সকালবেলা একপশলা বৃষ্টি এসে রাস্তাঘাট, গাছপালা ধুয়ে দিয়ে গেল কিন্তু মুছে দিল না। খানিকটা ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে গেল। কয়েক দিনের জন্য ছুটি কাটাতে আমার স্ত্রী ও আমি বেরিয়ে পড়লাম। ফ্রান্সের দক্ষিণের বড় শহর তুলুজ থেকে আমাদের যেতে হবে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার বা ৪০০ মাইল পথ। গন্তব্য ভূমধ্যসাগরের তীরে, নিস শহরের অদূরে গ্রাস শহর। আকাশ তখনো মেঘে ঢাকা। আমাদের মনের আকাশে তখন হাজার সূর্যের আলো। দৈনন্দিন গতানুগতিক জীবন, প্রাত্যহিকতায় জমে ওঠা ক্লান্তি থেকে খানিকটা মুক্তি, তাতেই আনন্দ। এ দেশে গ্রীষ্মের ছুটি জুলাই-আগস্ট—দুই মাস। আমরা ভিড় এড়াতে জুনের শেষ সপ্তাহটি বেছে নিয়েছি। আর তাই মহাসড়কে যানবাহনের মহাসমারোহ নেই। মসৃণ সড়কে আমাদের যন্ত্র শকট অনেকটা শব্দহীন দ্রুত এগিয়ে যায়।
ভূমধ্যসাগর ও সেখানকার চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় প্রকৃতি এখানে অনেক বেশি অকৃপণ। মোট ২১টি দেশের সৈকত ছুঁয়ে গেছে প্রকৃতির বিস্ময় এই সাগর, বিশাল জলাধার। দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত ছুঁয়ে এক ফ্রান্সের ভাগেই পড়েছে ৯০০ কিলোমিটার বা ৫৬০ মাইলজুড়ে এই সাগর।
গ্রাস শহরের বাইরে পাহাড়ের ওপরে একটি বাড়িতে আমাদের থাকার জায়গা আগে থেকেই ভাড়া করা ছিল। চারদিকে ঘন সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা। সেখানে পৌঁছে, বড় রাস্তা ছেড়ে একসময় পাহাড়ি সরু সর্পিল পথে বেশ কিছুদূর যেতে হয়। আঁকাবাঁকা পাহাড়ের পথে গাড়ি চালাতে খুব দক্ষ ও সতর্ক হতে হয়। বিশেষ করে খুব প্রয়োজনের সময় জিপিএস যখন খেই হারিয়ে ফেলে।
পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ের ঢাল ছেড়ে সূর্য তখন সমুদ্রে ডুব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে সময়ে আমরা আমাদের অস্থায়ী আবাসে পৌঁছে যাই। দুজনার আয়েশ করে থাকার মতো, এক রুমের একটি বাসা। রান্নার সব সুবিধা আছে। ঘরের সামনে একটুখানিক বাগান। সেখানে চারজনার বসার চেয়ার, টেবিল আর রোদ ঠেকাতে পেল্লায় এক রোদছাতা রাখা আছে। প্রতিদিনের ভাড়া বাবদ গুনতে হবে ১২০ ইউরো করে। আজকাল সবকিছু হয় অন্তর্জালে, তাই বাড়ির মালিক বেশ কয়েকটি গোপন সংখ্যা পাঠিয়ে দিয়ে জানিয়ে দিলেন, সেই সঙ্গে কীভাবে প্রধান ফটক, দরজা খুলতে বা বন্ধ করতে হবে, খুঁটিনাটি নির্দেশনা ইত্যাদিও।
মোনাকো, ইতালির কাছাকাছি ফ্রান্সের বড় শহর নিস এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবখ্যাত কান শহর আমাদের অনেক আগেই দেখা হয়ে গেছে। এবার আনতিব শহরটি ঘুরেফিরে দেখার ইচ্ছা। কান শহর থেকে ১০ কিলোমিটার বা ৬ মাইল এবং নিসের ২০ কিলোমিটার বা ১২ মাইল দূরত্বে বন্দর শহর আনতিবে পর্যটকেরা আসেন সাগরের অপরূপ নীল জলের দুর্বিনীত সৌন্দর্যে অভিভূত হতে।
প্রচলিত আছে যে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখান থেকে অপূর্ব নীল রঙের যে জলরাশি দেখা যায়, তা আর অন্য কোনো সৈকত থেকে দেখা যায় না। লেখক, কবি আর শিল্পীদের খুব পছন্দের জায়গা। তাঁদের অনেকেই এখানে বেড়াতে এসে শান্ত নীল আকাশ আর সমুদ্রের নিসর্গে সৃষ্টিসুখে রচনা করেছেন কাব্য, সুর-সংগীত, শিল্পের নান্দনিক সুষমা। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এখানে একটি বাগানের নাম রাখা হয়েছে ‘কবিদের বাগান’।
আনতিব বন্দরের ঘাটে বাঁধা আছে ধনাঢ্যদের সারি সারি বিলাসবহুল সব প্রমোদতরি। একটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে নানা রঙের ছোট ছোট বোট, অনেকটা ছবিতে দেখা ছবির মতো। সৈকতজুড়ে অকৃপণ সূর্যের প্রাচুর্য। সমুদ্রস্নানের সঙ্গে সূর্যস্নানে ভিড় জমে ধবল বালুর দীর্ঘ সৈকতে, নানা দেশের, নানা বর্ণের মানুষের। আশপাশে নানা ভাষার কলতান।
