বাংলার লাদাখে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

প্রচণ্ড বৃষ্টি। তিন ফুট সামনেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। হেলমেটের ভাইজর বারবার মুছেও কোনো লাভ হচ্ছে না, এদিকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ঘাড়ের পেছন দিয়ে কুলকুল করে রেইনকোটের ভেতর পানি ঢুকে পুরো শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করছি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর। আমাদের সঙ্গে এক বন্ধুর যুক্ত হওয়ার কথা। যেতে হবে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। আর আমরা যাচ্ছি? রাঙামাটি। বারৈরহাট হয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর সিন্দুকছড়ি-মহালছড়ির নতুন রাস্তা আবিষ্কার করতে। আমাদের পৌঁছাতে হবে সন্ধ্যার আগেই।

সিন্দুকছড়ি-মহালছড়ির পাহাড়ি সড়ক
সিন্দুকছড়ি-মহালছড়ির পাহাড়ি সড়ক
ছবি: লেখক

ভোর পাঁচটায় রওনা হওয়ার কথা থাকলেও ঠিক ভোর পাঁচটা থেকেই (অক্টোবর মাসের কথা) শরতের ভোরবেলায় হঠাৎ করে আকাশ ভেঙে বর্ষাকালের মতো ঝুম বৃষ্টি। গ্রুপের একজন অলরেডি রিপোর্টিং পয়েন্টে এসে কাকভেজা হয়ে বসে আছে। এদিকে বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণই নেই। অগত্যা বৃষ্টি মাথায় করে বের হতে হতে আমাদের সাড়ে ছয়টা বেজে গেল। এবারের মোটরবাইক ট্যুরে আমরা একা নই, সঙ্গে আছে আমাদের কজন কাছের বন্ধু—রিয়াদ, পাভেল আর রেজা ভাই। আমাদের পাগলামির সঙ্গী এবার তারাও।

বিজ্ঞাপন

বৃষ্টি, কাদা, কাঁচপুর ব্রিজের আগে–পরের বিচ্ছিরি যানজট, বারৈরহাটের বেশ খানিকটা অফরোড, হেয়াকো, রামগড়ের পাহাড়ি উঁচু–নিচু পথ পার করে এসে বিকেলের দিকে যখন সিন্দুকছড়ির আঁকাবাঁকা রাস্তায় উঠলাম, মনে হচ্ছিল যেন সোজা স্বর্গে পৌঁছে গেছি।

এই রাস্তার সৌন্দর্য ব্যাখ্যাতীত
এই রাস্তার সৌন্দর্য ব্যাখ্যাতীত
ছবি: লেখক

এই রাস্তার সৌন্দর্য ব্যাখ্যাতীত। ভাইজর ভেদ করে নাকে এসে লাগছে পাহাড়ি মিষ্টি বুনো গন্ধ। এক পাশে সবুজ পাহাড়, আরেক পাশে খাড়া খাদ; মাঝখানে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে এই স্বর্গের সড়ক। দেখে মনে হচ্ছে যেন রাস্তার এক পাশে ভিয়েতনাম, এক পাশে চেরাপুঞ্জি, একটু সামনে ইন্দোনেশিয়া, আরেকটু এগোলেই লাদাখ। এক অসম্ভব সুন্দর মেলবন্ধন। যেন চাইলেই হাত বাড়িয়ে মেঘ ছোঁয়া যাবে।

সিন্দুকছড়ি-মহালছড়ির এই পাহাড়ি সড়ক বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি ও ৩৪ ইসিবির দক্ষ দল। প্রায় সাড়ে ১৫ কিমি এই নতুন সড়ককে অনেকেই ভালোবেসে নাম দিয়েছেন ‘বাংলার লাদাখ’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ব্লগ এবং ভ্লগ দেখেই আমাদের আগ্রহ জন্মে বাংলার লাদাখে যাওয়ার।

