নুয়েরা এলিয়া থেকে ট্রেনে চেপে এল্লা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

সকাল সকাল নাশতা করে রোদ পোহালাম কিছুক্ষণ। এরপর বিদায়ের পালা। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার পরিচয়ে শর্মিলা আন্টি এত আপন হয়ে গেলেন যে ভাবাই যায় না। তাই বিদায় নিতে একটু কষ্টই হচ্ছিল। কিন্তু কী আর করা! আমাদের সেদিনের পরিকল্পনা ছিল নুয়েরা এলিয়ার বিখ্যাত গ্রেগরি লেক আর ফ্রুট মার্কেট ঘুরে দেখা। এর পরের গন্তব্য আর ট্রিপের অন্যতম হাইলাইট ছিল নানু ওয়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরা, আর সাউথ এশিয়া তথা পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর রেললাইন ধরে শ্রীলঙ্কার আরেক শহর এল্লায় পৌঁছানো।

গ্রেগরী লেকের চারপাশ
গ্রেগরী লেকের চারপাশ

সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যেই দিলশান আমাদের গ্রেগরি লেকের সামনে নামিয়ে দিল। গেগরি লেককে বলা হয় নুয়েরা এলিয়ার কেন্দ্রবিন্দু। বলা যায়, গ্রেগরি লেককে ঘিরেই গড়ে উঠেছে চারপাশের চা–বাগান আর বসতি। লেককে ঘিরে রয়েছে সুন্দর পার্ক, যেখানে কেউ হাঁটছেন, কেউ আবার সাইকেল চালাচ্ছেন। লেকে স্পিডবোট বা প্যাডেল বোটে করে ঘোরার ব্যবস্থাও আছে। দিলশান আমাদের সময় দিয়েছিল প্রায় দুই ঘণ্টার মতো। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, হেঁটেই ঘুরে দেখব লেকের চারপাশ।

বিজ্ঞাপন

লেকের একপাশ থেকে ঠিক উল্টো দিকের একটা গাছ নজর কাড়ে আমাদের। গাছের নিচে ছোট ছোট হলুদ ফুল আর চারপাশটা একদমই জনমানবহীন। জায়গাটা এত টানছিল যে প্রায় ৪০ মিনিট হেঁটে আমরা গেলাম সেই গাছটার কাছে। গাছের ছায়া, শীতের হালকা হাওয়া আর নরম রোদের মিশেলে বাকি সময়টা সেখানে বসেই কাটালাম। কড়া শীতের আগে এই সময়টা হয়তো নুয়েরা এলিয়াবাসীর খুব পছন্দের। তাই একদল কনসার্ট আয়োজককে দেখলাম কনসার্টের জন্য মঞ্চ তৈরি করছে। বাবা-ছেলে-মেয়ে মিলে সাইকেল চালাচ্ছে, শেখানোও চলছে। সব দেখতে দেখতে দুই ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা ফিরলাম গাড়ির কাছে।

গ্রেগরী লেকের ধারে সেই গাছতলায় শুয়ে লেখক
গ্রেগরী লেকের ধারে সেই গাছতলায় শুয়ে লেখক

নুয়েরা এলিয়াকে চায়ের শহর বলার পাশাপাশি ফলেরও স্বর্গরাজ্য বলা চলে। আমাদের ফলপ্রীতি থাকায় দিলশান আগেই আমাদের বলে রেখেছিল নুয়েরা এলিয়ার ফ্রুট মার্কেটে নিয়ে যাবে। কোকোয়া, প্যাশন ফ্রুট, টক পেয়ারা, স্ট্রবেরির—সব ফলের এমন বাহার দেখে অবাক হয়েছি। জীবনে প্রথম প্যাশন ফ্রুট, সাওয়ার সোপ (অনেকটা আতার মতো স্বাদের এক ফল), কোকোয়া খেয়েছি বেশ তৃপ্তি করে। সঙ্গে দেশের জন্য কিনেছি তাজা স্ট্রবেরি জ্যাম।

