জেনে নিন প্রোবায়োটিকের দারুণ উৎস পান্তাভাতের ভালো–মন্দ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

পান্তাভাত, যা ফার্মেন্টেড চাল বা ভাত নামেও পরিচিত, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের (বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম) একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। এটি সাধারণত রান্না করা ভাতকে পানিতে ভিজিয়ে রেখে ১২–১৪ ঘণ্টা ফার্মেন্টেশনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এর পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি সবার জন্য উপযোগী নয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর উপকারিতা, অপকারিতা এবং কারা এড়িয়ে চলবেন, তা বিস্তারিতভাবে দেখা যাক।

বিজ্ঞাপন

পান্তাভাত খাওয়ার উপকারিতা

পান্তাভাতের উপকারিতা ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ার কারণে বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়ায় ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া (LAB) ভাতের শর্করা ভেঙে বিভিন্ন উপকারী যৌগ তৈরি করে।

প্রোবায়োটিক উৎস

বৈজ্ঞানিক ভিত্তি: ফার্মেন্টেশনে ল্যাকটোব্যাসিলাস ও বিফিডোব্যাকটেরিয়াম জাতীয় ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পায়। এগুলো প্রোবায়োটিক হিসেবে কাজ করে, যা অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমকে সুস্থ রাখে।
উপকার: হজমশক্তি বাড়ায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং IBS (Irritable Bowel Syndrome)–এর মতো সমস্যায় সাহায্য করে। ২০১৫ জার্নাল অব অ্যাপলায়েড মাইক্রোবায়োলজির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফার্মেন্টেড খাবারের প্রোবায়োটিক অন্ত্রের প্রদাহ কমায়।

পান্তা হজমশক্তি বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
পান্তা হজমশক্তি বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে

ভিটামিন ও খনিজের শোষণ বৃদ্ধি

বৈজ্ঞানিক ভিত্তি: ফার্মেন্টেশনে ফাইটিক অ্যাসিড (যা খনিজ শোষণে বাধা দেয়) ভেঙে যায়। ফলে আয়রন, জিঙ্ক ও ম্যাগনেসিয়ামের জৈব লভ্যতা বাড়ে।
 উপকার: রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, ফার্মেন্টেড ভাতে আয়রনের শোষণ সাধারণ ভাতের তুলনায় ২০–৩০% বেশি হতে পারে (ফুড কেমিস্ট্রি, ২০১৭)।

বিজ্ঞাপন

শক্তি ও হাইড্রেশন

বৈজ্ঞানিক ভিত্তি: ফার্মেন্টেশনে স্টার্চ সরল শর্করায় (গ্লুকোজ) রূপান্তরিত হয়, যা দ্রুত শক্তি দেয়। পানির সঙ্গে খাওয়ায় ইলেকট্রোলাইট (সোডিয়াম, পটাশিয়াম) ভারসাম্য রাখে।
উপকার: গ্রীষ্মে ক্লান্তি দূর করতে এবং শ্রমিকদের জন্য দ্রুত শক্তির উৎস হিসেবে উপযোগী।

ইমিউনিটি বৃদ্ধি

বৈজ্ঞানিক ভিত্তি: প্রোবায়োটিক এবং ফার্মেন্টেশনে উৎপন্ন বি ভিটামিন (B6, B12) ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
 উপকার: সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।

পান্তাভাত যাঁদের জন্য নয়

যদিও পান্তাভাতের উপকারিতা আছে, ফার্মেন্টেশনের কারণে এটি সবার জন্য নিরাপদ নয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের এটি এড়িয়ে চলা উচিত:

দুর্বল ইমিউন সিস্টেম যাদের

বৈজ্ঞানিক কারণ: ফার্মেন্টেশন খোলা পরিবেশে হলে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া (Escherichia coli, Salmonella) বা ছত্রাক (Aspergillus) দূষণের ঝুঁকি থাকে। যাদের ইমিউনিটি কম, তাদের জন্য এটি ফুড পয়জনিং বা ইনফেকশনের কারণ হতে পারে।
উদাহরণ: এইচআইভি রোগী, ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তি, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের রোগী। অস্বাস্থ্যকর ফার্মেন্টেশনে প্যাথোজেন বৃদ্ধির ঝুঁকি ১০-১৫% বেশি (ফুড মাইক্রোবায়োলজি, ২০১৯)।

গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিড রিফ্লাক্স আছে যাদের

ফার্মেন্টেশনে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়, যা পাকস্থলীতে অ্যাসিডিটি বাড়াতে পারে। এটি গ্যাস্ট্রাইটিস বা GERD (Gastroesophageal Reflux Disease)–এর সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। বুক জ্বালাপোড়া, পেটফাঁপা হতে পারে। ফার্মেন্টেড খাবার অ্যাসিড রিফ্লাক্স রোগীদের ৩০% ক্ষেত্রে অস্বস্তি বাড়ায় (জার্নাল অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, ২০২০।

ডায়রিয়া বা আইবিএস (IBS) রোগী

প্রোবায়োটিক উপকারী হলেও অতিরিক্ত ফার্মেন্টেড খাবার অন্ত্রে গ্যাস উৎপাদন বাড়ায় এবং ডায়রিয়া বা পেটে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।
যাঁরা এড়িয়ে চলবেন: যাঁদের আইবিএসডি (Diarrheapredominant IBS) বা ক্রনস ডিজিজ আছে। অনেক ক্ষেত্রে আইবিএস রোগীদের পান্তা অনেক ভালো খাবার কিন্তু সেটা প্রাথমিক অবস্থায় থাকলে উপকার পাবেন। ২০১৮ সালে গাট মাইক্রোবসের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ফার্মেন্টেড খাবার ২০% IBS রোগীর উপসর্গ বাড়িয়ে দেয়।

অ্যালার্জি বা সংবেদনশীলতা

ফার্মেন্টেশনে হিস্টামিন বা অন্যান্য বায়োজেনিক অ্যামাইন তৈরি হতে পারে, যা অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া (চুলকানি, ফুসকুড়ি) সৃষ্টি করে।
যাঁরা এড়িয়ে চলবেন: যাঁদের হিস্টামিন অসহিষ্ণুতা (histamine intolerance) আছে। ২০১৬ সালে অ্যালার্জি জার্নালে বলা হয়েছে, ফার্মেন্টেড খাবারে হিস্টামিন সংবেদনশীল ব্যক্তিদের ১৫% ক্ষেত্রে সমস্যা হয়।

পান্তার সঙ্গে কিছু সংযোজন চলতেই পারে
পান্তার সঙ্গে কিছু সংযোজন চলতেই পারে

কিডনি রোগী

পান্তাভাতে লবণ (সোডিয়াম) যোগ করা হলে সেটা কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফার্মেন্টেশনে পটাশিয়ামের মাত্রাও বাড়তে পারে।
যাঁরা এড়িয়ে চলবেন: ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD) বা ডায়ালাইসিসের রোগী। উচ্চ সোডিয়াম কিডনি রোগীদের রক্তচাপ ও ফ্লুইড ধরে রাখার সমস্যা বাড়ায় (কিডনি ইন্টারন্যাশনাল, ২০২১)।

যাঁরা খেতে পারবেন?

সুস্থ ব্যক্তি, যাঁরা গ্রীষ্মে হাইড্রেশন ও শক্তি চান, হজমে সমস্যা নেই এমন ব্যক্তি, প্রোবায়োটিকসমৃদ্ধ খাবারে অভ্যস্ত ব্যক্তি।

পান্তাভাত প্রোবায়োটিক, ভিটামিন এবং শক্তির একটি ভালো উৎস, তবে এর ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়া এবং প্রস্তুতির ধরনের ওপর নির্ভর করে এটা কিছু মানুষের জন্য অসুবিধাজনক বা ক্ষতিকর হতে পারে। পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে এবং নিজের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে খাওয়া উচিত। পান্তাভাত থেকে সর্বোচ্চ উপকার পেতে হলে এটি সঠিকভাবে তৈরি, সংরক্ষণ এবং খাওয়ার পদ্ধতি অনুসরণ গুরুত্বপূর্ণ। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর উপকারিতা (প্রোবায়োটিক, ভিটামিন, শক্তি) সঠিক প্রক্রিয়ায় বজায় থাকে এবং অপকারিতা (দূষণ, অ্যাসিডিটি) এড়ানো যায়। নিচে বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছি কীভাবে পান্তা খেলে ভালো উপকার পাওয়া যায়।

