গল্পের মতো ল্যাম্পপোস্টের রঙে ঝিলমিল করে কেম নদীর শান্ত জল
শেয়ার করুন
ফলো করুন

নদী দেখিয়া, মন প্রাণ উড়িয়া যায়,
এহেন সোনার নৌকা জলে ভাসিয়া যায়...

শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরি হাটে লক্ষণ দাস বাউল মাধুকরী করছেন। কণ্ঠে তাঁর নদীর গান, আর হাতে দোতারা। গোল হয়ে দর্শক পিনপতন নীরবতায় আস্বাদন করছেন সেই সংগীতমাধুরী। আমি কখনো শান্তিনিকেতনে যাইনি; সংগত কারণে এমন মনোগ্রাহী দৃশ্য সামনে বসে দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তবে শান্তিনিকেতনে না গেলেও আমি গিয়েছি জ্ঞানগরিমায় উদ্ভাসিত প্রাচ্যের শিক্ষাতীর্থ কেমব্রিজে। যেখানে পথের প্রতিটি ধুলায় স্মৃতি জড়িয়ে আছে স্যার আইজ্যাক নিউটন থেকে শুরু করে চার্লস ডারউইন, স্টিফেন হকিংস কিংবা ড্যাভিড অ্যাটেনবোরো।

অস্তগামী সূর্য রং ছড়াচ্ছে কেমের জলে
অস্তগামী সূর্য রং ছড়াচ্ছে কেমের জলে

কেমব্রিজ শহরের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় এক যুগ আগে হলেও সম্পর্কটা প্রগাঢ় হয় ২০১৫ সাল থেকে। অর্থাৎ, যখন থেকে আমার পিএইচডির জার্নিটা শুরু হয়। বেশির ভাগ সময় বাড়ি থেকে কাজ করতে হতো বলে অফিস আর রেলস্টেশন ছাড়া অন্য কোথাও ঠিক যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ফলে তেরো শ নদী বুকের ভেতরে রেখেও দেখা হয়নি ছিপছিপে শান্ত কেম নদীর সৌন্দর্য। অবশেষে ২০১৭ সালের কনকনে ঠান্ডার এক মেঘলা দুপুরে আমাদের দেখা হলো। আমি দাঁড়ালাম তাঁর মুখোমুখি। পাখির নীড়ের মতো মুখ তুলে সে বলল না, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ তবে তাঁর সৌন্দর্য অবগাহন করতে যদি হাজার মাইল পথ হাঁটতে হয় কিংবা ঘুরতে হয় বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে, তাতেও ক্ষতি নেই। তীব্র ঠান্ডায় জমে যাওয়া বিলাতি শৈতি দুপুরে কুইন্স কলেজের ঠিক পেছনে প্রায় তিন শ বছরের পুরোনো কাঠের তৈরি ম্যাথমেটিক্যাল ব্রিজের কাছে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলাম বহুক্ষণ। সেই থেকে শুরু।

বিজ্ঞাপন

আজও কাজের ব্যস্ততা আর ক্লান্তিকে নিমেষেই ভুলিয়ে দিতে টনিকের মতো কাজ করে নর্থ সিতে মিশে যাওয়া ৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই তন্বী শ্যামাঙ্গী নদী। বিস্তীর্ণ দুই পাড়জুড়ে প্রাচীন ভবনের প্রতিটি খোপে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, জ্ঞান আর সংস্কৃতির ছোঁয়া। নর্থ সি থেকে মাত্র ৬৪ কিলোমিটার দূরের কেমব্রিজ শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা থেকে জানা যায়, কেম নদীর জন্যই নাকি প্রাচীন অ্যাংলো-স্যাক্সন, রোমান ও ভাইকিংসদের কাছে কেমব্রিজ শহর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, ইংল্যান্ড আক্রমণ এবং শাসনের সময়ে নর্থ সি থেকে কেম নদী দিয়ে তারা সহজেই পণ্য আদান-প্রদান করতে পারত। আঠারো শতাব্দী পর্যন্ত ব্রিটেনে রেলওয়ে চালু হয়নি; ফলে সেই সময়ে কেমব্রিজ থেকে লন্ডনের সব ব্যবসায়িক যোগাযোগের জন্য কেম নদী ছিল একমাত্র উপায়।

