প্রাকৃতিক সমাধানে দূর হবে অনিদ্রার  সমস্যা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

পাঠকদের ধন্যবাদ ধৈর্য নিয়ে আমার লেখা পড়ার জন্য। আমি অটিজম, এডিএইচডি, লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটিতে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে যেমন কাজ করি, তেমনি আমরা আবার জেনারেশন–জির কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীদের নিয়েও কাজ করছি। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা যেমন রাতে ঘুমাতে পারে না বা চায় না, তেমনি জেনারেশন–জিরাও ঘুমাতে পারে না বা চায় না।

সুস্থ জীবনের জন্য ঘুমের বিকল্প নেই
সুস্থ জীবনের জন্য ঘুমের বিকল্প নেই

আমার কাছে অনেক রোগী আসে, তাদের ফোকাস ঠিক করে দেওয়ার জন্য। সম্প্রতি এমন একটি তরুণী আমার কাছে এসেছিল, যে নাকি প্রায় দুই বছর ধরে ঘুমাতে পারত না। অথচ সে আমার কাছে ঘুম না হওয়ার চিকিৎসা নিতে আসেনি; বরং এসেছিল অন্য সমস্যা সমাধানের জন্য। আর তা হলো, সে ভুলে যাচ্ছে এবং প্রচুর পরিমাণে চুল পড়ছে। এ ছাড়া তার ত্বকে নানা রকম রোগ দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি কয়েক মাস ধরে হ্যালুসিনেশনে ভুগছে। সে বলেছে যে নিচের তলার লোকজন তাকে নিয়ে সমালোচনা করছে; আর সেটা সে শুনতে পাচ্ছে। অথচ তার পরিবার আমাকে জানায় আসলে এমন কিছু ঘটেনি। সে স্কুল ও কলেজে খুব ভালো ফল করলেও মনোযোগ ধরে রাখা ও মনে রাখার অভাবে অনার্স প্রথম বর্ষের সব পরীক্ষায় ফেল করে।

বিজ্ঞাপন

গত কিছু পর্বে আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি আপনাদের সময়মতো এবং দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমানো যে খুব জরুরি, তা বোঝানোর জন্য। আমার লেখা পড়ে থাকলে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এই জেন–জি তরুণীটির এসব সমস্যার কারণ কী ছিল। আমি তার চিকিৎসা করার পর সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছে।

আমার চিকিৎসার যে কয়েকটি পর্যায় ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল তার জীবনে ঘুম আবার ফিরিয়ে আনা। আমি এর আগে লিখেছি যে আমি কীভাবে ঘুমের পরিমাণ বাড়িয়ে আমার নিজের ছেলেকে লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছি। এই তরুণীও ধীরে ধীরে ফিরে গেছে তার স্বাভাবিক জীবনে এবং সে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। তার চুল পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, ত্বকের সতেজতা ফিরেছে এবং তার হ্যালুসিনেশনও বন্ধ হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

রাতে জেগে থাকা এবং রাতে ঘুমের পরিমাণ কমে যাওয়ার সঙ্গে জেন–জিদের খাদ্যাভ্যাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাত জাগা জেন–জিদের খাবারে সাধারণত শর্করা বা মিষ্টি খাবারের মাত্রা বেশি থাকে, প্রোটিনজাতীয় খাবার খুব কম থাকে, পানির পরিমাণ কম থাকে, ভাজাপোড়া খাবার বেশি থাকে। কফি, চা বা ক্যাফেইন আছে, এমন পানীয় এবং তাতে চিনির পরিমাণ বেশি থাকে। তারা ফ্রায়েড চিকেন বা এ ধরনের ফাস্ট ফুড বেশি খায়; এসব খাবারের প্রোটিন ডিন্যাচারালাইজড হয়ে থাকে এবং এই চিকেনের প্রোটিন শরীরের কোনো উপকারে আসে না। ভালো মানের প্রোটিন যেমন মাছ, বাদাম, কম মসলা দিয়ে রান্না করা মাংস দীর্ঘ সময় ধরে গভীরভাবে ঘুমাতে সহায়তা করে।
ঘুমে সমস্যা হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো মাঝরাতে খাওয়া এবং ঘুমাতে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে খাবার খাওয়া। শর্করাজাতীয় খাবার হাইগ্লাইসেমিক ফুড হওয়ার কারণে বিপাকে সমস্যা হয় এবং রক্তে চিনির পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যায়। এতে শরীরে তাপ উৎপাদন বেড়ে যায়। ফলে ঘুমাতে সমস্যা হয়।

ফাস্ট ফুড হজমে ব্যঘাত ঘটায় তাই সন্ধ্যার পর না খাওয়াই শ্রেয়
ফাস্ট ফুড হজমে ব্যঘাত ঘটায় তাই সন্ধ্যার পর না খাওয়াই শ্রেয়

