মাউন্টেন রেলে স্বর্গারোহণ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আগের পর্বে শুরু করেছিলাম উত্তর ওয়েলসের কনওয়ে নদীর গল্প। অবশেষে সন্ধ্যা নামল শ্যামাঙ্গী কনওয়ের তীরে। আমরাও ফিরলাম ক্লেনরষ্টের ড্যানবিগ স্ট্রিটের রিজেন্ট হাউসে। ডিনার শেষে শুরু হলো পরের দিন সকালের প্রস্তুতি। যে সকালের জন্য প্রতীক্ষা করা যায় অগুনতি রাত। কারণ, রাত পোহালেই আমরা যাত্রা শুরু করব গ্রেট ব্রিটেনের অপার্থিব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমারোহ স্নোডোনিয়া ন্যাশনাল পার্কে।

স্নোডোনিয়া পাহাড়ের দৃশ্য স্বর্গীয় উদ্যানকেও হার মানায়
স্নোডোনিয়া পাহাড়ের দৃশ্য স্বর্গীয় উদ্যানকেও হার মানায়

ভোরে ঘুম থেকে উঠেই রাস্তার ঠিক ওপাশের ক্যাফেতে  ভরপেট ‘ফুল ইংলিশ ব্রেকফাস্ট’ অর্থাৎ ব্রেড অ্যান্ড বাটার, বেক্‌ড বিনস, এগ ওমলেট উইথ ফ্রায়েড মাশরুম অ্যান্ড টোম্যাটো, হ্যাশ ব্রাউন ও সসেজ আর সঙ্গে এক কাপ ইংলিশ ব্রেকফাস্ট টি দিয়ে রসনার মোটামুটি একটা বন্দোবস্ত করে চেপে বসলাম বেটসি কোডের বাসে।

বিজ্ঞাপন

বেটসি কোড স্টেশনে গিয়ে সেখানকার ট্রাভেলার্স ইনফরমেশন সেন্টার থেকে বুকলেট সংগ্রহ করলাম, সেই সঙ্গে জেনে নিলাম ওখানকার গণপরিবহনের সময়সূচি। পাহাড়ি অঞ্চল বলে ওই এলাকায় বিকেল চারটার পরে কোনো বাস নেই। একটা লোকাল ট্রেন আছে, সেটারও শেষ ট্রেন সন্ধ্যা ছয়টায়। বেশির ভাগ ক্যাব চার–পাঁচটার পরে আর চলে না, যদি না আপনি আগে বুক করে রাখেন। অর্থাৎ যদি ভাগ্যের ফেরে ছয়টার পরে ওই এলাকায় আটকা পড়েন, তবে পদব্রজ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। শীতের রাত হলে তো আর কথাই নেই। শুনেছি, ওই অঞ্চলে নাকি মাঝে মাঝে পাহাড় থেকে নেমে আসে বিগ ক্যাট বা পিউমা বাংলায় যাকে বলে কালো চিতা।

বেটসওয়ে কোড  ট্রেন স্টেশনে লেখক
বেটসওয়ে কোড ট্রেন স্টেশনে লেখক
বিভিন্ন গন্তব্যের নির্দেশনা
বিভিন্ন গন্তব্যের নির্দেশনা

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর এক গানের কথায় জোৎস্নাস্নাত রাতের বর্ণনা করতে বলেছিলেন ‘এ এমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভালো এ মরণ স্বর্গ সমান’। আমার কাছে স্নোডোনিয়ার সারি সারি পাহাড়, নীল জলের হ্রদ আর কালো ফসিলের গন্ধও তেমন।  প্রকৃতির এমন রূপ দেখার পরে যদি মৃত্যুও আসে ক্ষতি কি?

