উত্তর ওয়েলসের ভ্রমণ নিয়ে লেখার প্রথম পর্বে বলেছিলাম পাহাড়ি শান্ত নদী কনওয়ের গল্প। তবে এই শান্ত নদীও মাঝেমধ্যে অশান্ত হয় পাহাড়ি ঢলে, সেই সঙ্গে রয়েছে আইরিশ সাগরের সঙ্গে যোগসাজশ। ফলে ভরা মৌসুমে কনওয়ের দুই কূল ছাপিয়ে আসে তুমুল স্রোত আর আইরিশ সাগরে বিসর্জনের আয়োজন। অনেকটাই মামাবাড়ির কাছে অর্থাৎ সিলেটের সীমান্তবর্তী থানা কানাইঘাটের লোভাছড়ার মতো। আপনারা অনেকেই জানেন, সিলেট অঞ্চলে ছিপছিপে পাহাড়ি নদী বা খালকে বলা হয় ছড়া, যা বালু ও পাথরময় থাকে শুকনো মৌসুমে, কিন্তু ভরা মৌসুমে ধারণ করে রুদ্রমূর্তি। তবে লোভাছড়ার জন্য আমার করুণা হয়, কারণ লোভাছড়া কখনোই সাগরের দর্শন পায়নি, পেয়েছে সুরমা আর বরাকের স্রোতের প্লাবন।
প্রাচীনকালে গোটা পৃথিবীর বেশির ভাগ নগর, বন্দর, দুর্গ বা প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীর তীরকে কেন্দ্র করে। যদি দুর্গের কথায় আসি, তবে গ্রেট ব্রিটেনের বেশির ভাগ দুর্গই তৈরি হয়েছে কোনো না কোনো নদীর তীরে। যেমন প্রায় হাজার বছর আগে মহাযোদ্ধা উইলিয়াম দ্য কঙ্কার লন্ডনের টেমস নদীর তীরে তৈরি করেছিলেন টাওয়ার অব লন্ডন। দশম শতকে বিখ্যাত নদী এভনের তীরে ক্যাসলের নগরী ওয়ারউইকে তৈরি হয়েছিল ওয়ারউইক ক্যাসল। গ্লাসগোর নদী ক্লাইডের তীরে বথওয়েল ক্যাসল কিংবা স্কটিশ হাইল্যান্ডসের নদী ইনভারনেসের তীরে ইনভারনেস ক্যাসল; যাকে কেন্দ্র করে ইংরেজি সাহিত্যের দিকপাল উইলিয়াম শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘ম্যাকবেথ’ নাটক।
ঠিক তেমনি কনওয়ে নদীকে কেন্দ্র করে ১২৮৩ সালের ম্যাডিভ্যাল যুগে তৈরি হয়েছিল কনওয়ে ক্যাসল। তৎকালীন রাজা প্রথম এডওয়ার্ড যখন ওয়েলস জয় করেন, তখন তৈরি হয় এই দুর্গ, যা তৈরির দায়িত্ব পড়ে রাজার সবচেয়ে প্রিয় এবং সে সময়ে গোটা ইউরোপের কিংবদন্তি স্থপতি মাস্টার জেমস অব সেইন্ট জর্জের ওপর। তাঁকে দিয়ে রাজা প্রথম এডওয়ার্ড পরবর্তী সময়ে ওয়েলসে আরও চারটি দুর্গ তৈরি করিয়েছিলেন।
আশা করি, ইতিমধ্যেই বুঝে গেছেন আমাদের আজকের গন্তব্য কোথায়? ঠিকই ধরেছেন, আমাদের আজকের গন্তব্য কনওয়ে ক্যাসল। সকাল সকাল নাশতা সেরে আগস্ট মাসের ঝাঁ–চকচকে রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম কনওয়ে শহরের উদ্দেশে। সকাল ও দুপুরটা কাটবে সেখানে, তারপর ল্যান্ডিডনো। আমাদের লজ থেকে একেবারেই লাগোয়া বাসস্টেশন। সেখান থেকে মিনিট পঁচিশেক দূরেই বিখ্যাত এই দুর্গ। তবে উত্তর ওয়েলসে কোনো ভ্রমণকেই ক্লান্তিকর মনে হয় না; কারণ দুপাশের পাহাড়, ঝরনা আর সবুজের হাতছানিতে সময় কীভাবে চলে যায় টেরই পাওয়া যায় না।
