হাল ফ্যাশন ডেস্ক
সেই জন্মাবধি বাবা-মায়ের যত্নেই আমরা বেড়ে উঠি চারাগাছের মতো। একেবারে আভিধানিক অর্থেই নিজে না খেয়ে, না পরে, নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই মা-বাবারা আমাদের জীবনকে আরেকটু ভালো, ভবিষ্যৎকে আরেকটু নিশ্চিন্ত করার জন্য অবিরাম খেটে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। কিছু দুঃখজনক ব্যতিক্রম থাকলেও পৃথিবীতে মা-বাবার আশ্রয়, মমতা আর যত্নের কোনো তুলনা নেই। আজ যখন তাঁদের বয়স হয়েছে, সন্তানেরা বড় হয়ে গেছে, তখন সেই মা-বাবাকেও পরম মমতায় ও যত্নে রাখার দায়িত্ব এই আমাদেরই। সে যত্ন হতে পারে শরীরের বা মনেরও। মা-বাবা যেমন ছোটবেলায় আমাদের পছন্দের সাজপোশাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতেন, তাঁদের সেদিকটিও দেখে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ এখন।
বয়স হলে নানা রোগব্যাধি বাসা বাঁধতে চায় শরীরে। কিন্তু সঠিক জীবনযাপন, পুষ্টিকর খাদ্য, আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর বাসস্থান এবং পরিমিত ব্যায়ামের মাধ্যমে অনেকাংশেই রোগশোক তো বটেই, বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন শারীরিক অসুবিধাও প্রতিরোধ করা যায় অনেকাংশে। এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তানিয়া নাসরীনের সঙ্গে। তিনি বললেন, কিছু নিয়মিত সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা অবশ্যই করা উচিত মা-বাবাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে। এর মধ্যে রয়েছে রক্তে ও প্রস্রাবে গ্লুকোজের মাত্রা, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বুঝতে লিপিড প্রোফাইল এবং সেই সঙ্গে রক্তের সাধারণ ব্লাড কাউন্ট বা সিবিসি পরীক্ষা ইত্যাদি।
বাড়িতে রক্তচাপ ও রক্তের গ্লুকোজ মাপার যন্ত্র এবং অক্সিমিটার রাখা উচিত। মা-বাবাদের কারও যদি কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগ থেকে থাকে, তবে তাঁর নিয়মিত ওষুধ সেবন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের থাকার ঘরটিতে যেন পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। বেশি বয়স্ক মা-বাবাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী সার্বক্ষণিক অ্যাটেনডেন্ট ও কলবেলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত। তাঁদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে হলেও নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করাতে হবে। তাঁদের খাদ্যতালিকায় পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী তাজা ফলমূল, দুধ, ডিম, শাকসবজি ও মাছ রাখতে হবে।
আধুনিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শরীরের সার্বিক রোগপ্রতিরোধের ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমের একটি বড় অংশ হচ্ছে মানসিকভাবে ইতিবাচক ও সুস্থ থাকা। বর্তমান সময়ে নানাবিধ স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা, হতাশা, বিষাদ ও অবসাদ আমাদের সবারই পিছু নেয়। মা-বাবারাও তার ব্যতিক্রম নন। বরং ক্ষেত্রবিশেষে অবসরজীবনে বা সংসারে কিছু করার না থাকায় এবং একাকী সময় কাটাতে বাধ্য হওয়ায় এসব মানসিক রোগ আরও বেশি জেঁকে বসতে পারে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এ এইচ এম মুস্তাফিজুর রহমান নিজেও একজন বাবা। ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকলেই যে মা-বাবা একাকী হয়ে যাবেন, তা মানতে নারাজ তিনি। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের দিনে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ও উচ্চগতির ইন্টারনেটের বদৌলতে দূরে থেকেও বাবার কাছেই থাকা যায়। যাঁরা দেশে আছেন, তাঁদের উচিত মা-বাবাকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়া। মাঝেমধ্যে তাঁদেরকে ডাইন আউট, দিনব্যাপী ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া ভালো। দূরে কোথাও ছুটি কাটাতেও নিয়ে যাওয়া যায়। সর্বোপরি, মা-বাবার জন্য একটি সুশৃঙ্খল রুটিনযুক্ত জীবন নিশ্চিত করতে হবে। খোলা হাওয়ায় ব্যায়াম করা, সমবয়সী ও সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা, গঠনমূলক শখের কাজ, যেমন বাগান করা, লেখালেখি করার অভ্যাস থাকলে সে ব্যাপারে সহায়তা করতে হবে। তবে বিভিন্ন কারণে ক্রনিক পর্যায়ের হতাশা, শুচিবাই, ভুলে যাওয়া, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা, অতি দুশ্চিন্তা ইত্যাদি দেখা দিলে অবশ্যই মা-বাবাকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
পরিপাটি সুন্দর সাজপোশাক, পরিষ্কার ত্বক, গোছানো চুল বা দাড়িগোঁফ—এই ব্যাপারগুলো মা-বাবাদের মন ফুরফুরে রাখতে খুবই সাহায্য করবে। কে না চায়, তাকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় লাগুক। চুলে তেল লাগিয়ে দেওয়া যায় মা-বাবাকে পরম মমতায়। এই ফাঁকে চলুক টুকটাক গল্প, স্মৃতিরোমন্থন। বাবার দাড়িটি পরিপাটি রাখতে ট্রিমার ও গ্রুমিং টুলস ব্যবহার করা যায়। শিখিয়ে দেওয়ার সময় বাবা-ছেলের আন্তরিকতা বেড়ে যাবে আরেকটু। ত্বকের যত্নে ময়েশ্চারাইজার, ঠোঁটের লিপজেল বা বাম, চুল ও ত্বক পরিষ্কারে উপযোগী শ্যাম্পু, সাবান, ফেসওয়াশ ইত্যাদির জোগান ঠিক আছে কি না, দেখতে হবে। মায়ের শাড়ি বা অন্য পোশাক আর বাবার পাঞ্জাবি, কুর্তা, শার্ট ধুইয়ে, ইস্ত্রি করিয়ে রাখতে হবে হাতের কাছে। ধরে সঙ্গে করে নিয়ে ফেসিয়াল করিয়ে দিলেই-বা ঠেকাচ্ছে কে!
ছবি : বিশ্বরঙ, সাইফুল ইসলাম