আড়াই হাজার বছর পুরোনো এক শহর। এর ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর। এমন এক শান্ত সাগর, যার জলরাশিকে প্রবলভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে শোনা যায় না। ছোটবেলায় পড়েছি, পানির নাকি নিজস্ব রং নেই। সেই জানা এ সাগরের সামনে কিছু সময়ের জন্য নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে। কেননা, গাঢ় নীল জলরাশি যে এ সাগরের প্রাণ।
এমনিতে সাগরের তীরের জনপদে শীত খুব একটা তীব্র হয়ে ওঠে না। তাই এ জনপদে, সূর্য যখন মিষ্টি কিরণে ভরিয়ে দেয় চরাচর, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো তখনো শীতের তাণ্ডবে অনেকটা নুয়ে থাকে। পাহাড়ের গায়ে জমে থাকে ভেড়ার লোমের মতো সাদা তুষার। আর জনপদের মাঝখানে থাকা গির্জা দূরের পথিককে আহ্বান জানায় আতিথেয়তা গ্রহণের।
আমরা এসেছি বুদভা শহরে। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত প্রায় ৫ হাজার ৩৩৩ বর্গমাইলের ছোট দেশ মন্টেনিগ্রো। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে অবশ্য দেশটি এখনো সেভাবে পরিচিতি পায়নি। যদিও শেখ রাসেল ফুটবল ক্লাবের একসময়ের প্রধান কোচ ছিলেন দ্রাগান জুকানোভিচ; তিনি মন্টেনিগ্রোর নাগরিক।
সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে ইউরোপের কোনো দেশের চিত্র কেমন? হয়তো–বা এমন কোনো এক দেশ, যে দেশের আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে আছে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত উঁচু দালানকোঠা, যে দেশের সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া রয়েছে। আর এ দেশে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের সবার জীবনযাত্রাও চোখে পড়ার মতো। মার্সিডিজ, বিএমডব্লিইউ অথবা পেজোর মতো বিলাসবহুল গাড়িগুলো রাস্তাঘাট দাপিয়ে বেড়ায়। প্রাচুর্যের অভাব এ দেশে অনুপস্থিত, ইউরোপ সম্পর্কে যাঁরা এ ধরনের ধারণা পোষণ করেন, মন্টেনিগ্রো তাঁদের হতাশ করবে। আমিও ব্যতিক্রম নই। কেননা, এ দেশেতে উন্নত অবকাঠামো খুব একটা চোখে পড়ে না।
বিশ্বাস করা যায় ইউরোপের দেশ হয়েও এখানে কোনো হাইওয়ে নেই! দেশটির বেশির ভাগ রাস্তাঘাট গলির মতো সরু ও জীর্ণ। আর সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা তো আছেই। তারপরও দেশটির সাধারণ মানুষ এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন নন। তাঁরা নিজেদের পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ হিসেবে পরিচয় দেন। কায়িক পরিশ্রমে তাঁদের আগ্রহ দেখা যায় না। বরং ইউরোপে মন্টেনিগ্রোর অধিবাসীরা সবচেয়ে অলস জাতি হিসেবে সুবিদিত। দেশটিতে প্রতিবছর এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। অনেকে মজা করে এ প্রতিযোগিতার নাম দিয়েছেন ‘লেজি ম্যারাথন’। প্রতিযোগীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি সময় বিছানায় ঘুমিয়ে কাটাতে পারেন, তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
এ দেশের অর্থনীতি মূলত পর্যটননির্ভর। আর অ্যাড্রিয়াটিক সাগরই মন্টেনিগ্রোর পর্যটনশিল্পের প্রাণ।
বন্ধু মিলোসের ভাষায়, ‘প্রতিবেশী সার্বিয়ার মতো যদি আমরা একটি ল্যান্ড–লকড দেশ হতাম, তাহলে আমাদের দেশ হতো পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি।’
২০০৬ সালে সার্বিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মন্টেনিগ্রোর আত্মপ্রকাশ। একসময় বিশ্বরাজনীতিতে দাপট দেখানো যুগোস্লাভিয়ার কফিনে এভাবেই শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়। মিলোসের মতে, যুগোস্লাভিয়ার সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে ২০০৬ সালে স্বাধীনতার আগপর্যন্ত দেশটির জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জমা হতো।
