বান্দরবানের জুমঘরের দিন-রাত্রি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

লোভটা জেগেছিল ঈদের ছুটিতে রুমানাপাড়া গিয়ে। পাড়া হতে জিংসিয়াম ঝরনায় নামার সময় হাতের ডানে সবুজের দায়ে চোখ ফেরানো যায় না। আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজের মধ্যে দু-চারটি বাদামি কুঁড়েঘর। দূর থেকে দেখে কেন জানি বুকের মধ্যে হাহাকার আরও বাড়ে। ইশ! একটা দিনের জন্য যদি এই বাদামি ঘরগুলোর কোনো একটার অতিথি হতে পারতাম। সময়ের চক্রে হাত-পা বাঁধা। তাই এই যাত্রায় আর সেই সৌভাগ্য হয় না।

Picasa
Picasa

শহুরে যান্ত্রিকতায় ফিরে রোবট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েও সেই বাদামি কুঁড়েঘরগুলোর মায়া কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছিলাম না। সুযোগটা এসে গেল মাসখানেকের মধ্যেই। এবার আর সময়ের টানাটানি নেই, নেই নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যও। নিজেদের মতো কয়েকটা দিন কাটানো যাবে। বগা লেক থেকে লুংথাউসিহপাড়া হয়ে পৌঁছে গেলাম ত্লাংচাদ পাড়ার জুমে। এর মধ্যেই নামল ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি ধরে এলে 'কাই লো ভা' ঝরনা দেখে রওনা দিলাম রুমানাপাড়ার দিকে। একে গয়াল চলাচলের রাস্তা, তার ওপর একটু আগের বৃষ্টিতে পথ উপস্থিত হলো সাংঘাতিক বিপদ নিয়ে। কাদা একেবারে কাঁদিয়ে ফেলার অবস্থা। বকের মতো লম্বা পা ফেলে ফেলে এগোচ্ছি। উপরি হিসেবে যুক্ত হয়েছে জোঁকের অত্যাচার। জোঁকের অভয়ারণ্যে ভ্রমণের ট্রাভেল ট্যাক্স হিসেবে খানিকটা রক্ত দিতে আমরা কেউই কুণ্ঠিত নই। তবে এই বর্ষায় সেটা মাঝেমধ্যে মাত্রা ছাড়াচ্ছে। নিজ নিজ পা তুলে আর গলা নামিয়ে জোঁকের খোঁজ করতে হচ্ছে খানিক পরপরই।

বিজ্ঞাপন

কিছু দূর যেতেই চোখে পড়ল চিরচেনা মখমলের সবুজ বিছানার ওপর বাদামি কুঁড়েঘরের সেই ঘোর লাগা দৃশ্য। আমার ট্রিপমেটদের মতামত ছিল, আজকের দিনে যত বেশি সম্ভব পথ এগিয়ে থাকার। কারণ, আগের কয়েক দিনে যেখানেই ভালো লেগেছে, সে পাড়াতেই থেকে গেছি। কিন্তু গোঁ ধরলাম আমি। আমার চলা আসলেই যে যায় না বলা! একটা জুমঘরের সামনে গিয়ে ঘোষণা করলাম, ‘এই জুমঘরে থাকতে না পারলে এমন ট্রিপে আসাই বৃথা।’

Picasa
Picasa

এই মনোলগ শোনার পরে ট্রিপমেটরাও থেকে যেতে রাজি হলো। অবশ্য আমার কথার চেয়েও জুমঘর এবং তার আশপাশের নৈসর্গিক দৃশ্য দ্বারা তারা বেশি প্রভাবিত। জুমঘরের মালিক নলভিলদা আমরা রাতে থাকব শুনে বেজায় খুশি। ভালুকের হাত থেকে জুমের ভুট্টা বাঁচাতে গাদাবন্দুক নিয়ে বেচারা গত কিছুদিন এই জায়গায় মটকা মেরে পড়ে আছে। কথা বলার মানুষ পেয়ে সে মহা আনন্দিত। ভাঙা ভাঙা চাটগাঁইয়া ভাষাতে চলছে ভাবের আদান–প্রদান।

বিজ্ঞাপন

উনুনে চা বসিয়ে জুমঘরের মাচায় বসে চারপাশের দৃশ্যাবলি গেলা শুরু করলাম। মাচা থেকেই জিংসিয়াম ঝরনার প্রথম ধাপটা স্পষ্ট দেখা যায়। একটু কান খাড়া রাখলে পানির শব্দটাও শোনা যায়।

Picasa

এসব দেখতে আর শুনতে শুনতে মাচাতে বসেই খানিকটা তন্দ্রার মতো এসে গিয়েছিল। বাগড়া দিল ঝুম বৃষ্টি। চারপাশ ভাসিয়ে নেওয়া সেই বৃষ্টি। ঝরনার শব্দ আর বৃষ্টির শব্দ একে অপরকে কাটাকুটি করছে।

জুমঘরের ভেতরে আশ্রয় নিয়েও রেহাই নেই। বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে সবকিছু। বৃষ্টি ধরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই এক অনির্বচনীয় মুহূর্তের মুখোমুখি হলাম আমরা সবাই। পাড়ার কোলঘেঁষা পাহাড় আরসুং সিপের চূড়ার ঠিক ওপরে উঁকি দিল এক বিশাল রংধনু।

Picasa

বিহ্বল নয়নে সেদিকে চেয়েই পড়ে গেলাম ঘোরের মধ্যে। এর পরপরই প্রকৃতি যেন তার আকাশ-সবুজে ছাওয়া মখমলের বিছানা-ঝরনা-মেঘ-ঝিরি-কেওক্রাডং-দূরের কপিতাল পাহাড় নিয়ে আমাদের সামনে এক স্লাইড শো শুরু করল। এ বলে আমাকে দেখ, ও বলে আমাকে দেখ। আর আমরা কজন উদাসীন মানবসন্তান হাপুস নয়নে এসব গিলছি! জীবনের গতানুগতিকতার মহাগোলমাল থেকে বাঁচিয়ে রাখে এমন অল্প কিছু মুহূর্তই।

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১৬: ০০
বিজ্ঞাপন