আমার মা ফরিদা ইয়াসমিন খুবই নরম স্বভাবের এবং বড় মনের মানুষ ছিলেন। অনেকে আছেন রাগলেও প্রকাশ করেন না; বরং তা আবার মনে পুষে রাখেন। আমার মা মোটেও ওই ধরনের ছিলেন না। মা মারা যাওয়ার পর সবচেয়ে বেশি যেটা মনে পড়ে তা হলো, বাবা বা আমার বড় ভাইয়েরা আমাকে শাসন করলে তিনি আমাকে সেখান থেকে বাঁচাতেন। তিনি আমার ত্রাতা ছিলেন।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। আমার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে বাগেরহাটে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে চলে আসি ঢাকায়। মাধ্যমিকের পর থেকে প্রায়ই ঢাকায় আসতাম। ঢাকায় এলেই মা অনেক কান্নাকাটি করতেন। তিনি জানেন যে খুব অল্প সময়ের জন্য যাচ্ছি, আবার ফিরে আসব, তারপরও কাঁদতেন। শুধু আমার বেলায় নয়, আমার অন্য ভাইবোনেরাও কোথাও গেলে এমন করতেন। আমি জানি না আর কারও মা ছেলেমেয়েরা কোথাও গেলে এভাবে কান্নাকাটি করে কি না।
কাজের সুবাদে প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হয় আমাকে। মা এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করতেন। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, সারাক্ষণ শুধু এটা ভাবতেন। দেশে ফিরলে মা আমাকে বলতেন, ‘এবারই শেষ! দেশের বাইরে অনেক কাজ করা হয়েছে। আর যাওয়া লাগবে না।’
আমার নানাবাড়ি খানজাহান আলী (রহ.)–এর মাজারের পেছনে। অনেক ছোট থাকতে মায়ের সঙ্গে সেখানে বেড়াতে যেতাম। মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে। ওই মুহূর্ত আর ওই সময়ের যে অনুভূতি, সেটা এখন বেশি মনে পড়ে। এখনো ওই সময়টা মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। আর নানাবাড়ি গেলে মা যেমন খুশি হতেন, মনে হয় পুরো দুনিয়া এনে দিলেও এত খুশি হতেন না।
মায়ের হাতের সব রান্নাই আমার প্রিয় ছিল। সেমাই ছিল বেশি প্রিয়। মায়ের রান্না করা সেমাই ছাড়া তিন ঈদ চলে গেল। এখন আমার বড় বোনেরা মায়ের মতো করে রান্না করার চেষ্টা করে। সেই খাবারগুলো খুব মজাও হয়। কিন্তু মায়ের মতো হয় না।
আমি ছোটবেলায় খুব খেলাধুলা করতাম। এ জন্য হয়তো আমার অসুখ কম হতো। তাই একটু জ্বর, ঠান্ডা-কাশি হলে মা বাড়ির আশপাশ থেকে কী সব ঔষধি পাতা এনে আমাকে খাইয়ে দিতেন। পেট খারাপ হলে থানকুনি পাতা বেটে ভাতের সঙ্গে মাখিয়ে খাইয়ে দিতেন। আমি সুস্থ হয়ে যেতাম। মনে পড়ে, একবার আমার চিকেনপক্স হয়েছিল। সে সময় মা সারা রাত আমার জন্য জেগে থাকতেন।
আমার মা শাড়ি পছন্দ করতেন। শাড়ি ছাড়া তাঁকে কখনো অন্য পোশাকে দেখিনি। লাল রং মায়ের খুব প্রিয় ছিল। মাকে উপহার দিতে হলে বেছে বেছে লাল রঙের সব কিছু কিনতাম। মা খুব খুশি হতেন। বাসায় আমাকে সবাই মোহন বলে ডাকে। মা ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখাতেন আর বলতেন, ‘দেখো মোহন যা দিয়েছে তা সব থেকে সুন্দর।’
ঘরে তৈরি যেকোনো খাবার মা পছন্দ করতেন। বাইরের খাবার কখনোই খেতেন না। গরুর মাংস একটু বেশিই পছন্দ করতেন। আমরা ভাইবোনেরা তো বাড়িতে থাকতাম না। মা সারাক্ষণ অপেক্ষায় থাকতেন, কবে আমরা বাড়ি যাব বা তিনি কবে আমাদের কাছে আসবেন।
মডেলিংয়ের ব্যাপারে সব সময় পরিবারের সমর্থন পেয়েছি। তবে আমার সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন মা। আমার মনে পড়ে, আমি ২০১০ সালে যখন প্রথম ফটোশুটে অংশ নিই। তখন এমন ফটোশুটের কথা আমাদের দেশে ভাবাও যেত না। বেশ খোলামেলা ছবি তুলতে হয়েছিল। ঢাকাতেই এটি নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। অথচ সেসব ছবি আমি মাকে দেখালে মা বেশ খুশিই হয়েছিলেন। তিনি সারা জীবন গ্রামে কাটিয়েছেন; কিন্তু এ নিয়ে কোনো আপত্তি কখনো করেননি। তিনি সব সময় আমাকে বিশ্বাস করতেন, ভরসা করতেন। তিনি জানতেন আমি যা–ই করি না কেন, সেটা ভালো করব।
মাকে আমি কখনো খুব একটা অসুস্থ হতে দেখিনি। গত বছরের এপ্রিলে যখন দেশে কোভিড পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে, তখন মা অসুস্থ হলেন। সেই যে অসুস্থ হলেন, আর সুস্থ হলেন না। হঠাৎ করে মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যুটা আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল।
এখন সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে, যে মানুষটা সবাইকে এত আগলে রাখতেন, কোথাও কেউ গেলে অল্পতেই কান্নাকাটি করতেন, তিনি কিনা সবাইকে রেখে সবার আগে চলে গেলেন। মা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন বুঝিনি আশপাশের মানুষ তাঁকে এত পছন্দ করেন। মা মারা গেলে সবাই এসেছেন। এত মানুষ যে আসবেন, তা আমরা কখনো ভাবতেই পারিনি। আমাদের কাউকে বলাও লাগেনি। নিশ্চয় তাঁর ভেতরে এমন কিছু ছিল, যার জন্য সবাই তাঁকে ভালোবেসেছে। সত্যি বলতে, আমি আমার মায়ের এমন কিছু নেই যা মিস করি না। সব কিছুই মিস করি। এখন মায়ের জন্য অনেক দোয়া করি। যেখানে থাকুন, ভালো থাকুন।
অনুলিখন: ফাহমিদা শিকদার
ছবি: আজিমের পারিবারিক অ্যালবাম ও হাল ফ্যাশন