আজকাল একটু কান পাতলে বাংলা ভাষাও শুনতে পাওয়া যায়। দল বাঁধা তরুণ-তরুণীদের অকারণ বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, অবাধ্য হাসির দমকে মূর্ত হয় অপার্থিব আনন্দ।
গুটিকয় আফ্রিকান যুবক কাঁধে নানা রঙের চাদর নিয়ে ফেরি করছে পর্যটকদের কাছে। কেউ কেনে, কেউবা মৃদু হেসে ফিরিয়ে দেয়। পৌর কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সৈকতে আয়োজিত হচ্ছে ফ্যাশন শো। অনেকটা আড়ালে সাইকেলে ঘুরে বেড়ায় ট্যুরিস্ট পুলিশ। কালো রোদচশমার আড়ালে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাঁদের।
পুরোনো শহরের সরু গলিতে আছে ছোট ছোট অনেক বুটিক, স্যুভেনিরের দোকান আর বহু রেস্তোরাঁ। সমুদ্রের তাজা মাছ, চিংড়ি, ঝিনুক, কালামার, অক্টোপাসের স্বাদ আস্বাদনে ২০ থেকে ২৫ ইউরো গুনতে হবে। দোকানপাট ছাড়িয়ে সরু রাস্তার দুই পাশের বাড়িগুলো প্রাচীন হলেও মোটেও মলিন নয়। কিছু কিছু বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে রঙিন বোগেনভিলিয়ার ঝাড়, নাম না জানা ফুলের গাছ, লতা, সবুজ গুল্ম।
এখানকার আরেকটি অন্যতম আকর্ষণ হলো পিকাসো জাদুঘর। ১৯৪৬ সালে বিশ্বনন্দিত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩) এখানে এসেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৫ বছর। তত দিনে তিনি তাঁর শিল্পীর চোখে দেখেছেন পৃথিবীর রূপ, রস, লাবণ্য।
শিল্পী এখানে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে এসেছিলেন। আর এসেই ভীষণ বিস্মিত হলেন। তাঁর চমৎকৃত শিল্পীসত্তা এখানে নোঙর ফেলল, শিগগির ফিরে যেতে চাইলেন না। থেকে গেলেন পুরো দুই মাস। শিল্প সৃষ্টির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এ সময়ে বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। আনতিবের নামের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন নিজের অজান্তে।
নতুন শহর থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে পুরান শহর। সেখানে চোখে পড়বে পাথরের বিশাল এক প্রাচীরে সুরক্ষিত এক দুর্গ, নাম গ্রিমাল্ডি দুর্গ। পিকাসো তখন পুরো সময়টি এখানে কাটিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে গ্রিমাল্ডি দুর্গে প্রতিষ্ঠা করা হয় পিকাসো জাদুঘর।
এ জাদুঘরে রাখা হয়েছে পিকাসো ও অন্যান্য শিল্পীর মোট ২৪৫টি শিল্পকর্ম। পিকাসোর শিল্পকর্ম নিয়ে এ জাদুঘরটি বিশ্বে প্রথম। সোমবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ছয় দিন দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। প্রবেশমূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৮ ইউরো। ঘুরেফিরে দেখতে সময় লাগবে কম করে এক ঘণ্টা। পিকাসো জাদুঘরে শিল্পীর জাদুকরি সৃষ্টি খুব কাছ থেকে দেখার এমন সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেই উচিত হবে না।
শহরের কেন্দ্র থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে সাগরের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ক্যাপ দ্য আনতিব, একটি উপদ্বীপ। হেঁটে যেতে না চাইলে শহর থেকে ২ নম্বর বাসে চড়ে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। অনেকেই এখানে আসেন ভূমধ্যসাগরের দিগন্তবিস্তৃত বিশাল সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।
অনেকে এখানে আসেন প্রাচীন স্থাপনা গারুপের বাতিঘর দেখার জন্য। বাতিঘরটি ১৮৩০ সালে নির্মাণ করা হয়। রাতের আঁধারে থেকে থেকে ১০ সেকেন্ড সময়ের জন্য জ্বলে ওঠে। ৬০ কিলোমিটার বা প্রায় ৪০ মাইল দূর থেকে নাবিকেরা দেখতে পায় তীব্র আলোকদ্যুতি। আড়াই টন ওজনের বিশাল বাতিটি খুব সহজেই ঘোরানো যায়। এই উপদ্বীপে আছে অরণ্য মতোন, নানা প্রজাতির গাছগাছালির মহিমাময় নির্জন রাজ্য।
প্রকৃতি আর মানুষ মিলে সৃষ্টি করা নিসর্গের স্বর্গরাজ্য আনতিব। এখানে এসেছিলেন শিল্পের অলৌকিক জগতের বরপুত্র পাবলো পিকাসো। আনতিবের নৈসর্গে মুগ্ধ হয়েছিলেন, রংতুলিতে মূর্ত করেছিলেন অবিস্মরণীয় সব মুহূর্ত।