এল্লা থেকে ইয়ালা, পাহাড় থেকে সমুদ্রে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

এল্লাকে আমাদের ট্যুরের শেষ পাহাড়ি শহর বলা যায়। বাদুল্লা ডিস্ট্রিক্টের ছোট্ট এই শহর আমাদের শ্রীলঙ্কায় পাহাড় দর্শনের শেষ দিন। এই দিনের পরিকল্পনাটা একটু জটিলই ছিল। ভোরে সূর্যোদয় দেখতে লিটল এডামস পিক, এরপর বিখ্যাত নাইন আর্চ ব্রিজ। সবশেষে রাভানা ফলস দেখে দুই-আড়াই ঘণ্টা ড্রাইভ করে আমরা চলে যাব আরেক শহর ইয়ালাতে।

নাইন আর্চ ব্রিজ যাওয়ার পথে, পাইন বনে
নাইন আর্চ ব্রিজ যাওয়ার পথে, পাইন বনে

বেলা দুইটার আগেই সেখানে পৌঁছানোর টার্গেট আমাদের। শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় আর বিখ্যাত সাফারি পার্ক ইয়ালা সাফারিটাও এই দিনেই দেখার পরিকল্পনা। দিলশান আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিল, সময়মতো সবকিছু শেষ করার বিকল্প নেই। আমরাও মনে মনে সেভাবেই তৈরি হয়ে নিলাম।

বিজ্ঞাপন

ভোর পাঁচটায় উঠে তৈরি হলাম লিটল এডামস পিক থেকে সূর্যোদয় দেখার জন্য। দিলশানও পৌঁছে গেছে সময়মতো। লিটল এডামস পিকের চূড়ায় ওঠার জন্য আমাদের যেখানে নামতে হবে, সেই জায়গাটা আমাদের হোমস্টে থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। চা–বাগানের রাস্তা ধরে হিম হিম ঠান্ডায় হাঁটছি। গুগল ম্যাপ বলছে, হাঁটতে হবে প্রায় ২০ মিনিটের মতো। তেমন কোনো উঁচু–নিচু ছাড়াই প্রথম ১০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম পাহাড়চূড়ার নিচে।

লিটল এডামস পিকের অন্য দিক থেকে সূর্যোদয় দেখা
লিটল এডামস পিকের অন্য দিক থেকে সূর্যোদয় দেখা

এরপর সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠলেই সোজা চূড়ায়। ধীরে ধীরে এগোলাম দুজনে। আমরা উঠতে উঠতেই সুয্যি মামাও একটু একটু করে দেখা দিতে থাকল। লাল টুকটুকে সূর্যটা তাপ আর কিরণ—দুটোই ছড়াতে লাগল পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। সকালের মিষ্টি রোদে আমরাও দেখলাম মেঘ-পাহাড়ের লুকোচুরি। আমাদের মতো আশপাশে অনেকেই এসেছেন সুন্দর এই সকালটা উপভোগ করতে। পোল্যান্ডের এক ছেলের সঙ্গে বেশ গল্প জমলো আমাদের। সেই একসঙ্গে দুজনের ছবি তুলে দিল সুন্দর এই জায়গাটায়। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে নিজেদের ভালো লাগার সেই গল্পগুলো জমা রেখে ফিরে এলাম হোটেলে। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে আটটা।

বিজ্ঞাপন

যদিও দিলশান আমাদের বলে দিল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে রেডি থাকার কথা। তখনো আমাদের নাইন আর্চ ব্রিজ দেখা বাকি। আগের দিনই জেনে নিয়েছিলাম, সকাল সাড়ে নয়টার দিকে নাইন আর্চ ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন যায়। সেই ট্রেনসহ ব্রিজটা দেখার লোভ ছিল সব সময়। তাই নাশতা সেরে দ্রুত রেডি হয়ে গেলাম। আমাদের হোটেল থেকে নাইন আর্চ ব্রিজ হাঁটার দূরত্বে মাত্র ১৫ মিনিটের পথ। অটোতেও যাওয়া যায়, কিন্তু আমাদের পছন্দ ছিল হেঁটেই যাওয়া। যেই ভাবা, সেই কাজ। হোটেল থেকে বেরিয়েই নাইন আর্চ ব্রিজের ডিরেকশন সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। সেই পথ ধরে একটু সামনে যেতেই দেখি, বেশ ঘন পাইন বনের মধ্য দিয়ে রাস্তা চলে গেছে।

