মুহূর্তেই মন ভালো করে দেওয়ার এক অদ্ভুত মন্ত্র ‘শপিং’। কেনাকাটা বা শপিং করতে পছন্দ করেন না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুরূহই বটে। দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন চাপ সামলাতে গিয়ে আমরা কখনো কখনো প্রচণ্ড মানসিক চাপ, বিষণ্নতা বা হতাশায় ভুগি। এই বিষণ্নতা বা মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে মেডিটেশনসহ, নানা ধরনের ব্যায়াম কিংবা পছন্দের কোনো কাজে মনোনিবেশ করেন অনেকে। অনেকে আবার মন ভালো করতে অনলাইনে শপিংয়ের সাইটগুলোতে ঢুঁ মারেন, এমনকি শখের পণ্যটি কিনেও ফেলেন। আবার কখনো কখনো মন ভালো করতে কেউ কেউ চলে যান শপিং মলে, প্রয়োজন ছাড়া একগাদা কেনাকাটা করে খুশি মনে বাসায় ফেরেন।
কিন্তু কেউ যদি হতাশা কিংবা মানসিক চাপ সামলাতে বা সাময়িক আনন্দের লোভে অতিরিক্ত কেনাকাটার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
এমনকি সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনই ব্যস্ত থাকেন শপিংয়ে। তবে ধীরে ধীরে কেনাকাটায় আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেখা যাবে নিজেকে কোনোভাবেই কেনাকাটা থেকে দূরে রাখা যাচ্ছে না।
অবস্থা যদি এমন হয়, তাবে সেই ব্যক্তিকে ‘শপাহলিক’ বা ‘কেনাকাটায় আসক্ত’ বলে ধরে নিতে হবে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে ‘শপাহলিক’ হওয়া একটি রোগ, যার আভিধানিক নাম ‘কমপালসিভ বায়িং ডিসঅর্ডার’।
সমীক্ষা বলছে, যাঁরা এ রকম কেনাকাটায় আসক্ত, তাঁরা বড় ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। নিজের অজান্তেই তাঁরা অনেক কিছু কিনে ফেলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেনাকাটায় আসক্ত ব্যক্তিদের শপিংয়ের সময় মস্তিষ্ক থেকে ‘ডোপামিন’ নামক একধরনের হরমন নিঃসরিত হয়, যা আনন্দ–বেদনার সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ ওই ব্যক্তি যত বেশি শপিং করেন, তত বেশি আত্মিক তৃপ্তি লাভ করেন।
এ কারণে কেনাকাটার ক্ষেত্রে তাঁরা লাগাম টানতে পারেন না এবং শপিংয়ে তাঁদের কোনো সীমা–পরিসীমা থাকে না। বর্তমানে অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটায় এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। গবেষণা বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো থেকে ব্যবহারকারীর অভিরুচি সহজেই জেনে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতারা এবং যখনই কেউ কোনো ডিভাইসের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে যাচ্ছেন, তখন বিজ্ঞাপনদাতারা ব্যক্তির পছন্দের পণ্যগুলো তাঁর সামনে নিয়ে আসে বারবার। আর এসব কারণে শপাহলিকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এই যে হতাশা বা মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে শপিংয়ের আশ্রয় নেওয়া। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটি ‘রিটেল থেরাপি’ বা ‘শপিং থেরাপি’ নামে পরিচিত। গান কিংবা পছন্দের বই যেমন আমাদের বিষণ্নতা থেকে মুক্তি দিতে পারে, তেমনি রিটেল থেরাপিও হয়ে উঠতে পারে আমাদের মানসিক চাপ নিরসনের উপায়। রিটেল থেরাপি আমাদের আবেগজনিত চাপ কমায় এবং মস্তিষ্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা মানসিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে।
কিন্তু সব সময় হতাশা বা বিষণ্নতা রুখতে রিটেল থেরাপির সাহায্য নেওয়া আদৌ কি যৌক্তিক। বিশেষজ্ঞদের মতে, মন ভালো করতে সব সময় রিটেল থেরাপির ওপর নির্ভরশীল হওয়া ঠিক নয়। হতাশা বা মানসিক চাপ নিরসনের আরও অনেক উপায় রয়েছে, সেগুলোও বেছে নিতে হবে। এ ছাড়া উদ্দেশ্যহীন অতিরিক্ত শপিংয়ের ফলে কেনাকাটায় আসক্ত ব্যক্তি অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে পারেন। তাই পরিস্থিতি অন্য দিকে গড়ানোর আগেই সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
কেনাকাটার আসক্তি থেকে দূরে থাকতে অন্য কোনো শখ বা পছন্দের কাজ বেছে নিতে হবে। হতে পারে সেটা ঘরের কোনো কাজ, বই পড়া, ব্যায়াম, গল্প করা কিংবা যেকোনো কিছু। এসব কাজে মনোনিবেশ করলে কেনাকাটার বিষয়টি অনেকাংশেই ভুলে থাকা সম্ভব। তবে এ কাজগুলো হতে হবে ধারাবাহিক।
ইচ্ছা হলেই কিনতে হবে, এ ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কোনো কিছু কেনার আগে অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত, জিনিসটি কেনা আসলেই প্রয়োজন কি না। কোনোভাবেই প্রবৃত্তির কাছে বশ মেনে নেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে যোগব্যায়াম করা যেতে পারে। নিয়মিত যোগব্যায়াম আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি মেজাজ স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।
কেনাকাটার আসক্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখার অন্যতম একটি উপায় ‘উইন্ডো শপিং’। উইন্ডো শপিং মানে হলো কোনো কিছু কেনার উদ্দেশ্যে বের হননি, কিন্ত একটু ঘোরাঘুরি করে ছোটখাটো কিছু কিনে মনের সাধ মেটানো। ধীরে ধীরে শপিং–আসক্তি দূর করতে এটি একটি কার্যকর উপায়। আসক্তি দূর করার পাশাপাশি উইন্ডো শপিং মানসিক প্রশান্তি প্রদান করে মনকে করে তোলে ফুরফুরে।তবে এ রোগ শুরুতেই সামাল দেওয়া না গেলে অতিসত্বর কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে কাউন্সেলিং করানো উচিত।
তথ্যসূত্রঃ টাইম ম্যাগাজিন, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, হেলথসটস
ছবি: পেকজেলসডটকম