এমনকি সার্বিয়ানরাও জলপথে আমদানি ও রপ্তানির জন্য এ সাগরের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু মন্টেনিগ্রোর অধিবাসীরা এককভাবে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের ওপর তাঁদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চান। এ কারণে শেষ পর্যন্ত মন্টেনিগ্রো ২০০৬ সালে সার্বিয়া থেকে আলাদা হয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। তা সত্ত্বেও দেশটির সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ নিজেদের মন্টেনিগ্রিন হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পরিবর্তে যুগোস্লাভিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এ কারণে মন্টেনিগ্রোর বিভিন্ন স্থানে আজও যুগোস্লাভিয়ার পতাকা ঝুলতে দেখা যায়।
যুগোস্লাভিয়ার প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটো আজও দেশটির অনেক মানুষের কাছে ভালোবাসার আরেক নাম। মিলোসের বাবা ঠিক তেমনই একজন। নিজের মানিব্যাগে আজও তিনি টিটোর ছবি রাখেন। সৃষ্টিকর্তার পর যাঁকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, তিনি হচ্ছেন মার্শাল টিটো।
এমনিতে সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রো উভয় দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে খুব একটা অমিল নেই। দুই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান এবং দুই দেশের ভাষা প্রায় কাছাকাছি। একসময় বলা হতো, যেসব সার্বিয়ানের বসবাস অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের তীরে, তাঁরাই হচ্ছেন মন্টেনিগ্রিন। সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রো দুই দেশের মানুষেরা একে অন্যকে ভ্রাতৃপ্রতিম মনে করতেন। বর্তমানে দেশটিতে ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ ও কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক আদর্শের উত্থান সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রোর মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি করেছে। তাই বর্তমান প্রজন্মের অনেকে এসব বিষয়কে স্বীকার করতে চান না।
মিলোস, আমার আরেক বন্ধু ফেজা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণে মন্টেনিগ্রোতে ঘুরতে যাওয়া। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত যেকোনো দেশের ভিসা বা রেসিডেন্ট পারমিট থাকলে মন্টেনিগ্রোতে ভ্রমণের জন্য আলাদাভাবে ভিসার প্রয়োজন হয় না। কেবল দেশটিতে প্রবেশের সময় ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্টে একটি অ্যারাইভাল সিল দিয়ে থাকেন। তবে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো মন্টেনিগ্রোতে ভ্রমণ করা খুব একটা সহজ নয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশের রাজধানী শহরের সঙ্গে মন্টেনিগ্রোর রাজধানী পোদগোরিসার সেভাবে বাস–সংযোগ নেই। আবার সচরাচর দেশটিতে সহজে পৌঁছানোর জন্য বাজেট–ফ্লাইটও খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রথম যেদিন পোদগোরিসায় পা রাখি, কেন জানি নিজের মধ্যে আলাদা অনুভূতি কাজ করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, এ কোথায় এসে পড়লাম? কোনোভাবে পোদগোরিসাকে ইউরোপের কোনো একটি দেশের রাজধানী শহর বলে মনে হচ্ছিল না। রুগ্ন অবকাঠামো ও ফিকে হয়ে যাওয়া যুগোস্লাভিয়ান আমলের ঘরবাড়ি দেখে