এরই মধ্যে আমাদের বাস পৌঁছে গেছে কনওয়ে দুর্গের কাছাকাছি স্টেশনে। স্টেশনে নেমে মনে হলো আমরা পৌঁছে গেছি কোনো গ্রিক সাম্রাজ্যে। চারপাশে প্রাচীন চুনাপাথরের প্রাসাদ, যার চৌহদ্দিতে রয়েছে হাজারো রঙিন ফুলের সমারোহ। চারপাশ যেন মেতে আছে উৎসবে। মনে হলো কিছুক্ষণ পরেই হয়তো এই পথে হেঁটে যাবেন পেনেলোপি, হেলেন, এন্ড্রোমিডা, ইউরোডিসি কিংবা সাইকির মতো গ্রিক সাম্রাজ্যের সব সুন্দরী আর বাংলা সংগীতের রাজপুত্র শচীন দেববর্মন তাঁর অসামান্য কণ্ঠে গাইবেন, ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে...’।
আমরাও শামিল হলাম সেই উৎসবের কাফেলায়। প্রথমে তথ্যকেন্দ্র, সেখান থেকে ঢুঁ মারলাম একটি চিত্রপ্রদর্শনীতে; যেখানে প্রদর্শিত হচ্ছিল প্রাচীন সব চিত্রকর্ম। মৌনী নিজেও একজন শিল্পী, তাই তাঁর উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এরপর টিকিট হল থেকে নেওয়া হলো টিকিট। আরুষি যেহেতু পাঁচ বছরের নিচে, তাই সে পেল ফ্রি টিকিট, বাকি তিনটি টিকিট কাটা হলো তেত্রিশ পাউন্ড দিয়ে।
টিকিট হাতে পেয়ে আমার আর তর সইছিল না; কারণ এসব প্রাচীন স্থাপনা, শিল্পকর্ম ও ইতিহাস আমাকে ব্যাপক টানে। আমার মনে আছে একবার ‘ইনক্রেডিবল হিউম্যান জার্নি’ নামক একটি তথ্যচিত্র দেখে আবেগাক্রান্ত হয়েছিলাম। বিবিসির সেই তথ্যচিত্রের শুরুটা হয়েছিল আফ্রিকার নামিবিয়ার একটি অঞ্চল থেকে, যেখান থেকে হাজার কোটি বছরের রূপান্তরের পর অস্ট্রালোপিথিকাস বা প্রথম দুই পেয়ে মানুষের সূচনার কথা অনুমান করা হয় সেখান থেকে আরও বিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে মানুষ পৌঁছায় হোমো নিনটেনডোনিয়াস কিংবা আজকের আধুনিক হোমোসেপিয়েন্সে। সেই সঙ্গে দেখানো হয় একে একে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানব-অভিবাসনের গবেষণালব্ধ ইতিহাস।
এদিকে টিকিট হল থেকে বেরিয়ে কনওয়ে দুর্গের গা ঘেঁষে পাহাড়ি পথ বেয়ে আমরা যাচ্ছিলাম দুর্গের প্রবেশপথে। যাত্রাপথে মনে পড়ছিল রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের কথা, যিনি নাকি ভীষণ শিল্পানুরাগী ছিলেন। শিল্প, বিজ্ঞান ও সংগীতের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। তাঁর এই শিল্পপ্রেম তিনি নাকি পেয়েছিলেন তাঁর মা এলিনর অব প্রভিন্সের কাছ থেকে; যিনি ছিলেন একজন ফরাসি রাজকুমারী। সুতরাং যাঁর মা একজন ফরাসি রাজকুমারী, তাঁর শিল্পের প্রতি অনুরাগ থাকাটাই তো স্বাভাবিক। যদিও রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের বাবা রাজা তৃতীয় হেনরিও প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন শিল্প ও শৈল্পিক স্থাপত্যের প্রতি। আমরা এখনো হাঁটছি দুর্গের গা বেয়ে। এই একই পথে হয়তো হেঁটেছেন রাজা রাজন্যবর্গ, হেঁটেছেন সৈন্যসামন্ত। সংগীত, নৃত্য কিংবা অস্ত্রের ঝনঝনানিতে মুখর ছিল দুর্গ প্রাঙ্গণ। অথচ কালের বিবর্তনে গোটা দুর্গ এখনো নীরবে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
