২০২৩ জুড়ে ট্রেন্ডের শীর্ষে দেশের ৫টি পরিবেশবান্ধব পর্যটনস্থান
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমাদের দেশ সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বলেই বিখ্যাত সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে। এখানে ভ্রমণ করতে আসার মূল আবেদনটিই থাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিরূপ দেশটির সবুজ উপভোগ করার মধ্যে। আর তার সঙ্গে নদীমাতৃক এই দেশের নদী-নালা, দক্ষিণে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর আর উত্তর–পশ্চিম ও পূর্বের বিপরীতমুখী ভূমিরূপের বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য।

দুঃখের বিষয়, সময়ের আবর্তনে বাংলাদেশের পর্যটনে অবকাঠামোগত উন্নতি হলেও এর সঙ্গে এসেছে পরিবেশদূষণের অধ্যায়। কিন্তু করোনা–পরবর্তী সময়ে প্রকৃতি ও পৃথিবী বাঁচানোর তাগিদ নতুন করে অনুভব করার ফলে আমাদের ভ্রমণ মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। পর্যটক এবং যাঁরা পর্যটন পরিচালনা করছেন—উভয় পক্ষেই তা লক্ষণীয়। আর এরই ধারাবাহিকতায় এখন ইকো ট্যুরিজম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে পর্যটকদের মেলবন্ধন, তাঁদের সংস্কৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে পরিবেশবান্ধব এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতার সমন্বিত রূপটিকে ইকো ট্যুরিজম বলা হয়। বাংলাদেশেও দুয়েক বছর ধরে জনপ্রিয় হচ্ছে এই ধারণাটি। তাই তো পরিবেশ সচেতন পর্যটকদের জন্য পাঁচটি ‘ইকো ফ্রেন্ডলি’ ট্যুরিস্ট স্পটের খোঁজ রইল আজ হাল ফ্যাশনে।

১. মারমেইড ইকো রিসোর্ট

কক্সবাজারের প্যাঁচার দ্বীপে এর অবস্থান। শুরু হওয়ার প্রথম থেকেই পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় আছে এই রিসোর্ট। এক পাশে ঝাউবনে ঘেরা সমুদ্রসৈকত। আরেক পাশে পাহাড়। মাঝখানে চলে গেছে টেকনাফ পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ। এর পাশেই রেজু খাল। সেখানেই পেচারদিয়া গ্রাম। এখানে অবস্থিত এ রিসোর্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এখানে সবকিছু প্রাকৃতিকভাবে তৈরি করা হয়েছে। রাস্তা থেকে তাকালে গাছপালার আড়ালে চোখে পড়ে ছোট-বড় অনেক কুটির, যার সবই বাঁশ ও শণ দিয়ে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন তা গাছপালাগুলোর উচ্চতাকে ছাড়িয়ে না যায়। সেখানে গেলেই আপনাকে স্বাগত জানানো হবে বুনো ফুলের গুচ্ছ দিয়ে। ভেতরে অবশ্য সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পাবেন আপনি। কিন্তু প্লাস্টিকের বোতলে ভর্তি শ্যাম্পুর বদলে কাচের পাত্রে ভেষজ উপায়ে বানানো শ্যাম্পু রাখা আছে সেখানে। সেটা আবার সবুজ গাছের পাতা দিয়ে কায়দা করে ঢাকা। দুই পাশে দুটি কাঠগোলাপ ফুল গুঁজে দেওয়া। সাবান, শ্যাম্পু রাখা হয়েছে নারকেলের লম্বা একটা খোলের মধ্যে। মারমেইড ইকো রিসোর্টে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সব জিনিস যথাসম্ভব কম ব্যবহার করা হয়েছে। প্যাঁচার দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশ বহাল রেখেই সব বাংলো তৈরি করা হয়েছে। ইয়োগা সেন্টার, স্পা, নৌকাভ্রমণ, সম্মেলনকক্ষ, প্রেক্ষাগৃহ—সবকিছুরই এখন ব্যবস্থা আছে এ পরিবেশবান্ধব অবকাশ যাপন কেন্দ্রে। মারমেইড ইকো রিসোর্টের মূল নকশা করেছেন স্থপতি জিয়াউদ্দিন খান। বিস্তারিত তাঁদের ওয়েবসাইট এবং ফেসবুকে পাওয়া যাবে।

মারমেইড ইকো রিসোর্ট
মারমেইড ইকো রিসোর্ট
মুনলাই পাড়া
মুনলাই পাড়া

২. মুনলাই পাড়া

মুনলাই বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের একটি। ৫৪টি বম পরিবারের বাস প্রশান্তিময় পাহাড়ি গ্রাম মুনলাইয়ে। চারদিকে পাহাড়ঘেরা সাঙ্গু নদের তীরে এর অবস্থান। বান্দরবান শহর থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে এখানে যেতে। এখানে রয়েছে স্থানীয় বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা। ফলে পাহাড়ি রান্নার অসাধারণ স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন। সেই সঙ্গে আছে রোমাঞ্চকর ট্র্যাকিং, গাছের ওপরে টংঘর, ক্যাম্প ফায়ার আর কায়াকিংয়ের ব্যবস্থা। দেশের দীর্ঘতম জিপ লাইনসহ বম নৃগোষ্ঠীর আচার–সংস্কৃতি জানার সুযোগ মিলবে এখানে। এটি বাংলাদেশের প্রথম কমিউনিটি বেজড বা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ঘিরে বানানো ট্যুরিজম স্পট। বিস্তারিত তাঁদের পেজে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