তাই ইনসমনিয়া থেকে মুক্তির জন্য সন্ধ্যার পর থেকে মিষ্টিজাতীয় খাবার, কফি, ভাজাপোড়া, ফাস্ট ফুড বন্ধ করে দিতে হবে। এ ধরনের খাবারের বিপাক প্রক্রিয়া খুব কঠিন এবং বিপাকে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। পর্যাপ্ত পানি ও আঁশজাতীয় খাবারের অভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য তৈরি হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে পেট ফোলাভাব, গ্যাস ও অস্বস্তি হতে থাকে। ফলে মেলাটোনিন ও সেরোটোনিনের মতো হরমোনের ভারসাম্যহীনতা শুরু হয়। এতে ঘুমের চক্রে প্রভাব ফেলে এবং অনিদ্রার সৃষ্টি হয়।

এ জন্য সন্ধ্যার পর থেকে মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে এর বদলে বেশি করে সবজির স্যুপ, মাছের স্যুপ এবং মরিচ ও মসলাহীন সহজপাচ্য খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য প্রতিদিন পাকা পেঁপে বিচিসহ খাবেন, খাবারের পর ত্রিফলা চূর্ণ খাবেন সামান্য গরম পানি মিশিয়ে, ঢ্যাঁড়সকে কেবল লবণ ও তেল দিয়ে সিদ্ধ করে আঁশগুলো ফেলে দিয়ে সেই পানি সারা দিন ধরে পান করতে থাকুন। এতে নিয়মিত পায়খানা হওয়া শুরু হবে এবং শরীরের অন্তর্বর্তী তাপমাত্রা কমে যাবে এবং ঘুমানো সহজ হবে।

সন্ধ্যার পর স্যুপ খাওয়াই ভাল
সন্ধ্যার পর স্যুপ খাওয়াই ভাল

শিফট কর্মীদের নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, তারা রাতে ঘুমাতে না পারলেও ৩০ ভাগ মানুষ সকালে, ৪০ ভাগ মানুষ সকাল বা বিকেলে এবং ৩০ ভাগ মানুষ সন্ধ্যায় ঘুমাতে পারে। আপনি কোন ধরনের, তা জেনে নিয়ে সে সময়ে ঘুমানোর চেষ্টা করুন এবং মস্তিষ্ককে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করুন।

প্রাকৃতিক আলোর এক্সপোজার এবং ঘুমের সারকাডিয়ান রিদম রিসেট করতে প্রথমে ঘরে ডিম লাইট জ্বালিয়ে আলো-আঁধারির একটি আবহ তৈরি করুন। কিছুক্ষণ পর বাতি বন্ধ করে দেন। এতে করে ঘুম ভালো হবে এবং লম্বা সময় ধরে হবে। শারীরিক পরিশ্রম শুরু করুন। কারণ, যত বেশি পরিশ্রম করবেন তত বেশি এডিনোসিন তৈরি হবে এবং শরীর ক্লান্তি অনুভব করবে, যা আপনাকে সহজে ঘুমাতে সাহায্য করবে।

রাতে ঘুম ভেঙে গেলে ফোন চালু করা যাবে না
রাতে ঘুম ভেঙে গেলে ফোন চালু করা যাবে না

অনিদ্রা থেকে রক্ষার জন্য ঘুমের পরিবেশ ঠিক করুন। কালো পর্দা, চোখের মাস্ক এবং ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করুন। ঘরের তাপমাত্রা যত কমানো সম্ভব কমিয়ে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করুন। একটি অন্ধকার, শান্ত ও শীতল ঘুমের পরিবেশ তৈরি করুন। আর ঘুমের জন্য সতেজ বাতাস অবশ্যই খুব জরুরি। জানালা সামান্য খুলে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে কমপক্ষে বিশবার গভীরভাবে নাক দিয়ে শ্বাস টানুন এবং ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন।

রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আবার লম্বা করে শ্বাস নিন ও প্রশ্বাস ছাড়ুন। ঘুম না এলেও ফোন চালু করবেন না। ঘুম থেকে জাগার পর ব্রেন ওয়েভ থাকে ডেলটা লেভেলে এবং ফোনের নীল আলো একঝটকায় সেখান থেকে আলফা লেভেলে নিয়ে আসে, যা ব্রেনকে সিগন্যাল দেয় যে সকাল হয়ে গেছে। এ জন্য পুনরায় ঘুম আসতে খুব সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে ইউটিউব থেকে ডেলটা মিউজিক রেকর্ড করে রাখুন এবং তা ছেড়ে দিন। ঘুমের তৃতীয় ধাপে স্লো ওয়েভ চলে, যা ঘুমকে গভীরতর স্তরে নিয়ে যায়। তাই ডেলটা ওয়েভ আপনাকে সাহায্য করবে মেলাটোনিন তৈরি করতে এবং স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে ঘুমের রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।

লেখক: একাধারে নেচারোপ্যাথিক ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, কিনেজিওলজিস্ট, ট্রমা রিলিজ থেরাপিস্ট, অটিজম স্পেশালিস্ট, মাইন্ড সেট ট্রেইনার। তিনি কাজ করছেন লন্ডনের ১০, হারলে স্ট্রিট ক্লিনিক এবং অনলাইনেও আছে তাঁর উপস্থিতি।
ই–মেইল: [email protected]
ছবি: পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৬: ০০
বিজ্ঞাপন