বিজ্ঞাপন

এখানে আসার পর এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে বাংলার লাদাখ নামটাকে যথার্থই মনে হবে যে কারও কাছে।

ইতিমধ্যেই আকাশ কমলা করে ডুবতে শুরু করেছে সূর্য।

এই সেই দারুণ থাকার জায়গা
এই সেই দারুণ থাকার জায়গা
ছবি: লেখক

আলো থাকতে থাকতে আমাদের আর রাঙামাটি পৌঁছানো হলো না। এদিকে আমরা কোথায় থাকব, সেটাও ঠিক হয়নি। অবশেষে রাঙামাটি শহরের নিরিবিলি আদমে আমাদের এক বড় ভাইয়ের হোমস্টে খালি পাওয়া গেল। যাওয়ার পথে গুগল ম্যাপের ভুলে এক সরকারি অফিসের ভেতরই ঢুকে যাচ্ছিলাম। রাত ৯টার দিকে আমাদের গন্ত্যবে পৌঁছে আর কোনো কিছু দেখার সুযোগ পাইনি। খেয়েদেয়ে ঘুম।

ভোরবেলা রাহাতের ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম থেকে জেগেই আরেকটা ধাক্কা খেলাম। এ কী! আমি কি কাশ্মীরের ডাল লেকে শিকারায় ঘুম থেকে উঠেছি! এই ছোট্ট হোমস্টের জানালা দিয়ে যত দূর চোখ যায়, পুরোটাই কাপ্তাই লেক আর অনেক দূরে আবছা আবছা ফুরোমন পাহাড়। লেকের পানি ছুঁয়ে বানানো এই হোমস্টের কাঠের বারান্দায় একটা দোলনা ঝোলানো, সেই দোলনায় দোল খেতে খেতে বারান্দায় বসে লেকের অপার সৌন্দর্য দেখে পুরো দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। হলোও তা–ই, রাঙামাটি ঘুরতে এসে আমরা আর এখান থেকে বেরই হলাম না, সেই কাঠের বারান্দায়ই কাটিয়ে দিলাম পুরো একটি দিন।

মাতাল মুগ্ধতা আর মন কেমন করা অনুভূতি কাজ করে
মাতাল মুগ্ধতা আর মন কেমন করা অনুভূতি কাজ করে
ছবি: লেখক

এখানে এক দিন থেকে হোস্ট ভাই-ভাবির অসাধারণ আতিথেয়তার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা পরদিন বেলা ১১টার দিকেই আবার রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশে।

আমরা বেড়াতে বের হলেই একটা না একটা অঘটন ঘটা খুবই সাধারণ ব্যাপার; আর সেই নিয়ম মেনেই ফেরার সময় সিন্দুকছড়ির রাস্তায় উঠতেই দেখি, রাস্তা বন্ধ। কারণ, কিছুক্ষণ আগেই ল্যান্ডস্লাইড হয়েছে। যেটা পাহাড়ি এলাকার খুবই সাধারণ দুর্যোগ। সময় নষ্ট না করে আমরা এখানেই ফটোসেশন করে ফেললাম।

সেলফি তুলছেন মাইনুল ইসলাম রাহাত। পেছনে লেখক (মাঝে) ও অন্য সঙ্গীরা
সেলফি তুলছেন মাইনুল ইসলাম রাহাত। পেছনে লেখক (মাঝে) ও অন্য সঙ্গীরা
ছবি: লেখক

প্রতিবার যেকোনো জায়গা থেকে ফেরত আসার সময় একটা মাতাল মুগ্ধতা আর মন কেমন করা অনুভূতি নিয়ে আসি। সঙ্গে হয়তো নিজেদের মনের একটা টুকরাও সেখানে ফেলে আসি। আর সে কারণেই আমাদের পথচলা অবিরাম। ছুটে চলি এক গন্তব্য থেকে আরেক গন্তব্যে। নতুন কোনো গল্পের খোঁজে।

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২২, ০৭: ৫১
বিজ্ঞাপন