
ছুটিতে খুব সাধ করে সাজেক ভ্যালিতে গিয়ে দেখলেন গিজগিজে ভিড়। কোথাও চিপসের প্যাকেট, ডিসপোজিবল থালা-বাসন, বিরিয়ানির খালি প্যাকেটের স্তূপ পড়ে আছে। সেই প্রত্যন্ত নাফাখুমের জলধারা দেখতে গিয়ে দেখলেন সাঙ্গু নদে বর্জ্য-পলিথিন আর পেট বোতল ভাসছে। রাতারগুলের সোয়াম্প ফরেস্ট আর সুন্দরবনে প্যাকেজ ট্যুরে যাওয়া পর্যটক দলের চিল চিৎকার আর উচ্চ স্বরে বাজানো হালের হিন্দি গানের দৌরাত্ম্যে তো পশুপাখি ত্রাহি ত্রাহি করে পালানোর কথা।

আর আজকাল যেমন দুর্গম পাহাড়ে ট্রেকিং করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেলফি দেওয়ার চল হয়েছে, আলীকদম পেরিয়ে আলীর সুড়ঙ্গ বা মারায়নতং ট্রেকিং সাইটেও যে কিছু ব্যবহৃত মাস্ক পরে থাকবে না অথবা কোনো তথাকথিত পর্যটক দল যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাবে না—এমন নিশ্চয়তা দেওয়া আসলেই সম্ভব নয়। তাই আজ ২৭ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক পর্যটন দিবসে আমাদের সবারই শপথ নেওয়া উচিত, এ দেশের সমৃদ্ধ পর্যটনকেন্দ্র ও চেনা-অচেনা আকর্ষণীয় স্থানগুলোয় সুনৈতিক ও টেকসই পর্যটন নিশ্চিত করার। আমাদের দেশের পর্যটন ক্ষেত্রের এমন সব দিক নিয়ে বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে সবিস্তারে আলাপ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড.মো.বদরুজ্জামান ভুঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বর্তমানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বেও আছেন। তাঁর মতে, আমাদের দেশে এক্ষেত্রে হতাশাজনক চিত্রটি যেমন দুঃখজনক, তেমনি আশার আলোও রয়েছে বলে তিনি জোর দিয়েই বলেন।
আমাদের দেশে যেমন আছে পাহাড়পুর, ময়নামতি, পুঠিয়া, বাগেরহাট আর সোনারগাঁর মতো ইতিহাসের সাক্ষীস্বরূপ সব পর্যটনকেন্দ্র, তেমনি আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর উৎকর্ষের সব লীলাভূমি। কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত, প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, পতেঙ্গা ও কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকত, সিলেটের মালিনীছড়াসহ অন্যান্য স্থানের চা-বাগান, জাফলংয়ের পাথুরে জলাভূমি, বান্দরবান ও রাঙামাটির পার্বত্য এলাকা—এসব স্থানের সব কটিই বহু বছর ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে।
তবে আজকাল সরকারি-বেসরকারি, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও একটু প্রত্যন্ত, দুর্গম আর অন্য রকম পর্যটনস্থলগুলো সবার পছন্দের শীর্ষে উঠে এসেছে। যোগাযোগব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো হওয়ায় আজকাল মানুষ রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, বান্দরবানের নাফাখুম, দেবতাখুম বা অমিয়াখুম জলপ্রপাত, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, কিশোরগঞ্জের নিকলীর হাওর, রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি ইত্যাদি জায়গায় অনায়াসেই চলে যাচ্ছে দল বেঁধে। আবার নির্দিষ্ট কিছু উৎসব, যেমন চাকমা জনগোষ্ঠীর বিজু উৎসব, মণিপুরী রাস উৎসব, গারো জনগোষ্ঠীর ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সময়ে পর্যটনকেন্দ্র হয়ে ওঠে সেই স্থানগুলো।

পর্যটনশিল্পের সঠিক পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে, তা যেকোনো দেশেরই অর্থনৈতিক উন্নয়নে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে কর্মসংস্থান, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগের কার্যকারিতা এবং কাভারেজ বৃদ্ধি—এসব ব্যাপার যেন স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সবার জীবনযাপনের মানোন্নয়নের কাজে আসে, সেটা আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। বিশ্ব পর্যটন দিবসে এই বছরের থিম, কিন্তু এই কথাই বলে। অধ্যাপক বদরুজ্জামান ভুঁইয়ার কথাতেও সে বার্তাই পাওয়া গেল। তিনি বললেন, সাম্প্রতিক সময়ে সরকার দেশের পর্যটনে টেকসই উন্নয়নে অনেক সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু এজন্য পাবলিক ও প্রাইভেট ইন্ডাস্ট্রির মাঝে সমন্বয় দরকার। তিনি এও বলেন, এবারের প্রতিপাদ্যে যে সবুজ বা পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে তার জন্য জনসচেতনতা ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

