ল্যানরস্টের মায়াভরা পথে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমরা যাচ্ছিলাম উত্তর ওয়েলসের পাহাড়ি অঞ্চলে। যেখানে স্নো ডনের সারি সারি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় মেঘ। যেখানে ভ্রমর বিবাগি হয় নিভৃত নীল পদ্মের জন্য, আর আকাশ হয় নীলক্ষা নীল, ঠিক যেন নূরলদীনের সারা জীবন কবিতার লাইন। আমরা যাচ্ছিলাম এক অসামান্য সময়ের সাক্ষী হতে, যেখানে পাহাড়ের বুকে আলতো আদরে জন্ম নেওয়া কনওয়ে নদী বয়ে গেছে নাম না–জানা ফুলের বনকে অতিক্রম করে।

ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে দেখা উত্তর ওয়েলসের স্বর্গ
ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে দেখা উত্তর ওয়েলসের স্বর্গ

ভোরের আলো ফোটার আগেই যে লৌহশকট আমাদের নিয়ে যাবে বলেছিল ল্যান্ডিডনো জংশনে, সেই লৌহশকট থেমে গেছিল কোনো এক অজানা কারণে। যে অজানা কারণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমরা এগিয়ে চলে গেছি আমাদের গন্তব্যে। ভিন্ন পথে, ভিন্ন বাহনের সঙ্গী হয়ে। একে একে মিডল্যান্ডস, ম্যানচেস্টার, ক্রু পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমাদের যান থামে ল্যান্ডিডনো নামের এক জংশনে, যেখান থেকে চোখ ঘোরালেই দৃষ্টিগোচর হয় সুউচ্চ পাহাড়ি ভূমি, বনাঞ্চল আর স্বচ্ছ জলরাশি। প্রকৃতি এখানে অবারিত, প্রকৃতি এখানে জীবন–ঘনিষ্ঠ।

বিজ্ঞাপন

গাড়ি থেকে নেমেই দেখা মিলল ভাগনে সুদীপের সঙ্গে। যে ওখানেই থাকে। বাঙ্গোর বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশ্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স পড়ছে; সেই সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম হারুন ভাই। যিনি ওখানকার স্থানীয় মানুষ এবং সেলিব্রিটি শেফ। হারুন ভাইয়ের গাড়িতে চড়ে দুচোখে প্রকৃতির দিব্য মায়াঅঞ্জন মেখে পৌঁছলাম ল্যানরস্ট নামের ছোট্ট স্নিগ্ধ এক শহরে। ইংল্যান্ডে আমরা ল্যানরস্টকে হয়তো উচ্চারণ করি ল্যানরস্ট; কিন্তু এখানে এর উচ্চারণ ভিন্ন, ‘ডাবল এল’কে তারা ‘খ’ উচ্চারণ করে।

কনওয়ে নদীর ধারে লেখক
কনওয়ে নদীর ধারে লেখক

এই ফাঁকে একটু বলে নিই, ওয়েলস হলো যুক্তরাজ্যের একটি রাজ্য, যেখানে প্রতি বর্গমাইলে যতগুলো ক্যাসল আছে, পৃথিবীর অন্য কোথাও প্রতি বর্গমাইলে ওই অনুপাতের ক্যাসল নেই। রোমানরা দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছে প্রকৃতিকন্যা ওয়েলসে। ইংল্যান্ডের মহাযোদ্ধা নরম্যান দক্ষিণ ওয়েলসকে দখল করে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করেন দশম শতকের শেষের দিকে। পরে প্রায় বারো শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংলিশ রাজা তৃতীয় হেনরির পুত্র রাজা প্রথম এডওয়ার্ড উত্তর ওয়েলস জয় করে গোটা ওয়েলস তথা কাম্রি রাজ্যকে নিয়ে আসেন যুক্তরাজ্যের অধীনে। আর প্রকৃতির প্রাণপ্রাচুর্য? সেটা ক্রমেই প্রকাশ্য।

