শিফট কর্মীদের মস্তিষ্ক দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছে কম ঘুমের কারণে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

শিফট কর্মী কারা? কেন তাদের নিয়ে ২৪ বছর ধরে এত গবেষণা শুরু হয়েছে? স্মার্ট ডিভাইস ও কম্পিউটারের প্রচারের সঙ্গে মিলেনিয়াম প্রজন্ম গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক সব ধরনের সুবিধা নিয়ে। বিশ্ববাসীর সামনে খুলে দেওয়া হয়েছে দিনরাত ২৪ ঘণ্টার সেবা পাওয়ার সুবিধা। টেলিভিশন, সংবাদপত্র, হাসপাতাল, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান, কম্পিউটার ফার্ম, সুপারমার্কেট এমনকি অনেক খাবারের দোকানও এখন দিনরাত খোলা থাকে। মানুষ বেশি রোজগারের সুযোগ পাওয়ার কারণে ওভারটাইম কাজ করছে বা দু-তিন জায়গায় কাজ করছে।

নানা পেশার শিফট কর্মীদের নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে
নানা পেশার শিফট কর্মীদের নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে

জেনারেশন জি এবং জেনারেশন আলফা তাদের মা–বাবা, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের থেকে দেখে শিখেছে এবং তারা নিজেরা ও তাদের বন্ধুবান্ধবও এখন শিফট কর্মী হিসেবে নিয়োজিত হচ্ছে। ইংল্যান্ডে ২৭ শতাংশ মানুষ তার মানে ৮৭ লাখ এবং আমেরিকায় আড়াই কোটি মানুষ শিফট কর্মী হিসেবে নিয়োজিত। শুধু ইংল্যান্ডে গত পাঁচ বছরে দেড় লাখ শিফট কর্মী বেড়েছে, যারা রাতের শিফটে কাজ করে এবং রাত-সকাল–দুপুরের মিশ্রিত শিফটে কাজ করে। এর মধ্যে ডাক্তার, নার্স, কেয়ারগিভার, ড্রাইভার, সাংবাদিক, টেলিভিশন কর্মী, পুলিশ, আইটি কর্মীদের সংখ্যা বেশি এবং এসব পেশার শিফট কর্মীদের নিয়ে হয়েছে এবং হচ্ছে নিয়মিত গবেষণা।

বিজ্ঞাপন

২০০৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৮টি গবেষণা হয়েছে শিফট ওয়ার্কারদের নিয়ে। এসব গবেষণায় ১৮ হাজার ৮০২ জন শিফট কর্মী অংশগ্রহণ করেছে। শিফটে কাজ করার কারণে কর্মীদের শরীরে কী প্রভাব পড়ে, তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে এসব গবেষণার মাধ্যমে।

রাতে না ঘুমানোর কারণে সরাসরি শারীরিক, মানসিক ও স্মরণশক্তিজনিত রোগের পরিমাণ বাড়ছে
রাতে না ঘুমানোর কারণে সরাসরি শারীরিক, মানসিক ও স্মরণশক্তিজনিত রোগের পরিমাণ বাড়ছে

গবেষণাগুলোয় দেখা গেছে, রাতের বেলা না ঘুমানোর কারণে সরাসরি শারীরিক, মানসিক ও স্মরণশক্তিজনিত রোগের পরিমাণ শিফট কর্মীদের মধ্যে বেশি। যারা কেবল দিনে কাজ করে, তাদের সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানের রাতের কর্মীদের মধ্যে তুলনায় দেখা গেছে, যারা শিফটে কাজ করে তাদের মস্তিষ্ক একই বয়সের কর্মীদের তুলনায় সাত বছর বেশি বুড়িয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