কেমের পাড় থেকে অনতি দূরে বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজ
কেমের পাড় থেকে অনতি দূরে বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজ
কেমের বুকে চলছে নৌকা বাওয়া
কেমের বুকে চলছে নৌকা বাওয়া

দ্বিতীয়বার যখন কেম নদীর দেখা পাই, সেটা ছিল সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যা। সারা দিন ট্রেনিং শেষে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এসে দাঁড়ালাম বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজের সামনে। হ্যাঁ, সেই ট্রিনিটি কলেজ, যেখানে স্যার আইজ্যাক নিউটনের আপেলগাছ এখনো বেঁচে আছে বনসাই হয়ে। প্রচুর ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় ছিল, তবু অদ্ভুত এক সুন্দর গোধূলি দেখেছিলাম সেদিন। হাতের বাঁ দিকে কিংস কলেজ আর নদীর ঠিক ওপারে সেন্ট জোন্স কলেজ। মাঝখানে কেম নদী বইছে ধীর হাওয়ায়।

বিজ্ঞাপন

সেপ্টেম্বর হলেও সুন্দর আবহাওয়া ছিল সেদিন। সংগত কারণে প্রচুর পান্টিং হচ্ছিল নদীতে। পান্টিং হলো লম্বা ধাতব লগি দিয়ে কেম নদীতে নৌকা বাওয়া। তবে এর জন্য সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। মূলত এপ্রিল থেকে আবহাওয়া উষ্ণ হওয়া শুরু হলেই জমে উঠে এই পান্টিং ব্যবসা। মজার ব্যাপার হলো, অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজের মধ্যে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হয় প্রতিবছর এবং প্রায় প্রতিবার অলিম্পিকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এই দুই শহরের রোয়িং ক্লাবের সদস্যরা জয় করে আসেন স্বর্ণপদক।

কিংস কলেজে সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে কেম
কিংস কলেজে সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে কেম
শীতের তুষার পড়া দিনে কেমের ধারে লেখক
শীতের তুষার পড়া দিনে কেমের ধারে লেখক

এরপর কেটে গেছে বছর চারেক। এবারে কেম নদী আমার জীবনে এল নতুন করে। কারণ, চাকরির সুবাদে প্রায় ১৫ বছরের আবাসস্থল লন্ডন ছেড়ে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে কেমব্রিজে। শুরু হলো বাসা খোঁজার পালা। কিন্তু আমার নদীভাগ্য অসম্ভব রকমের ভালো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যে বাসস্থান পাওয়া গেল, সেখান থেকে হেঁটে কেম নদীর পাড়ে যেতে সময় লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট। তবে এদিকের কেম নদী খুব শান্ত, সেই সঙ্গে রয়েছে গভীর নীরবতা। কারণ, সব পর্যটকের মূল লক্ষ্য থাকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলো ভ্রমণ করা, সেই সঙ্গে কেম নদী। ফলে এদিকটা খুবই নীরব আর নদীর দুই পাশে সারি সারি বাঁধা নৌকা আর বিস্তীর্ণ পাড়জুড়ে মনের আনন্দে চারণ করা গরুর পাল।

বাংলাদেশের মানুষ আমি। গ্রাম ভালোবাসি। ভালোবাসি নদী। তাই সারা জীবন চেয়েছিলাম নদীর সংস্পর্শে থাকতে; কিন্তু এভাবে যে কেম নদী ধরা দেবে আমার জীবনে, সেটা ভাবিনি। এখন আমাদের প্রতিদিনই দেখা হয়। প্রতিদিনই অদ্ভুত আবেগে ভ্রমণ করে আসি আমার শৈশবের নদীগুলো। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে; গল্পের মতো ল্যাম্পপোস্টের রঙে ঝিলমিল করে কেম নদীর শান্ত জল।

কেমের আরেক পারে সেন্ট জন’স কলেজ
কেমের আরেক পারে সেন্ট জন’স কলেজ
যখন বসন্ত আসে
যখন বসন্ত আসে

প্রায়ই অফিসফেরত আমি সান্ধ্য আলোয় সুনসান গ্রিন ড্রাগন ব্রিজে বসে নিঃশব্দে ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে শুনি পাখিদের সিম্ফোনি, মগজে রণিত হয়:
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

লেখক: ড. অসীম চক্রবর্তী, গবেষক ও শিক্ষক, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড কম্পিউটিং, অ্যাঙ্গলিয়া রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন