কাঠ-কংক্রিটের শহরে খোলা আকাশ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মেয়ের স্কুলের কারণে পথ আমার চেনা। কিন্তু গুগল ম্যাপে নিশানার জন্য যখন আমাকে অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ পাঠানো হলো তখন একটু চমকে উঠেছি। ঢাকা শহরে যেখানে বাগি আর গলি দিয়ে ঠিকানা চেনা যায়, সেখানে কেন আমার ভূগোল জ্ঞানের পরীক্ষা! কিন্তু ছুটির দিনে সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে টের পেলাম নেহায়েত গলি-বাড়ির নম্বর দিয়ে এই বাড়ি আমি কখনো খুঁজে পেতাম না।

মাদানী এভিনিউ থেকে নেমে একটি বড় আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে বালু নদীর কিনারায় পৌঁছে টের পাই, আশপাশে তেমন কোনো বাড়িঘর নেই। বড় বড় প্লট আছে। গুগল ম্যাপ যে পথে যেতে বলে, সেটি যে একটি পথ, সেই প্রত্যয়ও জোরদার হচ্ছে না। তখন চালক জানালেন, এক ব্যক্তি হাত ইশারায় ডাকছেন। কাছে যেতে বললেন, কোনো বাড়ি খুঁজছেন? হ্যাঁ-বোধক জবাব পেয়ে তিনি একটা পথের মতো দেখিয়ে দিলেন। তিনি বলেন, ‘এই পথের মাথায় চলে যান।’

তাই সই। একেবারে শেষ মাথায় পৌঁছাতে একটা দেয়াল ঘেরা আঙিনা পাওয়া গেল। বাড়ির সামনে একটা গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে বড় গেটের সামনে দাঁড়ালাম। ছোট পকেট গেট দিয়ে ঢুকেই বুঝতে পারলাম ঠিক ঠিকানায় এসেছি।
গেট দিয়ে ঢুকতেই একটি খোলা মাঠের মতো জায়গা। হাতের বাঁয়ে একটা সার্ভিস হাউস। যে কেয়ারটেকার আমাকে স্বাগত জানালেন, তিনি সেখানেই থাকেন। পরিচয় দিতে বললেন, ‘ভিতরে চলে যান। ওনারা আছেন।’

বিজ্ঞাপন

গেট থেকে একটু দূরে বাড়ি। প্রবেশপথেই একটা শিউলিগাছ। হেরিংবোনের পথ। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম। বাঁ পাশে মাঠের দিকে কাঠগোলাপের সারি। সীমানা দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটি আমগাছ। রাস্তা বরাবর একটি কক্ষ। একটু পাশ ঘেঁষে বাড়িতে ওঠার ধাপ। সেখানে একটা সোনালুগাছে কয়েকটা সোনালু এখনো আছে। বাড়ির শুরুতে একটি পাকা দেউড়িঘর। তিন দিকেই খোলা। চেয়ার আর একটি ছোট্ট টেবিল। মোড়াও আছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন স্থপতি নীতি মাহবুব ও ওয়ারেস উল-আম্বিয়া। তাঁদেরই নকশা ও তত্ত্বাবধানে বাড়িটি নির্মাণ করেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালক। স্থপতিদ্বয়ের প্রতিষ্ঠান আর্কফিল্ড বাংলাদেশ। এই সংস্থার পুরকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।

‘বাড়ির ভেতরের লিভিং স্পেস থেকে, এই দেউড়িঘরটা আমরা ইচ্ছে করে আলাদা করেছি,’ জানালেন স্থপতিদ্বয়। ‘এতে দুটো লাভ। সবাইকে বাড়ির ভেতরে নিতে হচ্ছে না। আবার ইচ্ছা করলে বাড়ির সবাই বাইরে এসে মাঠের সামনে বসে থাকতে পারল। এখানে সান্ধ্য আড্ডাটা খুব জমে ওঠে।’

বিজ্ঞাপন

আমিও দুই স্থপতিকে নিয়ে সেখানেই বসে পড়লাম। ৫ কাঠার তিনটি প্লট, তথা ১৫ কাঠাজুড়ে বড় স্পেসে মাত্র ১ হাজার ৯০০ বর্গফুটের এই স্থাপনা। কেন? ব্যস্ত গৃহস্থালি, স্বাস্থ্যকর আবাস ও স্মুতির বুননের একটি প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করছে ছোট্ট স্থাপনাটি। মূল কাঠামোটি যথাসম্ভব ক্ষুদ্র রাখার চেষ্টা করেছেন স্থপতিদ্বয়। ঢাকা শহরে যত থাকার জায়গা, সেগুলো সবই শেষ পর্যন্ত ইট-কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়।