মনে হচ্ছিল, পোদগোরিসা কি আসলে ইউরোপের কোনো শহর? নাকি উন্নয়নশীল কোনো দেশের মফস্সল শহর এটি? তবে বুদভার চেহারা একেবারে আলাদা। অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের তীরে অবস্থিত পাঁচটি শহর কোটর, বুদভা, পেরাস্ট, টিভাট ও হেরচেগ নোভির ওপর ভিত্তি করে দেশটির পর্যটন খাত দাঁড়িয়ে আছে। টিভাট মন্টেনিগ্রোর বন্দরনগরী। অন্যদিকে কোটর, বুদভা, পেরাস্ট ও হেরচেগ নোভি মূলত ডালমাশিয়ান স্থাপত্যশৈলীর আদলে গড়ে ওঠা শহর। এ কারণে এ চারটি শহর দেখতে একই রকম মনে হয়। তবে আমার কাছে এ চারটি শহরের মধ্যে বুদভাকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের অনেকেই প্রায়ই বলে থাকেন, দেশটির আবহাওয়া সম্পর্কে আগের থেকে কোনো কিছু অনুমান করা যায় না। মুহূর্তের মধ্যে নাকি দেশটির আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়। যুক্তরাজ্যে ঘুরতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি এখনো, তবে মন্টেনিগ্রোতে পা রাখার পর দেশটির আবহাওয়াকে আমার কাছে একেবারে আনপ্রেডিক্টেবল মনে হয়েছে।
পোদগোরিসা থেকে মিলোসের সঙ্গে বুদভার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর সময় বাইরের আবহাওয়া ছিল বেশ ঠান্ডা। আকাশ ছিল মেঘাছন্ন এবং বৃষ্টির আভাস স্পষ্ট হচ্ছিল। অথচ পোদগোরিসা পার হতে না হতেই দেখি বাইরের রাস্তা ঘন তুষারে আবৃত। আকাশ ভেঙে তুষার ঝরছে। মিলোসের গাড়ির গায়ে এ তুষার আঘাত করছে। চারদিক অন্ধকার, ঘড়িতে তখন প্রায় দশটা বাজে; অথচ বাইরের দিকে তাকিয়ে সেটা বোঝার উপায় নেই। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। হঠাৎ মিলোস এক জায়গায় এসে গাড়ি থামিয়ে আমাকে গাড়ির জানালা থেকে বাইরের তাকাতে বলল। আমি রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেলাম। পাহাড়ের পাদদেশে তুষারের ছিটেফোঁটা বলে কিছুই নেই। ও পাশে সূর্যের কিরণ স্পষ্ট। সাগরের নীল জলরাশি আর তীরের বালুকণায় সূর্যরশ্মি পড়ে চকচক করছে। পাহাড়ের ওপর থেকে ডালমাশিয়া স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত ঈষৎ হলুদ রঙের বাড়িগুলো অসাধারণ লাগছিল। দূর থেকেও দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল লাল টালির ছাদ। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া দৃশ্য!
পোদগোরিসার সঙ্গে মন্টেনিগ্রোর এ অংশের পার্থক্য সুস্পষ্ট; মনে হয় একই দেশের দুটি আলাদা রাজ্য। একটি অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও জৌলুশময়; অন্যটি অসচ্ছল ও হতশ্রী।
সাগরের তীরে বহুতল হোটেলেরও দেখা পেলাম যেগুলো চার বা পাঁচ তারকা মানের। মিলোস বলল, ‘ওইটা হচ্ছে বুদভা, আমরা এখন সেখানে যাচ্ছি।’
মিলোসকে বললাম, ‘পোদগোরিসা তোমাদের দেশের রাজধানী, অথচ দেখলে মনে হয় না যে এ রকম একটা শহর রাজধানী হতে পারে। তার চেয়ে আমাদের ঢাকা শহরও অনেক সময় বেশি স্বাস্থ্যবান কিন্তু বুদভার চেহারা একেবারে আলাদা কেন?’
মিলোস আমার প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ হাসল। তারপর উত্তর ফিরিয়ে দিল, ‘সাগর আছে বলে আমরা বেঁচে আছি। পোদগোরিসায় খুব একটা পর্যটক বেড়াতে আসেন না; কিন্তু এপ্রিল থেকে শুরু করে আগস্ট পর্যন্ত কোটর, বুদভা, পেরাস্ট, টিভাট ও হেরচেগ নোভি পর্যটকদের ভিড়ে মুখর হয়ে থাকে। পর্যটকদের কারণে আমাদের দেশের অর্থনীতি এখনো কোনোভাবে শ্বাস নিতে পারছে। আর এ কারণে সরকার সাগরের তীরবর্তী অংশের অবকাঠামোকে ঢেলে সাজানোর জন্য প্রতিবছর প্রচুর ইউরো খরচ করে। অথচ পোদগোরিসা বা অন্যান্য অংশের উন্নয়নে আমাদের কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।’
