কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করেই ছবি তুলছি। আচমকা কেউ বলে উঠলেন, ‘আপা আপনি কি সাংবাদিক?’ আমি ছবি তুলতে তুলতে উত্তর দিলাম, ‘না’। মসজিদের সামনে একটি সমাধিভূমি রয়েছে। সেখানে চোখে পড়ল চিনিটিকরির কারুকাজ করা আধা ভাঙা কয়েকটি সমাধি। মসজিদের পাশেই একটি দিঘি।
শুরু হলো আমাদের নতুন ধারাবাহিক বাংলাদেশের ঐশ্বর্য সন্ধান। প্রতি মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার ভ্রামণিক এলিজা বিনতে এলাহী লিখবেন বাংলাদেশের কোনো কোনো জমিদারবাড়ি নিয়ে। ইতিহাসের পথে হেঁটে তুলে আনবেন হারানো দিনের অজানা মণিকাঞ্চন। প্রথম পর্বে থাকছে বক্তারপুরের সাব বাড়ি।
দেখে বোঝা যাচ্ছে, একসময় শানবাঁধানো ঘাট ছিল; কিন্তু এখন একদম ক্ষয়ে গেছে। ছবি তোলা শেষ করে তাকিয়ে দেখি, গ্রামের এক পথচারী আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনিই জানতে চেয়েছেন। আমার জন্য এ রকম অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন কিছু নয়। সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে খানিক আলাপ করলাম। তিনি বললেন, ‘ও! সাববাড়িতে বেড়াইতে আইছেন।’
অটোরিকশা একটি পুরোনো মসজিদের সামনে এসে থামল। ভাড়া মিটিয়ে আমি
ঢাকা থেকে খুব নিকটে এই সাববাড়ি। মানে সাহেববাড়ি। এসেছি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার শিকারি পাড়া ইউনিয়নের বক্তারনগর গ্রামে। উদ্দেশ্য, এই গ্রামের জমিদারবাড়িটি দেখা। বক্তারনগর গ্রামের মেঠো পথের একপাশে মসজিদ, অন্যপাশে সাববাড়ি। বক্তারনগর জমিদারবাড়ি, আতা খানের জমিদারবাড়ি—এমন কয়েক ধরনের নামই পেলাম এই জমিদারবাড়ির। পথের ওপাশ থেকেই জীর্ণ ও কিছুটা ধ্রুপদি স্থাপনার মতো দেখতে দ্বিতল বাড়িটি চোখে পড়ছিল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। একটি বড় মাঠ পেরিয়ে দ্বিতল বাড়িটির সামনে গেলাম। পলেস্তারা খসে পড়েছে, ইটের গাঁথুনির ভেতর বেশ বড় বড় বটগাছ জন্মেছে। বাড়ির কোনো দরজা–জানালা অবশিষ্ট নেই। কারুকাজগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে। বাড়ির কাঠামোটা কেবল রয়েছে। ভবনটি ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ ঠেকল। দোতলার ছাদ ভেঙে পড়েছে। তাই দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেও দ্রুত বেরিয়ে এলাম।
দ্বিতল ভবনটির পাশ দিয়ে একটি পথ গেছে। সেই পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, পেছনে আরও বড় একটি চত্বর আর ইংরেজি ‘এল’ শেপের আরও একটি ভবন। সেটিও দ্বিতল। তবে প্রথম ভবনটির থেকে পেছনের দালানটি আরও জীর্ণ। পেছনে গিয়ে এই জমিদারবাড়ির সীমানাপ্রাচীর দেখতে পেলাম। যদিও এখানে–সেখানে ক্ষয়ে গেছে দেয়াল। পুরো জমিদারবাড়ির চত্বরে তালগাছ, নিমগাছ, আম ও কাঁঠালগাছ দেখলাম। গাছগুলো দেখে আমার কাছে শতবর্ষী মনে হলো। এলাকাবাসীরও একই অভিমত।
বাড়ির পেছনদিকটায় কয়েকজন তরুণকে অলস ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখি। মনে হচ্ছিল, তাঁরা স্থানীয়ই হবেন। এগিয়ে গিয়ে কথা বলি। একজনের নাম অনয় শীল। এই গ্রামেরই ছেলে। বয়সে তরুণ, তারপরও জানতে চাইলাম, এই বাড়ি সম্পর্কে লোকমুখে বা স্থানীয় গুরুজনদের কাছ থেকে শোনা কোনো গল্প জানেন কি না। খুব বেশি আগের ইতিহাস তাঁর জানা নেই। তবে ছোটবেলায় দেখেছেন, এই বাড়ির দায়িত্বে এক বয়স্ক মানুষ ছিলেন। এই জমিদারবাড়ি দেখাশোনা করতেন। তিনি এখন আর নেই। অন্যত্র চলে গেছেন।
এই বাড়ির চত্বরে পিকনিক হয়। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন দেখতে আসে। ছোটবেলায় এই বাড়িতে অয়ন শীল ও তাঁর বন্ধুরা আম কুড়াতে আসতেন। এখনো বন্ধুরা মিলে অলস সময় পার করেন এই বাড়ির আঙিনায়। এলাকার সবাই এই বাড়িকে সাববাড়িই বলেন। তবে তিনি একটি তথ্য দিলেন প্রথম ভবনটি সম্পর্কে। প্রথম ভবনটিকে আমি ‘দ্বিতল’ বলছিলাম, কিন্তু ভবনটি আসলে তিনতলা। পুরো ছাদটি খসে পড়ার কারণে এখন দ্বিতল বলে মনে হয়।
