স্থাপত্যে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার
শেয়ার করুন
ফলো করুন

‘যে জন দিবসে মনের হরষে
জ্বালায় মোমের বাতি,
আশুগৃহে তার দেখিবে না আর
নিশিথে প্রদীপ ভাতি।’

দিনের আলোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষ উপলব্ধি করে আসছে। প্রাচীনকালে, এমনকি আধুনিক যুগের প্রথমাংশেও মানুষ দিনের বেলাতেই সব কাজ সম্পন্ন করে ফেলত। পশ্চিমা বিশ্বে এখনো দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ‘ডে লাইট সেভিংস’ নিয়ম চালু আছে।

বিজ্ঞাপন

প্রাকৃতিক আলোর গুরুত্ব

ঢাকা চারুকলা অনুষদ
ঢাকা চারুকলা অনুষদ

স্থাপত্যচর্চায় দিনের আলো বা প্রাকৃতিক আলোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্থাপত্যের ভাষায় তা ‘ন্যাচারাল লাইটিং’ বা ‘ডে লাইটিং’ হিসেবে পরিচিত।
বিখ্যাত স্থপতি, স্থাপত্যাচার্য লুই আই কানের অভিমত, ‘স্থাপত্য তখনই দৃশ্যমান হয়, যখন সূর্যের আলো দেয়ালে এসে পড়ে।’

প্রাকৃতিক আলো ব্যবস্থাপনার এ পদ্ধতি কৃত্রিম আলোর ব্যবহার হ্রাস করে প্রাকৃতিক আলোর যথোপযুক্ত ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে। এটা প্রমাণিত যে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার ঘরে বসবাসরত মানুষদের স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে, নিয়ন্ত্রণ করে অন্দরের আবহকেও। স্থান, কাল ও মেজাজভেদে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার এবং আলোর আগমন পথের বিন্যাস ও পদ্ধতি ভিন্ন হয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

ঘরে প্রাকৃতিক আলোর প্রবেশপদ্ধতি

ঘরে প্রাকৃতিক আলো প্রবেশের কিছু স্থাপতিক পদ্ধতি বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। স্থাপত্য গুরুরা তাঁদের কাজে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার করে গেছেন বারবার। এই প্রাকৃতিক আলোকে বিভিন্নভাবেই ঘরের ভেতর নিয়ে আসা যায়। স্থাপত্যবিদ্যায় খুব পরিচিত কিছু পদ্ধতি আছে দিনের আলো ব্যবহারের।

বড় জানালা দিয়ে বাইরের আলোকে ঘরে নিয়ে আসা।
বড় জানালা দিয়ে বাইরের আলোকে ঘরে নিয়ে আসা।

প্রথমটি হলো আমাদের চিরচেনা সাধারণ পদ্ধতি। বড় জানালা দিয়ে বাইরের আলোকে ঘরে নিয়ে আসা। যেকোনো দিকের আলোই এ ক্ষেত্রে ঘরে প্রবেশ করতে পারে এবং সমানভাবে বা ইউনিফর্মলি পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। যেমন পাঠাগার, ছবি আঁকার স্টুডিও, ক্লাসরুমে এই আলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছায়ার বিষয়টা খেয়াল রাখতে হয়।

উত্তরের আলোয় ছায়া উৎপন্ন হয় না বিধায় ভবন নকশার ক্ষেত্রে এসব কক্ষ এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে, যাতে করে উত্তর দিকের আলো কক্ষগুলোতে আসে সমভাবে। স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলাম চারুকলা ইনস্টিটিউটের নকশা করেছেন এভাবেই। এ ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি সূর্যের আলোকে কীভাবে পেইন্টিংয়ের ওপর ফেলা যায়, তা নিয়ে কাজ করেছেন। এ জন্য শ্রেণিকক্ষের জানালাগুলোর অবস্থান স্বাভাবিকের তুলনায় ওপরে।

চারুকলা ইনস্টিটিউটে শ্রেণিকক্ষের জানালাগুলোর অবস্থান স্বাভাবিকের তুলনায় ওপরে।
চারুকলা ইনস্টিটিউটে শ্রেণিকক্ষের জানালাগুলোর অবস্থান স্বাভাবিকের তুলনায় ওপরে।

উত্তর দিক ছাড়া অন্য তিন দিকের জানালা বা আলো আসার পথের ক্ষেত্রে তীব্রতা থেকে বাঁচতে বিভিন্ন ধরনের শেড ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রাচীনকাল থেকে এমন জাফরি কাটা শেড, খড়খড়ির জানালা ব্যবহৃত হয়ে আসছিল এ অঞ্চলে। এখন প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটাই উন্নত হয়েছে আলোর তীব্রতাকে কমিয়ে আনার পদ্ধতি। দিকভেদে শেডেও আসে ভিন্নতা। দক্ষিণের জানালার শেডের তুলনায় পশ্চিমের জানালার শেড অনেকটাই চওড়া হয় প্রস্থে। প্রয়োজনে একাধিক শেডের ব্যবস্থা থাকে। আজকাল স্বয়ংক্রিয় শেডও পাওয়া যায়, যা আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি বা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।

ঘরের মধ্যে দিনের আলো আনার আরেকটি অতি পরিচিত পদ্ধতি হলো স্কাইলাইট বা ছাদ থেকে আসা আলো। এতে ঘরের ছাদে বিশেষ ধরনের জানালা স্থাপন করা হয়। সাধারণত এট্রিয়াম বা কেন্দ্রিক জায়গাগুলোতে স্কাইলাইটের ব্যবহার দেখা যায়। এ ছাড়া শোবার ঘর, খাবার ঘর, বসার ঘর ইত্যাদিতেও স্কাইলাইট পছন্দের তালিকায় আছে অনেকেরই।

স্কাইলাইট বা ছাদ থেকে আসা আলো
স্কাইলাইট বা ছাদ থেকে আসা আলো
প্রতিফলিত আলো বা রিফ্লেকটেড লাইট
প্রতিফলিত আলো বা রিফ্লেকটেড লাইট

আরও আছে প্রতিফলিত আলো বা রিফ্লেকটেড লাইট। দিনের আলোকে বিশেষভাবে প্রতিফলনের মাধ্যমে ঘরে প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়াটাই হলো রিফ্লেকটেড লাইটিং। এ ক্ষেত্রে ছাদ থেকে অথবা জানালা থেকে উভয় দিক থেকে আসা আলোকেই প্রতিফলনের মাধ্যমে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করানো যায়, প্রদর্শনী কক্ষের প্রদর্শিত বস্তুগুলোর ওপর আলো ফেলা যায় অথবা কাজের টেবিল, পড়ার টেবিল, পেইন্টিং স্টুডিও ইত্যাদির ওপর বিশেষভাবে প্রাকৃতিক আলো ফেলার ব্যবস্থা করা যায়।

যুগে যুগে স্থাপত্যে প্রাকৃতিক আলো

প্রাচীনকাল থেকে স্থাপত্যচর্চায় প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার দেখা যায়। মিসরীয়, গ্রিক, রোমান, বাইজেন্টাইন ইত্যাদি স্থাপত্যচর্চায় সূর্যের আলোর ব্যবহার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে সমাধা করেছেন সে সময়কার স্থপতিরা। প্রাচীন উপাসনালয়গুলো যেমন গ্রিসের পারথেনন, রোমের প্যানথিওন, তুরস্কের হায়া সোফিয়া (প্রথমে গির্জা পরবর্তী সময় মসজিদ), স্পেনের আল হামরা ইত্যাদি ধর্মীয় স্থাপনায় প্রাকৃতিক আলোর কাব্যিক ব্যবহার এক স্বর্গীয় আবেশ তৈরি করে। পরবর্তী সময় লি কর্বুসিয়ার, লুই আই কান প্রমুখ প্রাকৃতিক আলো নিয়ে প্রচুর কাজ করেন। কর্বুসিয়ারের রনশ্যাম্প গির্জায় তিনি আলোর সঙ্গে যে আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক প্রকট, তা দেখিয়েছেন। পুরু কনক্রিটের দেয়ালে ছোটবড় বিভিন্ন মাপের জানালা নির্দিষ্ট দূরত্বে এমনভাবে স্থাপন করা, যাতে সূর্যের আলো একটু ঘুরে মূল বেদিতে পাদরির ওপর পড়ে।

আমাদের সংসদ ভবনে আলো নিয়ে কাজ করেছেন লুই কান
আমাদের সংসদ ভবনে আলো নিয়ে কাজ করেছেন লুই কান

স্থপতি লুই আই কান কিম্বেল আর্ট মিউজিয়াম, সল্ক ইনস্টিটিউট, আমাদের সংসদ ভবনসহ তাঁর বিখ্যাত সব স্থাপত্যে প্রাকৃতিক আলো নিয়ে কাজ করেছেন। মূলত গ্রিক স্থাপত্যে আলো অন্ধকারের যে রহস্যময়তা ফুটে ওঠে, সেটাই ছিল তাঁর কাজের অনুপ্রেরণা। তাই তাঁর কাজে ফুটে উঠেছে অসাধারণ এক আলো ছায়ার নাটকীয়তা। এ ছাড়া আলভার আলতো, মিজ ভ্যান ডার রোহ, মারিও বোটা প্রমুখ তাঁদের স্থাপত্যে আলো নিয়ে কাজ করেছেন সফলভাবে।

পরবর্তী সময় ড্যানিয়েল লিবেস্কিন্ড তাঁর বিখ্যাত জুইশ মিউজিয়ামে প্রাকৃতিক আলো নিয়ে কাজ করে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন হলোকস্টের ভয়াবহতা। তাদাও আনদোও তাঁর স্থাপত্যে আলো নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর চার্চ অব লাইট এ ক্ষেত্রে অন্যতম। বাংলাদেশের স্থপতিদের মধ্যে স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলাম, বশিরুল হক, মেরিনা তাবাসসুম প্রমুখ প্রাকৃতিক আলো নিয়ে কাজ করেছেন। পরবর্তী সময়ও অনেক স্থপতি কাজ করেছেন প্রাকৃতিক আলো নিয়ে।

তাদাও আনদোও কাজ করেছেন আলো নিয়ে
তাদাও আনদোও কাজ করেছেন আলো নিয়ে

আজকাল কৃত্রিম আলোর ব্যবহার বেড়ে গেছে খুব। অথচ খুব সহজেই একটি স্থাপনায় দিনের বেলায় সূর্যের আলো ব্যবহার করে আমরা বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারি। শুধু তা-ই নয়, সূর্যের আলো ব্যবস্থাপনার জন্য আছে অনেক প্রাকৃতিক সমাধানও। উপরন্তু সূর্যের আলোর জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না উল্টো অর্থ সাশ্রয় হয়। বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে সম্পদের খরচ, পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ইত্যাদি রোধে আমাদের উচিত প্রাকৃতিক আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

ছবি: লেখকের দেওয়া

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪: ১৭
বিজ্ঞাপন