নুয়েরা এলিয়ায় আয়েশি দিন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

চা-বাগান আর পাহাড়ঘেরা হিম হিম শহর নুয়েরা এলিয়াকে অনেকেই ডাকেন ‘শ্রীলঙ্কার লিটল ইংল্যান্ড’ নামে। কলোনিয়াল ধাঁচের বাড়ি, ইউরোপিয়ান পরিবেশ—সবকিছু নিয়ে ১৮৬৪ মিটার ওপরের এই শহরকে এই নামে ডাকাটা অযৌক্তিক কিছু নয়। আর নুয়েরা এলিয়া মানে শুধু কিন্তু চা–বাগানই নয়। ঝরনা, ন্যাশনাল পার্ক, গ্রেগরি লেক—সব মিলিয়ে অনন্য এক শহর। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, এই শহরটায় দুইটা দিন থাকার।

নুয়েরা এলিয়ার ভোর
নুয়েরা এলিয়ার ভোর
নুয়েরা এলিয়ার ভোর
নুয়েরা এলিয়ার ভোর
নুয়েরা এলিয়ার হোম স্টের মালিক শর্মিলা আন্টি শাড়ি পরা শিখার সাথে ছবি তুলতে চাইলেন
নুয়েরা এলিয়ার হোম স্টের মালিক শর্মিলা আন্টি শাড়ি পরা শিখার সাথে ছবি তুলতে চাইলেন

সকাল সকাল উঠে গেলাম সূর্যোদয়ের আগেই। আমাদের বাংলোর ঠিক পেছনের চা–বাগান থেকে সূর্য উঠছে, সেই দৃশ্য দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দিলাম বেশ খানিকক্ষণ। পরিচয় হলো শ্রীলঙ্কান যুগল নুহান আর তাঁর বউয়ের সঙ্গে। চা–বাগানের আশপাশে হাঁটাহাঁটি করতে করতেই শর্মিলা আন্টি সকালের নাশতার কথা জানিয়ে গেলেন।

নুহান ও তাঁর স্ত্রী
নুহান ও তাঁর স্ত্রী

কিছুক্ষণ ফটোসেশন করে বাংলোর বারান্দায় বসলাম নাশতা নিয়ে। রোদ পোহাতে পোহাতে শর্মিলা আন্টির পরোটা, গাজরের জুস খেলাম বেশ তৃপ্তি নিয়ে। দিলশানও সময়মতো হাজির। দেরি না করে তাই রওনা দিলাম আমাদের প্রথম গন্তব্য বুমরোয়েল্লা ওয়াটারফল।

বিজ্ঞাপন

নুয়েরা এলিয়া শহর থেকে আধা ঘণ্টা ড্রাইভ করে আমরা পৌঁছে গেলাম বুমরোয়েল্লার পাদদেশে। এখান থেকেই হাঁটা শুরু করতে হবে ঝরনার কাছে পৌঁছাতে। তবে তেমন কঠিন কোনো পথ নয়। ২০ মিনিটের মতো হাঁটলেই যাওয়া যায় একদম ঝরনাতলায়! কী সুবিশাল সেই ঝরনাধারা। তেজি বেগে যেন আছড়ে পড়ছে মাটিতে। এমন দৃশ্য চাইলে সারাটা দিনই দেখা যায়। ছবি তোলা আর ঝরনার গানে কখন যে দুই ঘণ্টা পার করে দিয়েছি, নিজেরাও জানি না। আর সবচেয়ে ভালো বিষয় হলো এই দুই ঘণ্টায় কেউই ছিল না চারপাশে। সকাল সকাল যাওয়ার সুবিধাটা পুরোপুরিই উপভোগ করলাম আমরা দুজনে। তবে আরও অনেক পরিকল্পনা বাকি, তাই উঠতে হলো।