নাইন আর্চ ব্রিজে ট্রেন
নাইন আর্চ ব্রিজে ট্রেন
নাইন আর্চ ব্রিজের সামনে ওরা দুজন
নাইন আর্চ ব্রিজের সামনে ওরা দুজন

হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নেওয়ার জন্য নিজেরাই নিজেদেরকে মনে মনে সাধুবাদ জানালাম। কী সুন্দর রাস্তা! কখনো কখনো মনে হচ্ছিল, পথ হারালেও ভয় নেই, এই পথ দিয়েই অনন্তকাল হেঁটে যাওয়া যাবে! তবে অনন্তকাল হাঁটা লাগেনি একদমই। ১৫ মিনিট হাঁটার পরই দেখতে পেলাম সেই বিখ্যাত নাইন আর্চ ব্রিজ। দুটো পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বিশাল এই ব্রিজ চলে গেছে। উপনিবেশ যুগের এই নির্মাণ দেখে সতিই মুগ্ধ হতে হয়। এল্লা থেকে দেমোদারা রেলওয়ে স্টেশনে যাওয়ার পথেই এই ব্রিজ পার হতে হয়। চারপাশ থেকে যেভাবেই দেখা যায়, সবদিক থেকেই দারুণ সৌন্দর্য মোহিত করতে বাধ্য সবাইকে। ট্রেন যাওয়া দেখা আর চারপাশে ছবি তোলা শেষ করেই আবার জঙ্গলের মধ্য দিয়েই ফেরার পথ ধরলাম।

সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা, সময়টা কেটে গেল খুব দ্রুত। নাইন আর্চ ব্রিজ থেকে ফিরে এসে ব্যাগ গোছালাম, গোসল সারলাম, হোমস্টের হোস্টের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। ছোট্ট সুন্দর বাসাটাকে বিদায় জানাতে কষ্ট হচ্ছিল বেশ, কিন্তু কিছু করার নেই!

নাইন আর্চ ব্রিজের টানেলে
নাইন আর্চ ব্রিজের টানেলে

আবারও শুরু হলো আমাদের পথের গল্প। গন্তব্য প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টার পথ, ইয়ালা। যদিও এল্লায় মিনিট পাঁচেকের বিরতি নিয়ে দেখে এসেছিলাম রাভানা ফলস, কিন্তু খুব বেশি ভিড় থাকায় সেই বিরতি দীর্ঘ হয়নি তেমন।

এল্লার পাহাড়ঘেরা শহর পেরিয়ে আমরা ফিরে এলাম সমতলে। সারা দিনের তাড়াহুড়া শেষে গাড়িতে বেশ খানিকক্ষণ ঘুমিয়েই ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে চারপাশ দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে পাহাড়ের রাজ্য অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। যাক, পরের অ্যাডভেঞ্চারের জন্য ঘুমটুম দিয়ে একেবারে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দিলশান নিজেও সাফারি ড্রাইভার, সেই সুবাদেই আমাদের জন্য আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল সবকিছুই।

পেছনে লিটল এডামস পিক
পেছনে লিটল এডামস পিক

ইয়ালা পৌঁছাতেই আমরা আমাদের লাল টুকটুকে গাড়ি ছেড়ে উঠলাম সাফারির জিপে। সকাল সকাল পাহাড় দেখে ইয়ালাতে এসে মনে হচ্ছিল, অন্য এক জগতে চলে এসেছি আমরা। চারদিকে পাথুরে সাম্রাজ্য, বনাঞ্চল মিলে আগের পাঁচ দিনের চেয়ে একদম আলাদা এক দুনিয়া যেন!