আবার খোলামেলা গ্রামের বাড়িতে যেতে আগ্রহী হয় না নতুন প্রজন্ম। এই দুইয়ের সমন্বয় করার জন্য নিজের বাড়িতে অনেকটুকু খোলামেলা জায়গা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাড়ির মালিক। বাড়িতে মাস্টার বেড, চাইল্ড বেড, কিচেন ছাড়াও একটা বড় লিভিং স্পেস। সেখানেই খাওয়াদাওয়ার এন্তেজাম। শোবার ঘর দুটো কেবলই শোবার ঘর। তবে শিশুর ঘরে পড়াশোনার জন্য টেবিল পাতার জায়গা রয়েছে।

এ ছাড়া রয়েছে একটা অতিথি কক্ষ। সেটি শুরুতে দেউড়িঘরের সঙ্গে লাগোয়া। দেউড়িঘর আর মূল দালানের মধ্যখানে একটি ছোট্ট উঠান। সেই উঠানের একপাশে কংক্রিটের একটি পথ। সেই পথ পেরিয়ে যেতে হয় লিভিং স্পেসে। মূল পরিকল্পনায় এই পথের দুই দিকেই উঠান থাকলেও অতিথি কক্ষের জন্য একটি উঠান ছেড়ে দিতে হয়েছে।

ASIF SALMAN.COM

ইটের গাঁথুনির এই একতলা বাড়ির জন্য প্রচলিত ইটের চেয়ে ছোট ইট আনা হয়েছে সাতক্ষীরা থেকে। তা দিয়েই এর কাঠামো। দুই কলামে ইট রেখে মধ্যখানে সিমেন্টের গাঁথুনি। ফলে ইটের রংই বাড়ির রং। দেউড়িঘরের ছাদে ‘শীতলপাটি’ দিয়ে করা হয়েছে ফলস রুফ। তার ওপরে প্রচলিত কাদামাটির টাইলস।

স্থপতিদ্বয় জানালেন এই বাড়ি ডিজাইন করার সময় তাঁরা তিনটে বিষয় মাথায় রেখেছেন–

খোলা জায়গা- শহুরে আবহাওয়ায় খোলা জায়গা খুব একটা রাখা জায়গা। কিন্তু এই বাড়িতে যথাসম্ভব ওপেন স্পেস রাখা হয়েছে।

দেউড়িঘর বা প্যাভিলিয়ন- একটা খোলামেলা দেউড়িঘর থাকাতে বাতাসের ছোটাছুটি নিশ্চিত করা গেছে। এর ফলে পুরো বাড়ির তাপমাত্রা কমে আসে। আবার দেউড়িঘরটি বহুমুখী কাজ যেমন ফ্যামিলি গ্যাদারিং বা ওয়ার্কিং মিটিংয়ের জন্যও ব্যবহার করা যাচ্ছে।

উঠান- শহরের বাড়িতে উঠান একটি কষ্ট-কল্পনা। কিন্তু এখানে উঠানের উপস্থিতি পুরো ব্যাপারটিকে নতুন দ্যোতনা দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, উঠানের মাধ্যমে খোলামেলা দেউড়িঘরের সঙ্গে মূল বাড়ির একটি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। উঠান পেরিয়েই আপনাকে যেতে হবে মূল বাড়িতে।

সামনের খোলা জায়গাটিকে খেলার মাঠ হিসেবে রেখে চারপাশে নানা ফুল ও ফলদ গাছ লাগানো হয়েছে। দাওয়ায় বসে থাকলে এমনিতেই মনটা ভরে ওঠে। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে স্থাপনার সামনের খোলা জায়গাটুকু রেখে দেওয়া হয়েছে।

একসময় সেটাই হয়ে উঠবে আশপাশের সারি সারি ইমারতের মানুষের জন্য একটুকরা খোলা আকাশ।

ছবি: আসিফ সালমান ও আর্কফিল্ড বাংলাদেশ

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৩, ১৬: ০০
বিজ্ঞাপন