কনওয়ে ক্যাসলের এক পাশে ঘন নীল জলের কনওয়ে নদী, আর বাকি তিন পাশেই পাহাড়। মাঝখানে রয়েছে খোলা জায়গা, যা দেখেছিলাম লকনেসের উরকোয়ার্ট ক্যাসলে। হাজার বছরের পুরোনো ক্যাসল, কিন্তু কোথাও এতটুকু পরিবর্তন হয়নি আজও। ঠিক প্রাচীন নকশা মেনেই মেরামত করে ইতিহাসকে জীবন্ত করে রেখেছে ওয়েলস হেরিটেজ; সেই সঙ্গে রয়েছে সেফটি মেইনটেন্যান্স। যাঁরা আমার মতো পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে চান, ভালোবাসেন ইতিহাস ও ঐতিহ্য, এই ক্যাসলে ভ্রমণ করলে নিঃসন্দেহে ব্রিটেনের এবং প্রাচীন স্থাপনাকে বাঁচিয়ে রাখার সংস্থা ব্রিটিশ হেরিটেজের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যাবে বহুগুণ।
অতীতে আমার লেখায় বহুবার হয়তো পড়েছেন দেওরভাগা নদীর গল্প, যে নদীকে আমি সব সময় প্রণাম জানাই মাতৃজ্ঞানে। অথচ গত সপ্তাহের পত্রিকায় দেখলাম, ভেঙে ফেলা হয়েছে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠার স্থান সিলেটের গোলাপগঞ্জে দেওরভাগা নদীর ওপরে মোগল আমলের শেষ দিকে নির্মিত দেওয়ানের পুল নামে ১৭০০ শতকের একটি সেতু। শুধু কি তা–ই? দেওয়ানের পুল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণ একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থান, যেখানে বসবাস করতেন মধ্যযুগীয় সমাজসংস্কারক শ্রীচৈতন্য দেবের পিতা এবং পিতামহী। ইতিহাস বলে, মানবপ্রেমের অন্যতম পথপ্রদর্শক শ্রীচৈতন্য দেব নিজেও দুবার এসেছিলেন ঢাকাদক্ষিণের এই বাড়িতে। এখনো রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচশ বা তাঁর অধিক বছরের পুরোনো চুন–সুরকি দিয়ে তৈরি ভবন, যার পলেস্তারা ধীরে ধীরে খসে পড়ছে বিলীন হওয়া ইতিহাসের মতো শুধু আমাদের নির্লিপ্ত উদাসীনতায়।
এবার বিদায়ের পালা। মধ্যযুগীয় কনওয়ে ক্যাসলের প্রতিটি অলিগলি, রাজপ্রাসাদ আর ঘুপচি, আঁধার কোটর ঘুরে বেরিয়ে এলাম ঠিকই, কিন্তু মন পড়ে থাকল ইতিহাসের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। হাঁটতে হাঁটতে এসে বসলাম নদীর কুলঘেঁষা পাথুরে সিঁড়িতে। যেতে হবে ল্যান্ডিডনো পিয়ারে, কিন্তু মন চাইছে কনওয়ে ক্যাসলের রেশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে, অন্যদিকে আজকেই ভ্রমণের শেষ দিন। সুতরাং সিদ্ধান্ত হলো মধ্যাহ্নভোজন শেষে শুরু হবে নতুন যাত্রা, গন্তব্য ল্যান্ডিডনো পিয়ার।
লেখক: ড. অসীম চক্রবর্তী, গবেষক ও শিক্ষক, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড কম্পিউটিং, এংলিয়া রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ
ছবি: লেখক