পান্তাভাত তৈরির সঠিক পদ্ধতি

আঁশযুক্ত চাল (ব্রাউন বা লাল চাল) ব্যবহার করলে ফাইবার ও পুষ্টি বেশি পাওয়া যায়। তবে সাদা চালও ব্যবহার করা যায়, বিশেষ করে যদি হজমে সহজতা চান। বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করুন। ফুটিয়ে ঠান্ডা করা পানি দিলে দূষণের ঝুঁকি কমে। ১২-১৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। গ্রীষ্মে ১২ ঘণ্টা এবং শীতে বেশি সময় লাগে। মাটির পাত্র ব্যবহার করলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং ফার্মেন্টেশন ভালো হয়।

পান্তা খেতে হলে তৈরি ও খাওয়ার সঠিক নিয়ম মানতে হবে
পান্তা খেতে হলে তৈরি ও খাওয়ার সঠিক নিয়ম মানতে হবে

কখন খাবেন

প্রোবায়োটিক সকালে খালি পেটে খেলে অন্ত্রে ভালোভাবে কাজ করে। এটি হজমশক্তি বাড়ায় এবং দিনভর শক্তি দেয়। গরমে ডিহাইড্রেশন রোধে পান্তাভাতের পানি ইলেকট্রোলাইট হিসেবে কাজ করে। তবে রাতে খাওয়া এড়িয়ে চলুন, কারণ রাতে হজম ধীরে হয় এবং অ্যাসিডিটির ঝুঁকি বাড়ে।

কীভাবে খাবেন

১০০-১৫০ গ্রাম (এক কাপ) পান্তাভাত দিনে একবার খান। অতিরিক্ত খেলে পেটফাঁপা বা গ্যাস হতে পারে। সামান্য লবণ যোগ করলে স্বাদ বাড়ে এবং সোডিয়ামের ভারসাম্য থাকে। পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ বা লেবু, এগুলো অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি যোগ করে, যা ইমিউনিটি বাড়ায়। সামান্য তেলযুক্ত আচার বা ভর্তা ফ্যাটদ্রবণীয় ভিটামিন (এ, ডি, ই) শোষণে সাহায্য করে। পান্তার সঙ্গে থাকা পানি ছেঁকে না ফেলে খান। এতে প্রোবায়োটিক ও ইলেকট্রোলাইট থাকে।
 
সতর্কতা: দুধ বা দইয়ের সঙ্গে না খাওয়াই ভাল। কারণ অতিরিক্ত ফার্মেন্টেশন উপাদানের কারণে পেটে অস্বস্তি করতে পারে। পান্তাভাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খেয়ে ফেলুন। বেশি সময় রাখলে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া (Clostridium botulinum) বা মাইকোটক্সিন তৈরি হতে পারে।

পান্তাভাত থেকে যথাযথ উপকার পেতে পরিচ্ছন্নতা, ফার্মেন্টেশনের সঠিক সময়, পরিমিত খাওয়া এবং শরীরের সঙ্গে মানানসই করা জরুরি। সকালে হালকা সংযোজনের সঙ্গে খেলে এর প্রোবায়োটিক, শক্তি ও হাইড্রেশনের উপকার সবচেয়ে ভালোভাবে পাওয়া যায়। তবে শরীরে কোনো অস্বস্তি হলে পরিমাণ কমান বা বন্ধ করুন।

ইলিশ দিয়ে পান্তাভাত বৈশাখী পান্তা হবে; কিন্তু পান্তার উপকারী চরিত্র থাকবে না। তবে এক দিন খাওয়াই যায়। তবে মনে রাখতে হবে এই সময়টা ইলিশের ব্রিডিং টাইম। তাই এড়িয়ে চলা উচিত, হুজুগে না মেতে।

লেখক: খাদ্য ও পথ্যবিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র

ছবি: হাল ফ্যাশন

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০১: ০০
বিজ্ঞাপন