বিজ্ঞাপন

ইতিমধ্যে আমরা ফ্ল্যাটে নিজেদের ব্যাকপ্যাক রেখে স্নান সেরে জানালা দিয়ে দূর পাহাড়ের গান শুনছিলাম। এর মধ্যে হারুন ভাই নিজে রান্না করে প্রচুর খাবারদাবার নিয়ে হাজির। ভাবা যায়, এত দূরের এক রাজ্যের ছোট এক শহরে এসে কই মাছের ঝোল, মুরগির মাংস, গলদা চিংড়ির ভুনা দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ, তা–ও সেই রান্না করেছেন ওয়েলসের পদকপ্রাপ্ত সেলিব্রেটি শেফ। হারুন ভাই নিজে একটি রেস্টুরেন্ট চালান ল্যানরস্ট শহরে। তাঁর এই রেস্টুরেন্ট শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রের চৌমুহনায়। নাম আশা বালতি হাউস।

আশা বালতি হাউজের সামনে লেখক
আশা বালতি হাউজের সামনে লেখক
সেলেব্রেটি শেফ হারুনূর রহমানের সঙ্গে লেখক (ডানে)
সেলেব্রেটি শেফ হারুনূর রহমানের সঙ্গে লেখক (ডানে)

যুক্তরাজ্যে অনেক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট চলে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নামে। ল্যানরস্ট শহরের প্রাণকেন্দ্রে হারুন ভাইয়ের আশা বালতি হাউসের সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে বাংলাদেশের নাম। তাঁর রেস্টুরেন্ট পরিচিত বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট নামে। শহরের তিন হাজার তিন শ মানুষসহ আশপাশের হাজারো মানুষ বাংলাদেশকে চেনে হারুন ভাইয়ের রেস্টুরেন্টের নামে। আর উৎসবে, উদ্‌যাপনে তাঁদের রসনা বশ হয় হারুন ভাইয়ের হাতের দুর্দান্ত রান্নায়।

ল্যানরস্ট শহরের চারপাশ ঘিরে রয়েছে উঁচু পাহাড়। আর এর বুক চিরে গেছে কনওয়ে নদী। মাত্র পঞ্চান্ন কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর প্রতিটি নুড়িপাথরে কী পরিমাণ মায়া, তা সেই নদীর পাশে খানিক না বসলে অনুধাবন করা অসম্ভব। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমি, মৌনী আর আরুষি ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম স্নিগ্ধ শান্ত শ্যামাঙ্গী কনওয়ের তীরে। আমার এই দীর্ঘ বিলেতজীবনে বহু অনাবাসী নদীর সঙ্গ লাভ করেছি, কিন্তু এই কনওয়ে নদী যেন নিমেষেই স্থান করে নিল পরাণের অতল গহিনে।

কনওয়ে নদী
কনওয়ে নদী
কনওয়ে নদীর উপরে ব্রিজ
কনওয়ে নদীর উপরে ব্রিজ

কনে দেখা আলোয় আমি আর আরুষি ছোট নুড়ি দিয়ে ঢেউ তোলার চেষ্টা করলাম কনওয়ের স্বচ্ছ জলে, ছোট ছোট ঢেউগুলো যেন জীবনের যাবতীয় অপ্রাপ্তি, দুঃখ আর ক্লান্তি নিয়ে মিলিয়ে গেল অতলে। কনওয়ে নদী যেন মাতৃরূপে ধানসিঁড়ি নদী হয়ে উঠল। অস্তগামী সূর্যের আলোয় আমরা বাসস্থান অভিমুখে হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু প্রচণ্ড ইন্দ্রজালে আচ্ছন্ন এই মনের মধ্যে অনুরণিত হচ্ছিল জীবনানন্দের সেই চরণ: আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়.........। (চলবে)

লেখক: ডক্টর অসীম চক্রবর্তী, গবেষক ও শিক্ষক, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড কম্পিউটিং, এংলিয়া রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যামব্রিজ 

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬: ৫৪
বিজ্ঞাপন