বিজ্ঞাপন

কেনাকাটা শেষে মায়াবী এই শহরটাকে বিদায় জানাই আমরা। নুয়েরা এলিয়াকে পেছনে ফেলে গাড়ি ছুটে চলে নানু ওয়া স্টেশনের দিকে। চা-বাগানঘেরা শহরটা মনের মধ্যে জায়গা করে নেয় শ্রীলঙ্কার বাকি শহরগুলোর মতোই। নানু ওয়া স্টেশন নুয়েরা এলিয়া থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ট্রেনের সময় দেওয়া দুপুর ২.৩০ মিনিট। আমাদের হাতে বেশ কিছুক্ষণ সময় ছিল। তাই ঘুরে দেখলাম নানু ওয়া ওয়াটারফল আর সেন্ট ক্লেয়ার ফলস। যদিও দুটি ঝরনাই ট্রেন থেকে দেখা যায়, তবু আমরা কাছ থেকেই দেখে নিই নানু ওয়া ফলস। অবশ্য সেইন্ট ক্লেয়ার ফলস কাছ থেকে দেখার উপায় নেই, তাই দূর থেকেই দেখে আর ছবি তুলে সন্তুষ্ট থাকি। এরপর সময়ের আগেই ফিরে আসি স্টেশনে।

নুয়েরা এলিয়া রেলওয়ে স্টেশন
নুয়েরা এলিয়া রেলওয়ে স্টেশন

দিলশান আমাদের টিকিটের ব্যবস্থা করে রেখেছিল আগেই। আমাদের হাতে টিকিট দিয়ে সে গাড়ি নিয়েই চলে যাবে এল্লায়। আবার এল্লা স্টেশন থেকেই আমাদের পিক করবে। দিলশানকে বিদায় দিয়ে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি ট্রেনের। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকদের। সবাই এই বিখ্যাত ট্রেন ভ্রমণের অংশ হতে চান। শ্রীলংকায় এসে এই ট্রেনযাত্রা না করলে পুরো ভ্রমণের বারো আনা বৃথাই বলা চলে।

ছোট্ট, ছিমছাম স্টেশন নানু ওয়া। বছরের বেশির ভাগ সময় পর্যটকের আনাগোনায় মুখর থাকে। যাহোক, সময় হলো ঠিকই, কিন্তু ট্রেনের দেখা নেই। সবার অধীর আগ্রহ, কখন আসবে ট্রেন। দুই ঘণ্টা পার হয়ে বিকেল সাড়ে চারটায় আমরা পেলাম ট্রেনের দেখা। ছোট্ট নীলরঙা ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টের যাত্রী আমরা। কারণ একটাই, সেকেন্ড ক্লাসের বগিগুলোতে আপনি ইচ্ছেমতো জানালা খুলে উপভোগ করতে পারবেন চারদিকের সৌন্দর্য, যেটা ফার্স্ট ক্লাসের কাচেঢাকা এসি বগিতে সম্ভব নয়। প্রায় সব পর্যটকই তাই পছন্দ করেন সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টগুলো।

বিখ্যাত সেই ট্রেন জার্নি
বিখ্যাত সেই ট্রেন জার্নি

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ট্রেন ছাড়ল। সিটে বসে থিতু হওয়ার আগেই দেখি, চারপাশে চক্ষু ছানাবড়া করা সৌন্দর্য! কখনো পাহাড়, কখনো ঝরনা, কখনো বা ঘন জঙ্গল! এসব দেখতে দেখতে মনে হলো, আমরা হয়তো কোনো স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করছি। চার ঘণ্টার এই যাত্রায় প্রথম দুই ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতে হবে ডানে, সেদিকটাই বেশি সুন্দর। আর পরের দুই ঘণ্টা বাঁ দিকে। চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বারবার মনে হচ্ছিল, এদিকে দেখলে ওই দিকে কিছু একটা বাদ পড়ে যাচ্ছে! আরও মজার একটা বিষয় ছিল এই ট্রেনের ফটোশুট! এই ট্রেনে ওঠা হবে আর ট্রেনের জানালা আর দরজা ধরে ছবি তোলা হবে না, সেটা ভাবাই যায় না। সবাই একে একে দাঁড়িয়েছেন, একে অন্যকে জায়গা করে দিচ্ছেন ছবি তোলা শেষে। কেউ ছবি তোলার না থাকলেও সাহায্য করার মানুষের অভাব নেই। সব মিলিয়ে হাসিমুখে দারুণ একটা সময় কাটবে পুরো ভ্রমণে।