বিজ্ঞাপন

যাহোক বেটসি কোড থেকে শুরু হলো আমাদের পাহাড় অরোহণের সময়। একের পর এক পাহাড়ি উপত্যকা দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে আমার বাস। দুই পাশে বিশাল জানালা, যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই অমরাবতীর সৌন্দর্য। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে এই ভেবে যে এই উঁচু পাহাড়ের মধ্যে প্রায় সর্বোচ্চ যে পাহাড়, তার চূড়ায় পা রাখব আজ। বুক ভরে গ্রহণ করব বুনো ফুলের ঘ্রাণ আর খাবলে খাব সাদা মেঘ। ইতিমধ্যে আমাদের বাস পৌঁছে গেছে স্নোডোনিয়া ন্যাশনাল পার্কে কাছে। জায়গাটার নাম ক্লেনবেরি। বাস থেকে নেমে প্রকৃতির এমন রূপ দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার উপক্রম। নিজেকে কোনোমতে সামলে গন্তব্যহীন হাঁটা শুরু করলাম।

ক্লিন ক্লেসলিন
ক্লিন ক্লেসলিন
ক্লিন ক্লেসলিনের নীল জলরাশি
ক্লিন ক্লেসলিনের নীল জলরাশি

হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম সুবিশাল এক হ্রদের পাড়ে, যার ঠিক ওপারে রয়েছে পুরোনো কয়লাখনি। নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে স্কটল্যান্ডে হ্রদকে বলে লখ আর এখানে অর্থাৎ উত্তর ওয়েলসে হ্রদকে বলে ক্লিন; তবে বানানটা বড় অদ্ভুত শুরু হয় ডবল এল দিয়ে। আমরা যে ক্লিনের তীরে পৌছালাম, তাঁর নাম ক্লিন ক্লেসলিন। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম ক্লিন পাডানের তীরে। নীল স্বচ্ছ জলে যেন অস্ত গেল গোটা দিগন্ত। যে দিগন্ত ধরে নিমেষেই হেঁটে যাওয়া যায় আমার রঙিন শৈশবে।

যে সময়টা সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়িয়েছি। মূলত আমাদের বাড়িটাই একটা টিলার ওপরে, আর চারপাশে একে একে রয়েছে কৈলাশ টিলা, বামুনঝি টিলা, বাউলি টিলা, কালাচাঁদ টিলা, শ্রীমতী টিলাসহ কয়েক শ টিলার বাহার। এক একটা টিলা যেন কালো হাতি। আর অগ্রহায়ণের বিকেলে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে দেখা যেত ঠিক স্নোডনিয়া ন্যাশনাল পার্কের মতো সীমান্তের ওপারের সারি সারি খাসি হিলস। আমাদের স্কুলের ঠিক নিচে ছিল এক নাম না–জানা ছড়া আর তার ঠিক ওপারে টিলার গা–জুড়ে বেতফলের ঝাড় আর তার ঠিক ওপরে উঁচু শ্রীমতী টিলা।

পাডান হ্রদের সুমিষ্ট জল– হাওয়ায়
পাডান হ্রদের সুমিষ্ট জল– হাওয়ায়
লেনবেরির অপার্থিব সৌন্দর্য মনে পড়িয়ে দেয় লেখকের ছেলেবেলা
লেনবেরির অপার্থিব সৌন্দর্য মনে পড়িয়ে দেয় লেখকের ছেলেবেলা

শ্রীমতী ভরপুর ছিল নাম না–জানা হাজারো বুনো ফুল আর কাঁঠাল, হরীতকী আর জামগাছে। আমরা স্কুলের টিফিনের ফাঁকে ছড়া ডিঙিয়ে দস্যিপনা করে প্রায়ই কখনো বেতফল অথবা কখনো পাকা কাঁঠাল আবার কখনো কষা স্বাদের হরীতকী চিবিয়ে অমৃতের বর্ণনাতীত স্বাদ আস্বাদন করেছি। মাঝেমধ্যে মনে হয় সে আরেক জীবন ছিল, যে জীবনের সঙ্গে দেখা হবে না আর কোনোদিন।