আমরা জানি যে মস্তিষ্ক যত বুড়ো হবে তত কম কগনেটিভ ফাংশন করতে পারবে। মানুষের দৈনন্দিন কাজ করার ক্ষমতা কমে যায় এবং ভুলে যাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। আরও যে ভয়াবহ ফল প্রকাশ পেয়েছে তা হলো, যারা দিন ও রাত মিলিয়ে কাজ করে তাদের মস্তিষ্ক খুব দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের ফোকাস করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, চিন্তা করার গতি কমে যাচ্ছে, স্মরণশক্তি কমে যাচ্ছে, ইম্পালস কন্ট্রোল এবং কোন সিচুয়েশনে কেমন রেসপন্স করবে তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে।

রাতে যারা কাজ করে তাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশি বুড়িয়ে যায়
রাতে যারা কাজ করে তাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশি বুড়িয়ে যায়

ফ্রান্সেও ৩ হাজার ২৩২ জন শিফট কর্মীর মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে জানা গেছে, যারা শিফট কাজ করে তাদের মস্তিষ্ক একই বয়সের দিবাকর্মীদের  তুলনায় সাত বছরের বেশি বুড়িয়ে যায়। ১০ বছর ধরে ১ হাজার ৪৮৪ জন শিফট কর্মীর প্রাত্যহিক জীবন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, তাদের কগনিটিভ স্কোর ছিল ৫৩ দশমিক ৩ এবং স্মরণশক্তির স্কোর ছিল ৪৮ দশমিক ৫; যেটা তুলনামূলকভাবে বেশ কম। এ ছাড়া শারীরিকভাবে শিফট কর্মীরা উচ্চ রক্তচাপ, মেটাবলিক ডিজঅর্ডার, হরমোনাল ইমব্যালান্স, আর্লি ডিমেনসিয়া, ঘুমের সমস্যায় ভুগছে। তাদের আরেকটি সাধারণ বিষয় হলো ফ্যাটিগ বা ক্রনিক অবসাদ।

অনিয়মিত ঘুমের ধরন শিফট কর্মীদের শরীরের সার্কাডিয়ান ছন্দে ব্যাঘাত ঘটায়। ঘুম আলোর এক্সপোজার, খাওয়ার সময় এবং অন্যান্য পরিবেশগত সংকেত দ্বারা প্রভাবিত হয়। শরীরের তাপমাত্রা আর হরমোন নিঃসরণের মতো শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার জিন নিয়ন্ত্রণেও ঘুম ভূমিকা রাখে। শিফট কর্মীরা প্রায়ই তাদের শরীরের স্বাভাবিক ঘড়ির সঙ্গে তাদের ঘুমের সময়সূচি মেলাতে পারে না; এতে করে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।

ঘুম তাড়ানোর জন্য শিফট কর্মীরা সাধারণত ক্যাফেইন–জাতীয় খাবার খায় এবং পানীয় পান করে, যা পিএইচ ব্যালান্সের ওপর প্রভাব ফেলে। ঘুমানোর আগে শিফট কর্মীরা সাধারণত উচ্চ গ্লাইসেমিক শর্করা–জাতীয় খাবার খায়, যা শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। খাবার খেয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে ঘুমাতে চলে যায় ক্লান্তির কারণে এবং ঘুমের ভেতর বিপাক প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বিপাকের কারণে ঘুমের স্তরগুলোতে ব্যাঘাত ঘটতে থাকে, যা কার্বোহাইড্রেটের হজম প্রক্রিয়ার কারণে ঘটে। নিয়ম হলো, আমরা ঘুমালে আমাদের পাকস্থলীও ঘুমাবে। তাই ঘুমের সার্কাডিয়ান ক্লক বা বডি ক্লক বা দেহঘড়ি খাবারের সময়ের সঙ্গেও জড়িত।  

গবেষণায় দেখা গেছে, আধুনিক যুগে মানুষ যেহেতু রাতে ঘুমাতে পারে না, তাই আমাদের শরীর বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে নিয়েছে। শরীর আপ্রাণ চেষ্টা করে রাত ছাড়া অন্য যে সময়ই মানুষ ঘুমাক না কেন, তখন ঘুমের স্তরগুলো সম্পন্ন করতে। শিফট কর্মীদের বেলায় তাদের বডি ক্লক বা দেহঘড়ি দিনের বিভিন্ন ভাগের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে সেভাবে ঘুমের সাইকেল সম্পন্ন করার চেষ্টা করে।