সামনে একটি বিশাল চত্বর; সেখানে একটি সমাধিক্ষেত্র রয়েছে। সমাধিভূমির চারদিকে একটি প্রাচীর। তবে দুদিকের প্রাচীর কেবল টিকে রয়েছে। সেখানে দুই–তিনটি সমাধির অবয়ব দৃষ্টিগোচর হয়। তরুণ অয়ন শীলের ভাষ্যে, টিকে থাকা কবরগুলোর মধ্যে দুটি সমাধি এই বাড়ির মালিক আতা মিয়া ও তাঁর স্ত্রীর। সেখানে নাকি আগে নাম লেখা ছিল। তবে এখন কোনো নামফলক নেই। আমি অয়নকে মসজিদের সামনের সমাধিক্ষেত্রের কথাও জিজ্ঞেস করি। অয়ন জানান, বক্তারনগরের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সমাধি রয়েছে সেখানে।
বাংলাদেশজুড়ে বিভিন্ন জমিদারবাড়ির তথ্যগুলো পাওয়া ভীষণ মুশকিল। পরিত্যক্ত হলে আরও মুশকিল। তবে এই বাড়ির অবস্থা অল্প কিছুদিন পর কী রকম হবে, সেটি নির্ণয় করা দুষ্কর নয়।
বক্তারনগর গ্রামের এই জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাকাল, প্রতিষ্ঠাতার নাম কিছুই সঠিকভাবে জানা গেলো না। তবে বাড়ির নির্মানশৈলী দেখে এটিকে উনিশ ও বিশ শতকের বাড়ি বলেই অনুমেয়। রাস্তার অপর পাশের মসজিদটিরও সঠিক নির্মাণকাল জানা যায় না।
নিজের আগ্রহ থেকে কিছু তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করার তাগিদ অনুভব করি। অল্প যা কিছু পাওয়া গেল, তা হলো, এই জমিদারবাড়ি সম্পর্কে মোহাম্মদ মাহমুদ আলি তাঁর ‘পূর্ববঙ্গের জমিদারবাড়ি’ বইতে লিখেছেন, আনুমানিক ১৭৫০ সালের দিকে শাহবুদ্দিন শাহ এই জমিদারির গোড়াপত্তন করেন। জমিদারবাড়ির আয়তন উল্লেখ করা রয়েছে পাঁচ বিঘা। সুলতান শাহবুদ্দিন শাহের মৃত্যুর পর জমিদারি পরিচালনা করেন তাঁর ছেলে। তবে বইতে তাঁর ছেলের নাম উল্লেখ নেই।
গালিব রহমান খান, পেশায় ব্যাংকার হলেও ইতিহাসের প্রতি তাঁর অনুরাগ আছে। তিনি নবাবগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে কাজও করেছেন। গালিব রহমানের অনুসন্ধান থেকে যেটুকু জেনেছি, তা হলো, ফয়জুন্নেসা নামক এক নারী এই জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা। পরে তাঁর পালিত ছেলে আলী জান মিয়া জমিদারি পান। তাঁর ছেলে সৈয়দ উবায়দুল্লা শিকারীপাড়া ইউনিয়নের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। উবায়দুল্লা সাহেবের ছেলে শাহাবুদ্দিন (খোকা মিয়া) সাহেব এই সম্পত্তির বর্তমান মালিক। অর্থাৎ এই এস্টেট এখনো মূল মালিকদের কাছে রয়েছে। তারপরও এটি কেন পরিত্যক্ত ও জীর্ণ, জানি না।
মসজিদের মূল দুয়ারে আমি একটি শিলালিপি দেখেছি। মসজিদের শিলালিপির ছবির পাঠোদ্ধার করেছেন তাহমিদাল জামি নামের একজন বিশেষজ্ঞ। সে মোতাবেক এই মসজিদের নির্মাতা ফয়জুন্নেসা নামক এক মহিলা। অর্থাৎ তথ্য–উপাত্তে মিল আছে। তবে শিলালিপির পাঠ অনুযায়ী ফয়জুন্নেসা তাঁর খালা জনাব হাসিনার কাছ থেকে জমিদারি লাভ করেন। শিলালিপির তথ্যমতে মসজিদের নির্মাণকাল ১৮৭০ সাল। তাহলে ধরে নিতে পারি, এই জমিদারবাড়ির নির্মাণ হয়তো সমসাময়িক কালের।
ঐতিহ্য ভ্রমণে একটু ইতিহাসে প্রবেশ করতেই হয়। ঢাকার অদূরে এই জমিদারবাড়ি দেখতে হলে কী করে যাবেন! ঢাকা থেকে নবাবগঞ্জে আসার অনেক পথ আছে। আমি কীভাবে এসেছি, সেটি বলছি। আমার বাসা যেহেতু মোহাম্মদপুরে, তাই মোহাম্মদপুর থেকে রিকশাযোগে বসিলায় গেছি। সেখান থেকে সিএনজিতে চেপে বান্দুরা। তারপর বান্দুরা থেকে অটোরিকশায় বক্তারনগর গ্রামে পৌঁছেছি। পর্যটনস্থান হিসেবে বক্তারনগর গ্রাম খুব জনপ্রিয় কিংবা পরিচিত নয়। তাই অটোরিকশার চালককে কিছুটা বুঝিয়ে বলতে হয়, বক্তারনগর গ্রামের পুরোনো বাড়ি, ভাঙা বাড়ি, জমিদারবাড়ি দেখতে যাব। এ ছাড়া ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে বান্দুরা অবধি আসা যায়।
ছবি: লেখক