সন্ধ্যা হতেই আফসোস হচ্ছিল যে কেন ট্রেনটা লেট হলো? কী না কী মিস করছি! যাক গে, যা দেখেছি চোখে, তা–ও কম নয়! চার ঘণ্টা কু ঝিক ঝিক করতে করতে অদ্ভুত সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ পর্যন্ত ট্রেন আমাদের এল্লায় পৌঁছে দিল। ট্রেন থেকে নেমেই দেখি, দিলশান আরও দুই ঘণ্টা আগেই চলে এসেছে স্টেশনে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল হাসিমুখে।

নানু ওয়া ফলস
নানু ওয়া ফলস

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৪১ মিটার ওপরে অবস্থিত ছোট্ট এই শহরটাও বৈচিত্র্যে ভরপুর। পাহাড়, চা–বাগান আর ঝরনায় সাজানো এই শহরে যখন আমরা পৌঁছাই, তখন ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে আটটা। চায়ের শহর ঘুরে বেড়াচ্ছি আর চা না নিয়েই চলে আসব, সেটা কি হয়? দিলশানকে আগেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী রকমের চা কিনলে ভালো হয়। সে আগেই আমাদের কথা দিয়েছিল, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ভালো চায়ের দোকানে নিয়ে যাবে, যেখানে গেলেই বৈচিত্র্য দেখে অবাক হবো।

এল্লায় হোটেলে পৌঁছানোর আগে দিলশানই তাই মনে করিয়ে দিল সেই দোকানে যাওয়ার কথা। গিয়ে বুঝলাম, আসলেই কেন দিলশান একে চায়ের স্বর্গরাজ্য বলেছিল! থরে থরে সাজানো শত রকমের চা। কোনো চা ফ্লেভারড, কোনোটা আবার মিক্সড। চায়ের জগতে এত রকমের ভিন্নতা থাকতে পারে, সে তথ্য আমরা পেলাম সেই দোকানে এসে। আরও মজার ব্যাপার হলো, আপনি চাইলে নিজের পছন্দমতো ৫০, ১০০ কিংবা ১ হাজার গ্রাম চা কিনতে পারবেন। দিলশানের ও আমাদের পছন্দ অনুযায়ী বেশ কিছু ফ্লেভারের চা কিনলাম। এবার হোটেলে ওঠার পালা।

চায়ের দোকানে চায়ের যত বাহার
চায়ের দোকানে চায়ের যত বাহার

বরাবরের মতো এল্লাতেও আমাদের বুক করা ছিল একটা হোমস্টে। যেয়ে দেখলাম, বিমানবাহিনীর এক সাবেক কর্মকর্তার বাড়ি সেটা। কর্মজীবন শেষে পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন এখানে। রাতের খাবারের ব্যবস্থা হলো সেখানেই। প্রতিটা খাবার বাড়ির কর্ত্রী এমনভাবে গুছিয়ে দিলেন যে তাঁর অভিরুচির প্রশংসা করতেই হয়। পেটপুরে খাওয়ার পরে ক্লান্তিতে চোখ বুজলাম সেদিনের মতো। পরদিন সকালে আবার পরবর্তী রোমাঞ্চযাত্রার জন্য তৈরি হতে হবে!

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ১১: ৩৯
বিজ্ঞাপন