বুমরোয়েল্লা ওয়াটারফল
বুমরোয়েল্লা ওয়াটারফল
মহিলা অ্যাভোকাডো সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রির জন্য
মহিলা অ্যাভোকাডো সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রির জন্য

ফেরার সময় যাত্রাসঙ্গী পেয়েছিলাম দুটো কুকুরকে। কোত্থেকে বা কীভাবে এল জানি না; কিন্তু ওরা আমাদের সঙ্গেই পুরোটা পথ নেমেছে, আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি, ওরা অপেক্ষা করেছে আমাদের জন্য। রাস্তার একধারে দেখলাম, এক মহিলা অ্যাভোকাডো সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রির জন্য। বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ২০ টাকা প্রতিটি! এত কম দাম দেখে দুটো অ্যাভোক্যাডো নিয়ে আবার চলা শুরু করলাম। আরেকজনের কাছ থেকে জীবনে প্রথম কিনে খেলাম সাওয়ার চেরি। টক–মিষ্টি টেস্টের এই চেরির স্বাদও অনেক আলাদা। সঙ্গে চাচা আবার আমাদের ফ্রি খাওয়ালেন তাঁর গাছের মিনি পেয়ারা। সেটা খেতে খেতেই নিচে নামলাম।

বিজ্ঞাপন

পরবর্তী গন্তব্য সিঙ্গেল ট্রি হিল ভিউপয়েন্ট অ্যান্ড টেম্পল। বিস্তৃত চা–বাগান চারপাশে, মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তা। সেই পথ ধরেই আমরা পৌঁছে গেলাম সিঙ্গেল ট্রি ভিউপয়েন্টে। ওই ভিউপয়েন্টে দাঁড়িয়ে চা–বাগানকে সামনে রেখে দেখা মেলে নুয়েরা এলিয়া শহরের। যেদিক থেকেই দেখবেন, স্নিগ্ধ এই শহরের প্রেমে আপনি বারবার পড়বেন। ভিউপয়েন্ট থেকে নেমে আসার পথে গাড়ি থামিয়ে আমরা চা–বাগানের কর্মীদের যজ্ঞ দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ। ভাষা বোঝার উপায় নেই, কিন্তু মুখের হাসি দিয়ে সাদরেই স্বাগত জানালেন আমাদের। তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলে আর চা–বাগানের কার্যক্রম দেখে রওনা দিলাম পরবর্তী গন্তব্য লাভারস লিপ ঝরনায়।

সিঙ্গেল ট্রি হিল ভিউপয়েন্ট
সিঙ্গেল ট্রি হিল ভিউপয়েন্ট

এক প্রেমিক যুগলের আত্মাহুতির ঘটনা ঘটেছিল এই ঝরনায়, সে থেকেই নামটা হয়ে গেল লাভারস লিপ ওয়াটারফল! এই ঝরনার জলে অবগাহন সম্ভব নয়, ভিউপয়েন্ট থেকেই সুবিশাল জলরাশি দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। লাভারস লিপ থেকে নামার পথে দেখা হলো এই ট্রিপে পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশি যুগল তানভীর ভাই ও লিলি আপুর সঙ্গে। তাঁরা দুই সপ্তাহ ধরে সুন্দর এই দেশটা ঘুরে দেখছেন, সেই গল্প শুনে একটু হিংসেই লাগছিল আমাদের। অনেক দিন পর বাংলা ভাষী কাউকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে গিয়েছিলাম আমরা চারজনই। তাই দাঁড়িয়েই আড্ডা দিলাম প্রায় ৪০ মিনিট! ভাইয়া-আপুকে বিদায় দিয়ে আমরা আবার রওনা দিলাম শহরের পথে। সেখানে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি নেব আমরা। এরপর যাব নুয়েরা এলিয়ার অন্য প্রান্তে।