৩. ইরাবতী ইকো রিসোর্ট

পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন আমাদের সুন্দরবন। সুন্দরবনের ট্যুরিজম মূলত বোট বা জাহাজনির্ভর। অনেকের মনে ইচ্ছে থাকে এ বনের একেবারে কাছে থাকতে। সে সুযোগ তৈরি হয়েছে বেশ কয়েক বছর থেকে ইরাবতী ইকো রিসোর্ট ও রিসার্চ সেন্টারে। মোংলার অদূরেই সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে পশ্চিম ঢাংমারীতে গোলপাতায় ঘেরা নয়নাভিরাম এক জায়গায় গড়ে উঠেছে এই ইরাবতী ইকো রিসোর্ট ও রিসার্চ সেন্টার। ঢাংমারীর খালটি সুন্দরবনের ইরাবতী ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। পুরো রিসোর্টটি তৈরি হয়েছে পানির ওপরে। আর এতে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ, গোলপাতাসহ সব পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী।

কাঠ ও বাঁশ দিয়ে নির্মিত চারটি রুম আছে এ রিসোর্টটিতে। নদী ও বন দুটিই দেখা যায় এ রকম দুটি রুম রয়েছে—ফুলেশ্বরী ও সুন্দরী। এ ছাড়া শুধু বন দেখা যায় এ রকম দুটি রুম রয়েছে বনমালী ও ডাগর নামের। জোয়ারের সময় রিসোর্টের নিচের অংশ পানিতে প্লাবিত হয়ে সৃষ্টি করে অপার্থিব সৌন্দর্য। যাঁরা প্রকৃতি ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য নিঃসন্দেহে দারুণ একটি জায়গা। সবচেয়ে ভালো লাগবে পূর্ণিমা রাতে এখানে থাকলে। চাঁদের টানে জোয়ারের পানিও অনেক বেশি থাকে। চাইলে রিসোর্ট থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন সুন্দরবনের কোনো খাল ধরে ভেতরের দিকে। এ ছাড়া খুব কাছেই করমজল ও হাড়বাড়িয়া। নৌকা নিয়ে সেদিক থেকেও ঘুরে আসতে পারবেন। মোংলা পোর্ট থেকে ইরাবতী রিসোর্টে পৌঁছাতে সময় লাগবে এক থেকে দেড় ঘণ্টা, যা জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে।

৪. তরী ময়ূরাক্ষী

গত এক দশকে দেশে হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনের অনেক বিস্তার ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় করোনা–পরবর্তী সময়ে বেড়েছে হাওরে ভ্রমণ, যার অন্যতম কারণ হচ্ছে নান্দনিক সব হাউস বোট। নাগরিক সব সুবিধা নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে সিলেটের সুরমা নদীর স্বচ্ছ পানিতে ভেসে বেড়ানো এই বোটগুলো এখন ভ্রমণপ্রেমীদের পর্যটনের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
আকরাম হোসেন দীর্ঘ সময় ধরে অভিযাত্রী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে। এরপর শুরু করেন জোছনাতরী নামের নিজের ভ্রমণ গ্রুপ। সেখান থেকে ধীরে ধীরে হাওরে নিয়ে আসেন নিজের স্বপ্নের তরী ময়ূরাক্ষী। গত বছর থেকে যাত্রা শুরু করে তরী ময়ূরাক্ষী। এ বছর এসেছে ‘এ বাইনারি ফিউশন’ আর চিলেকোঠার সেপাই নামে আরও দুটি বোট। তিনিটি বোটই ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনে করা। স্বচ্ছ নীল ঢেউয়ের সঙ্গে উইন্ড চাইমের সুমধুর শব্দ হাওয়ায় আবেশ ছড়িয়ে দেয় এখানে। হাওরের বোটে ঢেউয়ের ছন্দে দীর্ঘক্ষণ বসে দেখা যায় দিগন্তজোড়া মেঘ, দূরের নীল পাহাড়ের সীমানা। এ সৌন্দর্য নিমেষেই ভুলিয়ে দেয় পরিশ্রান্ত জীবনের ক্লান্তি। এই হাউস বোটের নান্দনিকতা নিঃসন্দেহে চোখে আরাম দেয়। বোট চলতে শুরু করলেই হাওরের মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। নদীর পারজুড়ে তাকালে মনে হতে পারে কোনো জীবন্ত ল্যান্ডস্কেপের ভেতর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন আপনি। এই বোটে আনন্দভ্রমণের জন্য বিস্তারিত জানতে চলে যেতে পারেন তাদের পেজে।

তরী ময়ূরাক্ষী
তরী ময়ূরাক্ষী
কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্ট
কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্ট


৫. নওগাঁর কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্ট
রাজশাহী তো বিখ্যাত আমের জন্য। সেই থেকেই এমন নাম। বরেন্দ্র অঞ্চলে আম ও ধান চাষে রাসায়নিক ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা থেকে নওগাঁয় তৈরি হয়েছে কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্ট। এটি বর্তমানে দেশের ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে পর্যটনের একটি অন্যতম কাঙ্ক্ষিত স্থান। শুরুর দিকে বাগান ও খামার দেখাশোনার জন্য দুটি মাটির কুঁড়েঘর তৈরি করা হয়। গ্রামীণ পরিবেশ, নির্মল বাতাস আর সবুজের সমাহার উপভোগ করার জন্য দর্শনার্থীরা এখানে রাত যাপনের ইচ্ছে পোষণ করায় এ বছরের জানুয়ারিতে এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিস্তারিত রয়েছে তাদের ফেসবুক পেজে।

ছবিঃ লেখক ও ফেসবুক

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬: ০০
বিজ্ঞাপন