টিকিট কেটে সাফারির গেট ধরে ঢুকতেই প্রথম দেখা হাতির পালের সঙ্গে। মা হাতি, বাচ্চা হাতি সেই সঙ্গে তাদের পরিবার। সাফারির ড্রাইভার নিজেই গাইড হিসেবে আমাদের সব ব্যাখা দিচ্ছিলেন। এত দিনের অভিজ্ঞতায় তাঁরা এটাও বুঝে গেছেন, কখন বড় হাতির পাল দেখা যাবে, কখন দেখা যাবে না। তাই আমরা এগোতে বললেও তিনি জানালেন, আরও হাতি আসবে, তাই অপেক্ষা করছেন তিনি।

ইয়ালা সাফারীর পথে
ইয়ালা সাফারীর পথে

এরপর সামনে এগোতেই একে একে জলহস্তী, জংলি ষাঁড়, হরিণ, অসংখ্য ময়ূর আর নাম না জানা অনেক পাখি দেখলাম। গাড়ি একটু এগোতেই দেখি, আমাদের ঠিক সামনে রাস্তা কাঁপিয়ে হেঁটে আসছে আরেক হাতি। তাকে রাস্তা ছেড়ে দিতেই আমরা পেছাতে থাকলাম গাড়ি নিয়ে। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি! পেছাতে পেছাতে এক পুকুরের সামনে আসার পর বুঝতে পারলাম, হাতিটা আসলে পানি খাওয়ার জন্যই হেঁটে এদিকে আসছিল।

বেশ খানিকক্ষণ বিশাল এই হাতির কার্যক্রম দেখে সামনে এগোলাম আমরা। একে একে কুমির, খরগোশ, আরও হাতি আর নানা রকমের পাখি দেখেই কাটিয়ে দিচ্ছিলাম সময়। সেই সঙ্গে দূর সমুদ্রের দিকেও চোখ যাচ্ছিল বারবার, যেটা সাফারি থেকেই দেখা যায়। ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করছিলাম আর জিজ্ঞাসা করছিলাম, চিতা দেখার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। তিনি জানালেন, ভাগ্য ভালো হলে দেখা মিলতে পারে আবার না–ও মিলতে পারে। এই বিষয়ের সত্যিই আগে থেকে কিছু বলা যায় না। এ কথা বলতে বলতেই আমরা দেখলাম ড্রাইভার কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছেন। কথা শেষ না হতেও গাড়ি ছুটল তীব্র গতিতে। কারণ, বোঝার আগেই একটা জায়গায় থামল গাড়ি।

চারপাশে আরও অনেক জিপের জটলা। সবার আগ্রহে বোঝা গেল, চিতার দেখা মিলেছে। সবার হইহুল্লোড়ে কিছুটা দেখতে পেলেও ছবি তোলার সুযোগ পেলাম না তখন। তবে নিজ চোখে দেখলাম, রাস্তা দিয়ে বনের রাজার বীরদর্পে হেঁটে যাওয়া। ছবি তোলার আফসোস করতে করতেই আমাদের ড্রাইভার জানালেন, অন্য একদিকেও নাকি দেখা মিলছে চিতার। ড্রাইভার আমাদের সেদিকে নিয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গেই।

চিতার খবর পেয়ে ইতিমধ্যে সেখানে শুরু হয়ে গেছে ট্রাফিক জ্যাম। সাফারি কর্তৃপক্ষ এসে একেকটা জিপকে নির্দিষ্ট সময় ধরে চিতা দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। এইবার ছবি তোলা হলো। গাছের ফাঁকে বসে থাকা চিতাকেও দেখে নিলাম আমরা। এত সব এক্সাইটমেন্টের মধ্যে কখন সময় পেরিয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি।

সন্ধ্যের লাল আভা চারদিকে দেখতে দেখতে আমরা ফিরলাম সাফারি পার্ক থেকে। এই কদিনের দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের পর বাকি দুটো দিন সমুদ্রের পাশে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। দিলশানও হাইওয়ে ধরে আমাদের রাত ৯টার দিকে পৌঁছে দিলো দক্ষিণের শহর মিরিশ্যার ওয়েলিগামা বিচে। সেই দুই দিনের গল্প থাকবে পরের পর্বে!

ছবি: সাখাওয়াত হোসেন সাফাত

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯: ৩৮
বিজ্ঞাপন