আমাদের সকলের উচিত, পর্যটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত আর্থসামাজিক উপকারিতা এবং সুযোগ-সুবিধা যেন সবার মধ্যে সমবণ্টন হয়, সেই ব্যাপার নিশ্চিত করা। বিশেষত, এমনটা যাতে মোটেই না হয়, পর্যটনস্থলের নিজস্ব জনগোষ্ঠী অর্থকষ্টে ভোগার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনাহীন পর্যটন তরিকার মাশুল গুনবে দূষণ আর কোণঠাসা জীবনের দিনপঞ্জিতে, অথচ লাভের গুড় খেয়ে যাবে সুযোগসন্ধানী পিঁপড়েরা।
দুঃখের বিষয় হলো, সাজেক ভ্যালিতে যেমন একদিকে বিধিনিষেধ উঠলে রাতে থাকার সব জায়গা বুকড হয়ে যায়, সেই একই জায়গায় স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা অর্থকষ্টে ভুগে ত্রাণের আশায় পথ চেয়ে থাকেন। পর্যটনস্থলের গণমানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিষয়ে আজকের এই পর্যটন দিবসে যদি সর্বতোভাবে অঙ্গীকার না করা হয়, তবে শুধুই পরিবেশদূষণ ও স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহতকরণ ঘটবে ক্রমাগত, আর কিছুই নয়। কেবল অতিরিক্ত যানবাহনের চলাচলের কারণে টায়ারের ঘর্ষণে যে প্লাস্টিক কণা মিশে যাচ্ছে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর নির্মল নদী-হাওরে, তা অত্যন্ত ভীতিকর বলে গবেষকেরা জানান। জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রকে মারাত্মক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে এই প্লাস্টিকের সামগ্রী যেখানে-সেখানে ফেলা থেকে আইন করেই হোক, আর যেভাবেই হোক, পর্যটকদের নিরস্ত করতেই হবে।

সুনৈতিক বা এথিক্যাল পর্যটনের আরেক চরম ব্যত্যয় ঘটে, যখন কোনো স্থানীয় নারী নিগৃহীত হন কোনো তথাকথিত পর্যটকের হাতে। আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তার ব্যাপারগুলোও এ দেশে খুব কঠোর নয়, এসব প্রত্যন্ত পর্যটনস্থলে। এ সুযোগেই ঘটে যায় নান অপ্রীতিকর ঘটনা। আমাদের পর্যটকদের আরও একটি ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন আর সেটা হলো, সাঁতার না জেনে বা ভাটার সময়ে সমুদ্রে বা অন্য জলাভূমিতে না-নামা। অ্যাডভেঞ্চারের অদম্য আকর্ষণে খেই হারিয়ে ফেলে জীবন দিয়ে তার মাশুল দেন তাঁরা।

বিভিন্ন গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয়ভাবে ইকো ট্যুরিজম নীতি গ্রহণ করলেই কেবল প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে সুনৈতিক ও টেকসই পর্যটনশিল্প গড়ে উঠতে পারে। ইকো ট্যুরিজমের মূলনীতিতে প্রকৃতি ও মানবগোষ্ঠীকে যথাসম্ভব কম প্রভাবিত বা অনুরণিত করে পর্যটন নিশ্চিত করা হয়।

কলাতলী বা ইনানী সৈকত আজ এক আবর্জনার স্তূপ। সেখানে শব্দদূষণ আর পানিদূষণ করতে থাকা পর্যটকের দল একসময় ঠিকই বুঝতে বাধ্য হবে তাদের কুকর্মের ফল। কিন্তু তার আগেই আমরা সবার কাছে সুনৈতিক ও টেকসই পর্যটনের সুফলের গল্পগুলো পৌঁছে দিতে পারলে, আমাদের সবারই মঙ্গল।
আজকের দিনে তাই আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক যেন আমরা কোনো বর্জ্য ফেলে প্রকৃতিকে দূষিত করব না, স্থানীয় বাসিন্দাকেও বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকব, ক্ষতি করব না জীববৈচিত্র্যের। সুনীতি আর টেকসই নিয়মে এগোলে দেশের পর্যটনশিল্প আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত, হবে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং আর মিলবে অর্থনৈতিক সাফল্য।
ছবিঃ প্রথম আলো ও হাল ফ্যাশন