ব্যাকইয়ার্ডে গ্ল্যাম্পিং, বছরের শেষ রাইড
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ঘড়িতে বাজছে মাত্র রাত ৯টা, অথচ মনে হচ্ছে রাত ২টা-৩টা বেজে গেছে। আশপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে কোনো মানুষ অথবা সামান্য আলোও চোখে পড়েনি। দুই পাশে চা–বাগান, ঝিঁঝি পোকার ডাক, হঠাৎ হঠাৎ নাম না–জানা অদ্ভুত কোনো পাখির ডাক আর আমাদের মোটরবাইকের আওয়াজ ছাড়া কোনো শব্দ নেই।

বেশ গা ছমছমে রাতের পথ পেরিয়ে পৌছাতে হয়েছে গন্তব্যে
বেশ গা ছমছমে রাতের পথ পেরিয়ে পৌছাতে হয়েছে গন্তব্যে

ঝিঁঝি পোকা ডাকা বন্ধ করে দিলেই কানে তালা লাগানো নৈঃশব্দ্য। একাদশীর চাঁদের আলোয় চা–বাগানের ছায়া দেওয়া গাছগুলো অদ্ভুত দানোর মতো সিলোয়েট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ভূতুড়ে আলো–আঁধারের মধ্যেই পথ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, ফোনের নেটওয়ার্ক নেই আর ডেটাও কাজ করছে না।

বিজ্ঞাপন

অনেক দিন ধরেই কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না। বছরের শেষ শুক্রবারে ঘুম থেকে জেগেই রাহাত যখন বলল, কোথাও থেকে ঘুরে আসি। ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’ প্রবচনের মতো একেবারেই পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া বছরের শেষ ট্রিপ হিসেবে চলে গেলাম বাংলাদেশের পূর্ব কোণে মিজোরামের কোল ঘেঁষে চায়ের রাজধানী, আমাদের খুব প্রিয় গাঢ় সবুজ শ্রীমঙ্গলে। আমাদের ইচ্ছা ছিল দিনের আলো থাকতে থাকতেই পৌঁছানোর। কিন্তু একটু দেরি করে রওনা দেওয়ায় আশুগঞ্জ পৌঁছাতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। সেখানে ছোট্ট একটা বিরতি নিয়ে শ্রীমঙ্গল শহরে পৌঁছালাম রাত ৯টার দিকে।

শ্রীমঙ্গলের গ্ল্যাম্পিং ডেস্টিনেশন ব্যাকইয়ার্ড রিট্রিট
শ্রীমঙ্গলের গ্ল্যাম্পিং ডেস্টিনেশন ব্যাকইয়ার্ড রিট্রিট
রিসোর্টটির রাতের রূপই বেশি ভালো লেগেছে লেখকের কাছে।
রিসোর্টটির রাতের রূপই বেশি ভালো লেগেছে লেখকের কাছে।


ঘুটঘুটে অন্ধকারে জনমানবশূন্য রশিদপুর গ্যাসফিল্ডের পুরো রাস্তাকে মনে হচ্ছিল যেন অন্য কোনো পৃথিবীর। সাতগাঁও চা–বাগান পাশে রেখে এঁকেবেঁকে যাওয়া পাহাড়ি পথ ধরে আমরা যখন চা-কন্যা ভাস্কর্য পার হয়ে শ্রীমঙ্গল শহরে পৌঁছালাম, ঘড়িতে তখন রাত ৯টা। আমাদের গন্তব্য আরও একটু দূরে কমলগঞ্জের ভেতর নতুন হওয়া একটি রিসোর্ট। নাম ব্যাকইয়ার্ড রিট্রিট। নূরজাহান টি এস্টেটের ভেতর দিয়ে কাঁচাপাকা রাস্তা মিলিয়ে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে। টি এস্টেটের ভেতরে কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখা গেল, ফোনে নেটওয়ার্ক নেই, তাই ম্যাপ দেখে খুঁজে বের করারও উপায় নেই। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলোয় দুই পাশের চা–বাগানকেই মনে হচ্ছে ঘন বন। এর মধ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা পুরোপুরি অফরোড, যাকে বলে কখনো ইট বিছানো, তো কখনো একেবারেই মাটির রাস্তা। চাঁদের আলোয় গাছের ছায়া আর মোটরবাইকের হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার কাটিয়ে খুব বেশি দূর দেখা যায় না। তাই খুব ধীরে মোটরবাইক চালানো ছাড়া উপায় নেই। কিছুদূর এগোনোর পরই অবশ্য নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল। আর ম্যাপ দেখে আমরাও পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

বিজ্ঞাপন

দুটি বিশাল টিলা আর তার মাঝখানে কিছুটা উপত্যকার মতো বিশাল জায়গা নিয়ে দুর্দান্ত একটা রিসোর্ট এই ব্যাকইয়ার্ড রিট্রিট। আমরা থাকছি তাঁবুতে, যার পোশাকি নাম গ্ল্যাম্পিং ভিলা। গ্ল্যাম্পিং মানে আসলে সব ধরনের সুযোগ–সুবিধাসহ ক্যাম্পিং এক্সপেরিয়েনস, যাকে বলে ক্যাম্পিং উইদ গ্ল্যামার। দুই টিলার মধ্যে ভ্যালির মতো জায়গায় তাঁবুর দারুণ সেটআপ। টিলার ওপরে অবশ্য ছোট সুইমিং পুল আর ইনফিনিটি হ্যামকসহ কয়েকটা ভিলাও আছে।