মিলোসকে গাড়ি থামাতে বললাম। মিলোসের সঙ্গ তার প্রেমিকা বারবারাও সেদিন আমাকে সঙ্গ দিয়েছিল। কিছু ছবি তুললাম। এরপর আবারও আমাদের গাড়ি ছুটে চলল বুদভার দিকে। সত্যি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে আসার পর এটা বোঝার কোনো উপায় ছিল না যে পাহাড়ের ওপরটা অন্ধকার আর পুরু তুষারে ঢেকে আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, বুদভা ও টিভাট পার হয়ে আমরা যখন কোটরের দিকে রওনা দিই, তখন আরও একবার আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষ করি। ঠান্ডা ঝোড়ো বাতাস এবং সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। হয়তো–বা এ কারণে বুদভা যতটা সুন্দর রূপে আমার চোখে ধরা দেয়; কোটর, পেরাস্ট আর হেরচেগ নোভি আমার কাছে ঠিক ততটা আকর্ষণীয় রূপে আবির্ভূত হতে পারেনি; যদিও চারটি শহর বাহ্যিক দৃষ্টিতে প্রায় একই রকম।
মিলোসও জানাল যে কোটর, পেরাস্ট আর হেরচেগ নোভি তাকে বুদভার মতো সেভাবে টানে না। বুদভার সৈকতে তুলনামূলকভাবে নাকি বালুর পরিমাণ বেশি, এ ছাড়া মন্টেনিগ্রোর অন্যান্য সমুদ্রসৈকতের তুলনায় বুদভার সৈকত পরিচ্ছন্ন। এসব কারণে গ্রীষ্মের দিন মিলোস প্রায়সময় গোসলের জন্য সেখানে ছুটে যায়। এ ছাড়া এখানকার নাইটলাইফও নাকি বেশ আকর্ষণীয়। তাই পার্টি বা কনসার্টের জন্য মন্টেনিগ্রোতে বুদভার চেয়ে ভালো জায়গা হয় না। গ্রীষ্মের দিন বুদভায় এত বেশি মানুষ জড়ো হয় যে তিলধারণের ঠাঁই খুঁজে পাওয়া যায় না। মন্টেনিগ্রোর স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে অবকাশযাপনের জন্য বুদভা তাই সব সময় এক নম্বরে থাকে। অন্যদিকে কোটরে স্থানীয় অধিবাসীদের তুলনায় বিদেশি পর্যটকদের সমাগম বেশি থাকে।
মিলোস ও তার প্রেমিকা বারবারার সঙ্গে বুদভার ওল্ড টাউনের পথ ধরে হাঁটতে থাকি। পুরাতনের প্রতি আমার আগ্রহ সব সময়, কেননা ঐতিহ্যের আলাদা একটি ঘ্রাণ থাকে, যা সব সময় আমাকে আকর্ষণ করে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, অতীতের দিনগুলো বোধ হয় আজকের দিনের তুলনায় অধিক ভালো ছিল। বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সঙ্গে প্রযুক্তির ওপর আমাদের নির্ভরতা বেড়েছে, তবে আমাদের আবেগ অনেকটা কমে গেছে।
আয়তনে বুদভার ওল্ড টাউনকে খুব বড় বলা যাবে না। ওল্ড টাউনের প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে ভেতরের ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট সবকিছুই পাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হয়েছে। এ যেন পৃথিবীর ভেতর আরেকটি পৃথিবী, যা পাথর কেটে তৈরি হয়েছে। ওল্ড টাউনের ভেতর বেশির ভাগ ঘরবাড়ি বর্তমানে স্যুভেনিরের দোকান অথবা রেস্টুরেন্ট কিংবা পানশালা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মিলোস জানাল যে গরমের দিনে আশপাশের পরিবেশ প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও ওল্ড টাউনের ভেতরের অংশ নাকি সব সময় ঠান্ডা থাকে। ছোট পরিসরে গড়ে ওঠা এ টাউনের ভেতর কয়েকটি গির্জার দেখা পেলাম। এদের মধ্যে একটি গির্জা মন্টেনিগ্রোর অন্যান্য গির্জা থেকে একেবারে আলাদা।
