা গেল না। মুঠোফোনে খুদে বার্তা উপস্থিত। মার্থা মেয়েটা আমাকে গরু খোঁজা খুঁজছে। মার্থা মাস্টার্সের থিসিসের ছাত্র। তার কালকে পোস্টার প্রেজেন্টেশন আছে। আমি তার কো-গাইড। পোস্টারের চূড়ান্ত রূপটা সে একবার দেখিয়ে হালাল করে নিতে চায়। সে নাকি এই ট্রেনেই আছে। ল্যাপটপ বগলে এদিকেই রওনা দিয়েছে।
মিনিট পাঁচেকের মাথায় মার্থা গালভর্তি হাসি নিয়ে উদয় হলো। মেয়েটা জাতে কাজাখস্তানি। পড়াশোনা তুরস্কে আর এখন জার্মানিতে। এখানকার পাট চুকিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা। একই সঙ্গে সে একজন ফ্যাশনিস্তা। মিউনিখ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সটির প্যাথলজি ভবনে ভুশভুশে জিনস পরে আমচু মুখের পিএইচডি-পোস্টডক-প্রফেসরের মধ্যে মার্থার ঝলমলে সাজ দুর্দান্ত রকমের চোখে পড়ে। বিজ্ঞানী মানেই যে চোখে কালশিটে আর পোশাকে একটা বাস্তুহারা কাঙাল ভাব থাকতে হবে, এই মতবাদে সে বিশ্বাসী নয়। ঘন করে মাসকারা দেওয়া উচ্ছল মার্থাকে তাই ভালো না লেগে যায় না।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ঘটিয়ে ইঁদুরের দেহে ক্যানসার বাঁধানো হয়েছে। ক্যানসার নিয়ে আমাদের গবেষণা। সেই ইঁদুরের কিডনি আর লিভার স্লাইস করে কাটা হিস্টোপ্যাথলজি স্লাইডের ছবিগুলো দেখতে দেখতে জানালার বাইরে চোখ দেওয়ার আর সময় হলো না। শহর-জঙ্গল-নদী বদলে যেতে থাকল বায়োস্কোপের গতিতে। ইশ্, কিচ্ছু দেখা হচ্ছে না। এই মেয়ের জ্বালায় রবার্ট ফ্রস্ট আউড়ে ফেলতাম মনে মনে, “Two roads diverged in a yellow wood/ And sorry, I could not travel both”। এক-আধবার যে-ই না বাইরে দৃষ্টি ছুড়েছি, মার্থাও সমানতালে প্রশ্ন ছোড়ে, ‘এই মাউস মডেলের লিমিটেশন নিয়ে কী বলা যায়, বলো তো?’। জবাবে আমতা আমতা করে গাল চুলকে দুই-তিনটা সম্ভাব্য যুক্তি বাতলে দিতে হলো। আগ্রহী ছাত্র মার্থা তার জীবনে এমন অমনোযোগী শিক্ষক বোধ হয় আর দেখেনি।
ট্রেনের চাকা একসময়ে মুন্সটার স্টেশনে এসে থামল। মার্থার হোটেল আরেক খানে। এক হোটেলে ঠিকানা না হওয়ায় মনে মনে খুশি হলাম। নইলে আরেক দফা জ্ঞান ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলত। যা হোক, মেয়েটা পোস্টার কাঁধে খুশিমনে বিদায় নিল। তাকে যেকোনো কঠিন প্রশ্ন সামাল দেওয়ার মতো করে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে গত এক ঘণ্টায়।
নতুন শহর দেখার রোমাঞ্চে তড়িঘড়ি করে স্টেশন ছেড়ে রাস্তায় নামলাম। মুঠোফোনে গুগল ম্যাপে ঠিকানা টিপে রওনা দিতেই একটা বোতলের ছিপি এসে টুং করে পায়ে লাগল। উৎস খুঁজতেই দেখি ফুটপাতে কাত হয়ে পড়ে আছে ছিপি বাবা। বাবার চারপাশে আরও বাবা আছে। কারও হাতে গাঁজার পুরিয়া, কারও পাশে খালি বোতল গড়াচ্ছে, কারও সামনে উল্টো টুপিতে খুচরা পয়সা উঁকি দিচ্ছে। ভিন্টেজ চেহারার বনেদি নগরের যে চেহারা মাথায় নিয়ে এসেছি, তার সঙ্গে দেখছি কিছুই মিলছে না।
খুব সাবধানে বাবাদের পাশ কাটিয়ে চললাম হন হন করে। কে যেন খেঁকিয়ে উঠল, ‘অ্যাই দেখলে, একটা বিয়ারের পয়সাও দিয়ে গেল না, হিক্...’। (চলবে)
লেখক: ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার, গবেষক, মিউনিখ, জার্মানি
ছবি: লেখক