প্রতিবছরই ফ্যাশনে কতই না ট্রেন্ড আসে-যায়। ট্রেন্ডের পেছনে ঘুরে আমরা আমাদের আলমারি ভরিয়ে ফেলি। কিন্তু সেই পোশাক কিংবা অনুষঙ্গের সব কটি খুব একটা পরা হয় না। এরপর আবার আসে নতুন জামা, জুতা, গয়না, ব্যাগ। আগেরগুলোর জায়গা হয় ভাগাড়ে। জমে ওঠে ফ্যাশন-বর্জ্যের পাহাড়। আর এভাবেই হচ্ছে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি। এ নিয়ে ভাবলে বোঝা যায়, পৃথিবীর পরিবেশ নষ্ট হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ফ্যাশন-দূষণ। এমন পরিস্থিতিতে কেবল আমরাই পারি এই ভয়ানক ক্ষতির হাতে থেকে আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীকে বাঁচাতে। এ জন্য পোশাক আর অনুষঙ্গ ব্যবহার, কেনাকাটা আর ফেলে দেওয়ার ব্যাপারে সচেতনতা ও বিচক্ষণতাই হতে পারে একমাত্র উপায়। তাহলেই আমরা হয়ে উঠতে পারব ‘পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনিস্তা’।
এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা জানেনই না তাঁদের কাছে কতগুলো পোশাক আছে। লাইফস্টাইল কোম্পানি ওয়েট ওয়াচার্স তাদের এক গবেষণায় খুঁজে পেয়েছে, সারা বিশ্বে মহিলারা তাঁদের সংগ্রহে থাকা পোশাকের ৩০ শতাংশ পরেন; বাকি ৭০ শতাংশ অব্যবহৃতই থেকে যায়। আরেকটি লাইফস্টাইল কোম্পানি মুভিনগারের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে মানুষের কতগুলো পোশাক আছে আর তারা আসলে তার কত শতাংশ পরছে, তা নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি আছে। এমনকি আমাদের সবচেয়ে ভালো পোশাকগুলোর ৫০ শতাংশও পরা হয় না। তাই পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনিস্তা হতে হলে সবার আগে নিজের আলমারিতে কী আছে, সেটা জানতে হবে। আলমারি গোছাতে গেলেই দেখা যাবে এমন অনেক পোশাক আছে, যা আপনি হয়তো কখনো পরেননি, বা অদূর ভবিষ্যতেও পরার সম্ভাবনা নেই।। এ ছাড়া এমন কিছু পোশাক পেয়ে যেতে পারেন, যা অনায়াসে কারও সঙ্গে অদল-বদল করে পরতে পারবেন। এভাবে নতুন পোশাক কেনার প্রবণতা কমে আসবে।
ধরুন, আলমারি গোছাতে গিয়ে দেখলেন, আপনার কোনো পছন্দের একটি জামা সামান্য ছিঁড়ে গেছে, তাহলে কী করবেন? ফেলে দেবেন? ফেলে না দিয়ে জামাটি কিন্তু সেলাই বা রিপু করে ফেলতে পারেন। ছোটখাটো ছেঁড়াফাটা ঠিক করা খুব কঠিন কিছু নয়। এখন ইউটিউবে এই সম্পর্কিত অনেক টিউটোরিয়াল পাওয়া যায়, যা দেখে আপনি সহজেই এ ধরনের সেলাই শিখে ফেলতে পারবেন। মনে রাখবেন, সেলাই করতে জানাও একটি ব্যক্তিগত দক্ষতা।
চাইলেই আপনি আপনার পোশাক ভাই-বোন বা বন্ধুদের সঙ্গে বিনিময় করতে পারেন। এটি আপনার আলমারি খালি করতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি আপনার পুরোনো পোশাক নতুন জীবন পাবে। এ ছাড়া আপনিও আপনার কোনো বন্ধু বা ভাই-বোনের পোশাক তাদের কাছ থেকে নিতে পারেন। এভাবে বিনা মূল্যে আপনি একটা নতুন পোশাক পাবেন।
পুরোনো জামাকাপড়ের জন্য আরেকটি বিকল্প হলো সেগুলো দাতব্য সংস্থায় বা যাদের প্রয়োজন, তাদের দান করে দেওয়া। এভাবে অন্যদের যেমন উপকার করা হবে, তেমন পরিবেশে ফ্যাশন-বর্জ্যের পরিমাণও কমবে।
প্লাস্টিক বলতে এখানে পলিয়েস্টার, অ্যাক্রিলিক, নাইলন ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। এই মাইক্রোফাইবারসমৃদ্ধ কাপড় জীবাণুবিয়োজ্য নয়। তাই খুব সহজে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। এগুলোর বদলে সুতি, সিল্ক, লিনেন, উলের পোশাক কিনুন।
গত বছরে ফ্যাশন–দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ট্রেন্ড ছিল থ্রিফটিং। এর অর্থ ব্যবহৃত পোশাক কেনা। মিলেনিয়াল থেকে শুরু করে জেন জি—সবার কাছে বেশ জনপ্রিয় ফ্যাশনের এই ধারা। আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, প্রতিটি মানুষ যদি সেকেন্ড হ্যান্ড বা প্রিলাভড পোশাক কেনেন, তাহলে প্রতিবছর ৫০০ পাউন্ডের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ প্রতিরোধ করা যাবে। পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনিস্তা হতে চাইলে পুরোনো পোশাক কিনুন। বর্তমানে আমাদের দেশে ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকভিত্তিক অনেক থ্রিফট শপ আছে, যেখানে কম দামে ভালো মানের সেকেন্ড হ্যান্ড জামাকাপড় কিনতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশ থ্রিফট, কালারস ঢাকা, থ্রিফট শাড়ি, থ্রিফট কামিজ, খুঁত অদলবদল, দেশাল ড্রেস লাভার, শাড়ি ডিক্লাটার, অদলবদল ইত্যাদি।
পোশাককে বিনিয়োগ মনে করুন। সাময়িক ট্রেন্ডে গা ভাসিয়ে নিম্নমানের অনেকগুলো পোশাক না কিনে, বেশি দাম দিয়ে একটা ভালো মানের পোশাক কিনুন। নিম্নমানের পোশাক অল্প দিন পরলেই পুরোনো হয়ে যাবে। মানসম্পন্ন পোশাকগুলো ব্যয়বহুল হতে পারে, তবে এগুলো সাধারণত বেশ টেকসই হয় এবং বছরের পর বছর স্থায়ী হয়। পদ্ধতিটি এ জন্যই আর্থিকভাবে লাভজনক।
সাসটেইনেবল বা টেকসই বা পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনের অর্থ অত্যন্ত বহুমুখী। পোশাকের যত্ন নেওয়াও এর অংশ। সঠিক যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ আপনার জামাকাপড়ের স্থায়িত্ব বাড়িয়ে তার আয়ু দীর্ঘায়িত করবে। যেমন সঠিকভাবে যত্ন নিলে একটা চামড়ার জ্যাকেট, জিনস বা খাঁটি সুতির তাঁতের শাড়ি বহু বছর টিকে যেতে পারে। তাই আপনার পোশাকের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হোন।
ছবি: পেকজেলসডটকম
হিরো ইমেজ: হাল ফ্যাশন