উসমানি সাম্রাজ্য কিংবা দ্য অটোম্যান এম্পায়ার—যে নামেই ডাকি না কেন, ১২৯৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৬২৪ বছর এশিয়া ও ইউরোপ শাসন করেছেন উসমানি শাসকেরা। ৫২ লাখ বর্গকিলোমিটারের সাবেক উসমানি সাম্রাজ্য বর্তমানে ৪৯টি স্বাধীন রাস্ট্রে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে উসমানি সাম্রাজ্য বলতে তুরস্ককেই বুঝি। তুরস্কের ইউরোপ অংশ ত্রাস ও এশিয়া অংশ আনাতোলিয়া নামে পরিচিত।
এই গ্রহে তুরস্কই একমাত্র দেশ, যেখানে একজন পর্যটক আক্ষরিক অর্থেই বলতে পারেন সকালের নাশতা এশিয়াতে ও দুপুরের ভোজন ইউরোপে করেছি। তুরস্কের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে আছে তাদের সুপ্রাচীন অতীতের স্থাপত্য এবং অবশ্যই হাজার বছরের খাদ্যসংস্কৃতি। সেই হাজার বছরের খাদ্যসংস্কৃতি আসলে ঐতিহ্য ও ভ্রমণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ও অনুষঙ্গ।
তুরস্ক ভ্রমণে রসনার ফর্দ মেলা বড়। চেখে দেখেছি ডজন খানেক খাবার। এ অঞ্চলে নানা ধরনের কাবাব, বিভিন্ন রকমের চা, প্রতি বেলায় আহার শুরুর আগে টেবিলজুড়ে সালাদ, আচার, সেদ্ধ জলপাই আর শেষ পাতে বাকলাভার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। তবে চমকিত করেছে একটি বিশেষ ঐতিহ্যবাহী খাবার ও এর রন্ধনপ্রণালি। খাবারটির নাম গোজলেম।
তুরস্কের যে শহরেই ভ্রমণ করেন, গোজলেম আপনার চোখে পড়বেই। গোজলেম যদি আপনার চোখ এড়িয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে, তুরস্ক ভ্রমণে আপনি মনোযোগী ছিলেন না। ইস্তাম্বুলসহ প্রায় প্রতিটি রাজ্যের প্রতিটি শহরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে গেলেই চোখে পড়বে, একটি জায়গায় তিন-চারজন মধ্যবয়সী নারী বসে রুটির মতো কী জানি তৈরি করছেন। যেহেতু মধ্যবয়সী নারীরা সেই কাজ করছেন, ফলে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, রান্নার এই বিষয় ঐতিহ্যবাহী।
কাছে গিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, কী দারুণ ও বিশাল আয়োজন। কারণ, তিন-চারজন তৈরি করছেন একটি রুটি। রুটি তৈরি হচ্ছে বেশ বড় একটি টেবিলে। রুটির আকার পাতলা ও বড়। সেই রুটি একজন বেলে দিচ্ছেন পরেরজনকে, দ্বিতীয়জন সেই পাতলা রুটির ভেতর সবজি, পনির বিছিয়ে চার ভাঁজ করে তৃতীয়জনকে দিচ্ছেন হালকা তেলে ভেজে দেওয়ার জন্য। ভাজা হয়ে গেলে চার টুকরা করে পরিবেশন করা হয় গোজলেম। শুধু যে সবজি আর পনির দিয়েই তৈরি হয় গোজলেম, এমন নয়। চকলেট, মুরগি বা অন্য কোনো মাংসের কিমা দিয়েও তৈরি হয় গোজলেম। গরম–গরম খেতে বেশ মজা!
তুরস্কের স্ট্রিট ফুড হিসেবে গণ্য করা হয় এখন গোজলেমকে। শহরের বড় বড় ক্যাফে আর রেস্তোরাঁয়ও গোজলেম পরিবেশন করা হয়। গ্রাম ও শহর—সব জায়গাতেই গোজলেম দারুণ জনপ্রিয়। আর এই গোজলেম সকালের নাশতা কিংবা বিকেলের চায়ের সঙ্গে খাওয়ার ঐতিহ্য চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। সকালের নাশতায় পাউরুটি, পরাটা ও নানা রকমের রুটির সঙ্গে গোজলেমও পরিবেশন করা হয়।
আমার তুরস্কের গাইড ইসমাইল খান গোজলেমকে বলছিলেন ‘ফ্ল্যাটব্রেড’। খেয়াল করে দেখলাম, স্থানীয় তরুণ-তরুণীরা গোজলেমেকে ফ্ল্যাটব্রেড নামেই ডাকে। এই স্টাফড ফ্ল্যাটব্রেডের উৎপত্তি হাজার হাজার বছর আগে। তুর্কি যাযাবরদের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া থেকে এই খাবার আনাতোলিয়ায় আসে। তুরস্কের প্রাচীন নাম আনাতোলিয়া। গাইড খানের তথ্যমতে, শব্দটি তুর্কি শব্দ ‘কোজলেম’ থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। যার অর্থ ‘অঙ্গারের ওপর রান্না করা’। কারণ, অতীতে যাযাবরেরা মূলত কয়লার ওপরে সেঁকে গোজলেম তৈরি করত।
নিজস্ব খাদ্যসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে গোজলেমের উপস্থাপন ভীষণ মুগ্ধ করেছে। তুরস্ক ভ্রমণে গোজলেম খেতে ভুলবেন না যেন!
ছবি: লেখক