ধারণা করা হয়, প্রায় পাঁচ শ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর বিপুল প্রাকৃতিক পরিবর্তনকালে তৈরি হয়েছে এই স্নোডোনিয়া পাহাড় ও হ্রদগুলো। আর এই পাহাড়ি অঞ্চলে মনুষ্য বসতি শুরু হয় মাত্র হাজারখানেক বছর আগে থেকে। তবে ওয়ালস রাজা বাদশাহদের মধ্যে যাঁর নাম না বললেই নয়, তিনি হলেন কিং আর্থার। যিনি বিখ্যাত ছিলেন মধ্যযুগীও স্যাক্সন ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে। কিং আর্থারের রাজকার্য কর্নওয়ালকেন্দ্রিক হলেও তাঁর জন্মস্থানের সঙ্গেও রয়েছে স্নোডনের পাহাড়ি অঞ্চলের সম্পর্ক। তবে শুধু যুদ্ধবিগ্রহ নয়, স্নোডোনিয়ার এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জন্ম দিয়েছে জিলিয়ান ক্লার্ক, রোয়াল্ড ঢাল, ডিলন থমাসের মতো কবিদের।  

লেনবেরি পাহাড়ে মধ্যাহ্নভোজে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে লেখক
লেনবেরি পাহাড়ে মধ্যাহ্নভোজে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে লেখক
স্নোডোন মাউন্টেন
স্নোডোন মাউন্টেন

এদিকে পাহাড়ি উপত্যকায় আর হ্রদের তীরে ঝকমকে গ্রীষ্মের এই দুপুরে ঘুরতে ঘুরতে থামতে হলো দুপুরের খাবারের জন্য। খোলা আকাশের নিচে সারি সারি টেবিল–চেয়ার পাতা ক্যাফেতে স্যান্ডউইচ, ক্রিপস আর ঠান্ডা পানীয় দিয়ে লাঞ্চ সেরে শুরু হলো মাউন্টেন রেলে। খুব ইচ্ছা ছিল, হেঁটে হেঁটে স্নোডোন সামিট করার; কিন্তু যেহেতু আরুষি সঙ্গে আছে, সংগত কারণে নিতে হলো মাউন্টেন রেল।

সে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা। আমাদের মাউন্টেন রেল একে একে পাড়ি দিতে শুরু করল স্নোডোনের পর্বতরাজি। ক্লেনবেরি মাউন্টেন, হেবরন, রকি ভ্যালি পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম ২ হাজার ৫৫৬ মিটার উঁচু ক্লগউইন মাউন্টেনে। যেখানে হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় সাদা মেঘ, আর দুচোখে পরা যায় প্রকৃতির অপার্থিব মায়াঅঞ্জন। এমন জায়গায় এলে আমার মনটা শূন্যতায় ভরে যায়। এক ধরনের বুক খালি করা অনুভূতি। সেই সঙ্গে চোখের সামনে ভাসে প্রাচীন নাম না–জানা এক চিত্রশিল্পীর একটি চিত্রকর্ম যা কাশীরাম দাস তাঁর বাংলা মহাভারত মহাকাব্যে ব্যবহার করেছিলেন স্বর্গারোহণ পর্বে। যেখানে অনামী সেই শিল্পীর তুলিতে পঞ্চপাণ্ডব হিমালয় পাড়ি দিয়ে হাঁটছেন স্বর্গের পথে। মনে হলো আমরাও শামিল হলাম মহাসিন্ধুর পারের সেই মহাযাত্রায়।

আড়াই হাজার মিটার উঁচুতে ক্লগউইন পাহাড়ে
আড়াই হাজার মিটার উঁচুতে ক্লগউইন পাহাড়ে
হেবরন পাহাড়ে লেখক
হেবরন পাহাড়ে লেখক

ধীরে ধীরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার উপক্রম। হেলেদুলে আমাদের ট্রেন অজগরের মতো নামছে পাহাড়ের কূল বেয়ে। দূরে কোন বিরহী মেষপালক তাঁর অনাটোলিয়ান জাতের কুকুরের সাহায্যে ধীরে ধীরে মেষশাবকদের পাল নিয়ে বাথানে ফিরছে। আমরাও বাড়ি ফিরছি এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে, যা রবে নীরবে, হৃদয়ে মম। (চলবে)

লেখক: ডক্টর অসীম চক্রবর্তী, গবেষক ও শিক্ষক, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড কম্পিউটিং, এংলিয়া রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০৭: ৪৩
বিজ্ঞাপন