দুপুরে অবশ্য লোকাল কিছু খাওয়ার সুযোগ হয়নি সে বেলায়। তাই খুশি থাকতে হয়েছে পাস্তা আর ফ্রায়েড রাইসে। মজার একটা বিষয় হলো, নুয়েরা এলিয়ায় বাসা কিংবা ছোট-বড় রেস্তোরাঁ—সব জায়গাতেই আপনাকে পান করতে দেওয়া হবে বেশ গরম পানি, যেটায় আমাদের খুব একটা অভ্যাস নেই। খাওয়াদাওয়া শেষে কিছুটা ঢুলু ঢুলু চোখেই আমরা রওনা দিলাম কান্দেওয়ালা রিজারভয়্যারের পথে।

কান্দেওয়ালা রিজার্ভওয়ের
কান্দেওয়ালা রিজার্ভওয়ের
কান্দেওয়ালা রিজার্ভওয়ের
কান্দেওয়ালা রিজার্ভওয়ের

প্রায় এক ঘণ্টার পথে কিছুটা ঘুমিয়ে নেব ভেবেছিলাম। কিন্তু পথের সৌন্দর্য সে পরিকল্পনাকে ভন্ডুল করে দিল পরিপূর্ণভাবে। পেড্রো টি–এস্টেটের সুবিশাল পরিসরে কিছুক্ষণ ছবি তুলে এগিয়ে গেলাম কান্দেওয়ালার দিকে। সময় থাকলে ওই দিকটা আমাদের আরও একটু দেখার ইচ্ছা ছিল।

পেড্রো টি এস্টেটে দুই লেখক
পেড্রো টি এস্টেটে দুই লেখক

তবে কী আর করা! কান্দেওয়ালা রিজারভয়্যারের সামনে যখন নামলাম, আকাশে তখন মেঘের বেশ আনাগোনা, আর চারদিক থেকে ঠান্ডা জেঁকে বসেছে। কিন্তু জায়গাটা এত শান্তি শান্তি ছিল যে ঠান্ডার মধ্যেই অনেকক্ষণ বসে ছিলাম দুজনে। সুবিশাল লেক, মেঘের ঘনঘটা আর চারপাশের স্ট্রবেরি ফার্ম—এই নিয়েই স্নিগ্ধ বিকেলে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে দিলাম আমরা।

এবার যাত্রা আমাদের দিনের সর্বশেষ গন্তব্যে, আম্বেওয়ালা ফার্ম। এ যেন একদম অন্য একটা জগৎ! যেদিকে চোখ যায়, চারণভূমি, উইন্ড টারবাইন। চারপাশ দেখে মনে হচ্ছিল, শ্রীলঙ্কায় বসেই যেন নিউজিল্যান্ডের ফার্মের স্বাদ পেয়ে গেলাম আমরা। আর ফার্মের সামনেই ওদের সেলস সেন্টারে পাওয়া যায় আম্বেওয়ালা ফার্মে তৈরি সব পণ্য। ওদের দই আর ব্যানানা মিল্ক খেতে বেশ লাগল।

চা বাগানের কর্মীদের সঙ্গে শিখা
চা বাগানের কর্মীদের সঙ্গে শিখা
আম্বেওয়ালা ফার্ম
আম্বেওয়ালা ফার্ম
নুয়েরা এলিয়ার ডাকঘর
নুয়েরা এলিয়ার ডাকঘর
নুয়েরা এলিয়ার প্রাণকেন্দ্রে
নুয়েরা এলিয়ার প্রাণকেন্দ্রে

সবকিছু দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আমরাও রওনা হলাম নুয়েরা এলিয়ার পথে। শর্মিলা আন্টির কুটিরে ফেরার আগে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম শহরটা। শান্ত এই শহরের পরতে পরতে জুড়িয়ে থাকা প্রবল মায়া আর উষ্ণতা জড়িয়েই ফিরলাম আমাদের হোমস্টেতে।

ছবি: শিখা ও সাফাত

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯: ৫৫
বিজ্ঞাপন