জানা গেল, এ গির্জাকে ঘিরে বুদভার ওল্ড টাউনটিকে আজকের রূপে গড়ে তোলা হয়েছে। স্থানীয় লোকজন এ গির্জার নাম দিয়েছেন সেন্ট ইভান চার্চ। তিন টায়ারের ব্যাসিলিকাবিশিষ্ট এ গির্জায় গোথিক ছাপ সুস্পষ্ট। গির্জার মিনারটি বেশ সরু ও উঁচু, তাই অনেক দূর থেকে এটি চোখে পড়ে। মিনারের গায়ে লাগানো ঘণ্টাটি কখনো নজর এড়ায় না। ওপরের পাহাড় থেকেও আমরা গির্জাটিকে দেখতে পাচ্ছিলাম। সাধারণত ক্যাথলিক গির্জাগুলো এ ধরনের স্থাপত্যশৈলীর আদলে গড়ে তোলা হয়। মিলোসকে জিজ্ঞেস করলাম, মন্টেনিগ্রোর বেশির ভাগ মানুষ খ্রিষ্টান এবং তাঁরা অর্থোডক্স গির্জার অনুসারী, কিন্তু বুদভার ওল্ড টাউনের এই গির্জা একেবারে আলাদা। ক্যাথলিক গির্জার মতো। আসলে ওল্ড টাউনের প্রাণকেন্দ্রে অনুমানিক ১২০০ সালের দিকে বুদভাসহ পুরো ডালমাশিয়া অঞ্চলে ভেনেশিয়ানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় ইতালির ভেনিস থেকে এ অঞ্চলের শাসনকাজ পরিচালনা করা হতো। ভেনেশিয়ানরা খ্রিষ্টান হলেও তাঁরা ছিলেন ক্যাথলিক গির্জার অনুসারী। প্রায় ৪০০ বছর ভেনেশিয়ানরা বুদভা শাসন করেছেন।
এ ক্যাথলিক গির্জা তাঁদের হাত ধরে গড়ে উঠেছে। একই কারণে মন্টেনিগ্রোর বেশির ভাগ মানুষ অর্থোডক্স খ্রিষ্টান হলেও অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের তীরবর্তী জনপদগুলোয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের বসবাস। তবে সেন্ট ইভান গির্জার পাশে হলি ট্রিনিটি চার্চ নামে একটি অর্থোডক্স গির্জা রয়েছে। যাঁরা ইস্তাম্বুলে বেড়াতে গেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই হায়া সোফিয়ার সঙ্গে পরিচিত। হায়া সোফিয়া বাইজেনটাইন শাসনামলের স্থাপত্যকলার প্রতিনিধিত্ব করে। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অর্থোডক্স খ্রিশ্চিয়ানিটির বিস্তৃতি ঘটেছে বাইজেনটাইন শাসকদের মাধমে। এ কারণে অর্থোডক্স গির্জাগুলোর সঙ্গে হায়া সোফিয়ার স্থাপত্যশৈলীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
বুদভার ওল্ড টাউন আমার অন্তরে বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি করেছে, তাই বিদায়ের সময় বেশ খারাপ লাগছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, যদি একটি রাত সেখানে কাটাতে পারতাম। মিলোস বলল, ‘চলো, তোমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাই যেখানে গেলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। আর তুমিও বারবার ছবি তুলতে চাইবে।’
ওল্ড টাউন থেকে বের হয়ে কয়েক গজ হাঁটলে একটি ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। মিলোস ও তার প্রেমিকা বারবারা আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। বুদভার সবচেয়ে সুন্দর রূপটি যেন সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের গাঢ় নীল জলরাশি, সেই সঙ্গে পাথর কেটে তৈরি করা ওল্ড টাউন আর বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু পাহাড়গুলো একীভূত হয়ে অনন্য রূপে ধরা দিচ্ছিল। সেই সেন্ট ইভান গির্জা এখানেও হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকছে।
শুরুতে যেটা বলেছিলাম, শীতের দিন হওয়ায় পুরো পাহাড় তুষারে ঢেকে ছিল। দূরের পাহাড় তুষারে ছেয়ে থাকলেও বুদভার মিষ্টি রোদে কোনো ধরনের ভারী পোশাক ছাড়া অনায়াসে চলা যায়। তুলার মতো সাদা তুষার বুদভার এ রূপের সঙ্গে আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল। কোনোভাবে লিখে সে সৌন্দর্যকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আসলে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মানবসৃষ্ট সৌন্দর্য একবিন্দুতে একত্র হয় এই বুদভাতেই। আর এমন একটা জায়গায় ছবি তোলা হবে না, তা কি হয়!
বিখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন মন্টেনিগ্রোকে ‘স্থল ও সাগরের অপূর্বতম মেলবন্ধন’ আখ্যা দিয়েছিলেন। বুদভায় বেড়াতে না এলে বিষয়টি কোনো দিনও অনুধাবন করা হতো না।
লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।