অনিয়মিত ঘুমের কারণে স্ট্রেসের মাত্রা বেড়ে যায়
অনিয়মিত ঘুমের কারণে স্ট্রেসের মাত্রা বেড়ে যায়

গবেষণা বলছে, ৩০ শতাংশ মানুষ হলো মর্নিং টাইপ, ৪০ শতাংশ মর্নিং ও ইভিনিং মেশানো আর বাকি ৩০ শতাংশ হলো ইভিনিং টাইপ। যে মানুষ যে ধরনের, সে যদি সে সময়ে ঘুমাতে পারে, তাহলেও মস্তিষ্ককে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু শিফট কর্মীদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না। কারণ, তারা কোনো দিন রাতে, কোনো দিন সকালে আবার কোনো দিন দুপুরে ঘুমাতে যায়; এতে তাদের শরীর ও মস্তিষ্ক উভয়েরই যথেষ্ট ক্ষতি হয়। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবে ক্যালসিয়াম বেশি জমা হয়। অনিয়মিত ঘুমের কারণে স্ট্রেসের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে প্রচুর পরিমাণে করটিসল হরমোন নিঃসরণ হয়। এতে করে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়।

ঘুমের ছয়টা সাইকেল থাকে। যদি ঘুমের ভিন্ন ভিন্ন স্তরের ভেতর আলফা, বিটা, গামা, থিটা, ডেল্টা ওয়েভগুলো ঠিকমতো নিঃসরিত না হয়, কিংবা হরমোনগুলো নিঃসরিত না হয়, ঘুমের ভেতরেও যদি স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ হতে থাকে তাহলে সেরোটোনিন, মেলাটোনিন নিঃসরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ঘুম ঠিকমতো হলে ট্রিপটোফ্যানের মাত্রা বাড়ে এবং ঘুম মেলাটোনিন উৎপাদনে সহায়তা করে। কিন্তু ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলে রোগ প্রতিরোধের জন্য মেটাবোলিজমের কাইনুরেনিন পাথওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ট্রিপটোফ্যানের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে করে মস্তিষ্কে নানা ধরনের নিউরোটক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হয়। ফলে মস্তিষ্ক মনে রাখার ক্ষমতা, সৃষ্টিশীল চিন্তা ও কাজের ক্ষমতা হারাতে থাকে। ঘুম ভাঙলে মানুষ ঘড়ি দেখে। ফোন দেখে।

এতে করে ঘুমের বিঘ্ন ঘটে। আবার অনেকের ঠিকমতো ঘুম হয় না। তারা ঘুম হবে না ভেবে আরও চিন্তিত হয়। না ঘুমাতে পারার ভয়ে সাবকনশাস মাইন্ড ঘুমাতে পারে না।
শিফট কর্মীদের উচিত দীর্ঘদিন ধরে শিফটের কাজ না করা। আর যদি করতেই হয় তাহলে হয়তো দিনে বা রাতে বা দুপুরের শিফট নিয়ে কাজ করা। রাত, দিন, সকাল, দুপুর মিলিয়ে কাজ করার মানে হলো নিজের মস্তিষ্কে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগের মতো। এই বিষক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে নিজের শরীর, মন ও মস্তিষ্ককে।

লেখক: একাধারে নেচারোপ্যাথিক ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, কিনেজিওলজিস্ট, ট্রমা রিলিজ থেরাপিস্ট, অটিজম স্পেশালিস্ট, মাইন্ড সেট ট্রেইনার। তিনি কাজ করছেন লন্ডনের ১০, হারলে স্ট্রিট ক্লিনিক এবং অনলাইনেও আছে তাঁর উপস্থিতি।
ই–মেইল: [email protected]
ছবি: পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৬: ০০
বিজ্ঞাপন