দুর্দান্ত একটা রিসোর্ট এই ব্যাকইয়ার্ড রিট্রিট
দুর্দান্ত একটা রিসোর্ট এই ব্যাকইয়ার্ড রিট্রিট
এই সেই তাঁবু, যার পোশাকি নাম গ্ল্যাম্পিং ভিলা
এই সেই তাঁবু, যার পোশাকি নাম গ্ল্যাম্পিং ভিলা
সুইমিং পুলও আছে এখানে
সুইমিং পুলও আছে এখানে

টিলার ওপরে রিসিপশন আর রেস্টুরেন্ট। টিলা থেকে ভ্যালিতে ওঠানামার জন্য কাঠ আর কংক্রিট মিলিয়ে শদুয়েক সারি সারি সিঁড়ি দেওয়া আছে। শরীরের বাইকিং গিয়ারসহ প্রায় ৮০টি সিঁড়ি ভেঙে হাঁসফাঁস করে টিলার ওপরের রিসিপশনে পৌঁছে নিচের ভিউ দেখে সব ক্লান্তি যেন নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। এই রিসোর্টের মজাটা হলো, এ জায়গা দিনে এক রকম আর রাতে একেবারেই অন্য রকম লাগবে। আমাদের কাছে রাতের পরিবেশটাই বেশি প্রশান্তিময় লেগেছে। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও জায়গাটির মালিক আর সার্ভিস স্টাফরা অসম্ভব আন্তরিক। এরপর শ্রীমঙ্গলে আবার এলে আর এখানে থাকলে হয়তো এই তাঁবুতেই থাকব।

এক দিন থাকব ভেবে এসেছিলাম। দুই দিন থেকেছি। দুই দিনই ভোরে ঘুম ভেঙেছে পাখির ডাকে। ইটপাথরের শহর ঢাকায় কর্কশ অ্যালার্মও যেখানে ঘুম ভাঙাতে পারে না, সেখানে ঢাকার বাইরে কোথাও গেলেই ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে যায় পাখির কিচিরমিচির ডাকে। তাঁবুর পাটাতন থেকে কাঠের সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই চোখে পড়ে

শিশির ভেজা সবুজ ঘাস, টিলার ওপরের ছায়াবৃক্ষ আর আনারসের বাগান।
শিশির ভেজা সবুজ ঘাস, টিলার ওপরের ছায়াবৃক্ষ আর আনারসের বাগান।
এই রিসোর্টের মজাটা হলো, এ জায়গা দিনে এক রকম আর রাতে একেবারেই অন্য রকম
এই রিসোর্টের মজাটা হলো, এ জায়গা দিনে এক রকম আর রাতে একেবারেই অন্য রকম
শ্রীমঙ্গলে আবার এলে এই তাঁবুতেই থাকবেন বাইকার দম্পতি
শ্রীমঙ্গলে আবার এলে এই তাঁবুতেই থাকবেন বাইকার দম্পতি
গন্তব্যের মতো ভ্রমণেও এ রুটে আপনি পাবেন সমান আনন্দ
গন্তব্যের মতো ভ্রমণেও এ রুটে আপনি পাবেন সমান আনন্দ

শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ব্যাকইয়ার্ডে আসার পথটাও বাড়তি আনন্দের। অত্যন্ত নয়নাভিরাম এক রুট এটি। শহর থেকে ফিনলে টি এস্টেটের পাশ দিয়ে যে আঁকাবাঁকা সড়কটা চলে গিয়েছে লাউয়াছড়ার দিকে, সেই সড়ক ধরে লাউয়াছড়ার কিছু আগেই পড়বে নূরজাহান টি এস্টেট। নূরজাহান টি এস্টেটের চোখজুড়ানো গাঢ় সবুজ সারি সারি চা–বাগানের টিলার মধ্য দিয়ে ইটের রাস্তা ধরে এই রিসোর্টে আসতে হয়। গন্তব্যের মতো ভ্রমণেও আপনি পাবেন সমান আনন্দ।

রাতের নৈঃশব্দ্য যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। রাত গভীর হলে নিস্তব্ধতা চিরে বনের ভেতর থেকে হঠাৎ ভেসে আসে ডাহুক, তিতির, প্যাঁচাসহ আরও অনেক পাখির ডাক। আগে আরও অসংখ্যবার শ্রীমঙ্গলে আসা হলেও এখানকার প্রকৃতি আমাদের বরাবরই বিস্মিত করে। শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষায় শ্রীমঙ্গল যেন আলাদা আলাদা সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয়। সেই সঙ্গে টিলার ওপর সূর্যাস্ত–সূর্যোদয় দুটিই আপনাকে সমান মুগ্ধ করবে।

বাইকার দম্পতি ফাহমিদা আহমেদ আর মইনুল ইসলাম রাহাত।
বাইকার দম্পতি ফাহমিদা আহমেদ আর মইনুল ইসলাম রাহাত।
এবার ফেরার পালা, সেই নয়নাভিরাম পথ ধরে।
ফাহমিদা আশ্বস্ত করলেন, এই গরুর পালের সঙ্গে দুর্ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।
ফাহমিদা আশ্বস্ত করলেন, এই গরুর পালের সঙ্গে দুর্ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।

এবার ফেরার পালা। ২০২৩ সালের শেষ দিনে ফেরার পথে শ্রীমঙ্গল শহরে ছোট্ট একটা দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলাম। সে গল্প আরেক দিন হবে। এর মাঝে নাহয় চলতে থাকুক চকচকে কালো হাইওয়ের কান ঘেঁষে বয়ে যাওয়া চমৎকার শনশন হাওয়া আর কমিউনিকেটরে আমাদের খুনসুটি, ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের গল্প। নতুন বছরে সুন্দর হোক সবার পথচলা।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮: ৪৭
বিজ্ঞাপন