নিজের জন্য প্রতিদিন সময় বের করবেন যেভাবে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ভোরের আলো ফুটতেই হেঁশেলে পা দেওয়া। ঘরের ছোট-বড় সবার দেখভাল, রান্নার ঝক্কি, ঘর-দুয়ার পরিপাটি আর পরিষ্কার রাখা। ছুটির দিনেও ছুটি নেই। আবার কারও দিনের শুরুটা আরেকটু ভিন্ন। নাকেমুখে দুটো গুঁজেই বেরিয়ে পড়া জীবনযুদ্ধে। সবাইকে আরেকটু ভালো রাখার তাগিদে নিজেই হয়তো ভালো নেই। ধীরে ধীরে অজান্তেই নানা নেতিবাচকতা গ্রাস করছে এই মানুষগুলোকে। জীবনের পথে ছুটতে ছুটতে জীবনটাই হয়ে যায় বিপন্ন। আর মনোবিজ্ঞানী ও মনোসামাজিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর একমাত্র মোক্ষম দাওয়াই হচ্ছে নিয়ম মেনে নিয়মিত নিজেকে সময় দেওয়া, যাকে বলে ‘মি টাইম’।

নিজের জন্য নিজের সময়

মনোবিজ্ঞানী ও আর্ট থেরাপিস্ট জাহিদ হাসান নীল বলেন, ‘মি টাইম’-এর ধারণাটি শুধু সবার মুখে মুখে ঘুরে বেড়ালেই হবে না, এর চর্চাও করতে হবে। প্রচলিত এ ধারণা সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞানও থাকতে হবে। এর অর্থ নিছক একাকী সময় কাটানো নয়। নিজের উপস্থিতি, মূল্য আর অস্তিত্বকে গভীরভাবে অনুভব করাই এর উদ্দেশ্য। নিজের সান্নিধ্যে কাটানো অল্প কিছুক্ষণ সময়ও কাজে লাগাতে হবে কার্যকরভাবে। এ যেন ব্যাটারি রিচার্জ করার মতো একটি বিষয়। তাই নিজের জন্য প্রতিদিন কিছুটা সময় রাখা জরুরি। তবে প্রতিটি মানুষের জন্য এ সময় কাটানোর পদ্ধতি হতে পারে ভিন্ন।

বিজ্ঞাপন

কেমন করে বের করবেন সময়

তত্ত্বকথায় শুনতে সহজ হলেও অস্থির এই ছুটে চলা সময়ে নিজের জন্য সময় বের করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। আবার বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিজের জন্য মূল্যবান এ সময় গঠনমূলকভাবে ব্যবহার করলেই এর দীর্ঘমেয়াদি সুফল মেলে। তাই নিছক দিনে এক ঘণ্টা মুঠোফোনে এলোপাতাড়ি সময় কাটালে বা টিভির রিমোট হাতে একের পর এক চ্যানেল ঘুরালে মি টাইম সার্থক হবে না। নিজের যত্নে বা নিজের বিকাশে যেন এ সময়টুকু ভূমিকা রাখে, সেভাবেই সাজাতে হবে দিনপঞ্জি।

এ সময় বের করতে গেলে সবার আগে শিখতে হবে ‘না’ বলা। ঘরেই হোক, আর কর্মক্ষেত্রে— সবার সব নির্দেশ আর ফরমাশ মানতে মানতে নাওয়া-খাওয়ার সময় সংকুচিত হয়ে আসে একসময়। তাই নিজের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বুঝেই দায়িত্ব নিতে হবে। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের আবশ্যক দায়িত্বগুলো সম্পন্ন করেই কিছুটা সময় বরাদ্দ করতে হবে নিজের জন্য। ক্যালেন্ডার নিয়ে বসতে হবে একাকী। খুব কঠোরভাবেই দাগিয়ে বা লিখে রাখতে হবে দিন-তারিখ আর সময়। হঠাৎ হঠাৎ নয়, নিয়মিত এ সময় বের করে কাজে লাগাতে হবে নিজে ভালো থাকতে।

কী করবেন এ সময়ে

একেকজনের ক্ষেত্রে এই নিজস্ব সময় কাটানোর ধরন একেক রকম হবে, এটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত ভালো লাগা, লিঙ্গ বা বয়সভেদেও ভিন্নতা থাকবে। যাঁরা পড়তে ভালোবাসেন খুব, লাইব্রেরি বা বুক-ক্যাফেতে কাটানো সময় তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো লাগার। নতুন বা প্রিয় কোনো বইয়ে ডুব দেওয়া যায় চায়ের কাপ হাতে। কারও হয়তো সবচেয়ে প্রিয় প্রকৃতির সান্নিধ্য। আগে থেকে পরিকল্পনা করে বা হুট করে বেরিয়ে পড়া যায় সমুদ্র, পাহাড় বা হাওর দর্শনে। ভোরে উঠে একাকী পার্কে হেঁটে এলে বা কোনো এক বিকেলে আশপাশের কোনো নদীর ধারে সময় কাটালেও ভালো লাগবে। নিজের পছন্দের কেনাকাটা করা, রূপচর্চা অথবা পারসোনাল কেয়ারের দারুণ উপায় নিজের সঙ্গে সময় কাটানো। এতে নিজেকে মূল্য দেওয়া হয়, নিজের কাছে নিজে হয়ে ওঠা যায় বিশেষ কেউ। ব্যায়ামাগারে গিয়ে শরীরচর্চা করা বা নিরিবিলি একাকী যোগব্যায়াম করা অনেকের জন্য জাদুর মতো কাজ করে, করে তোলে ভেতর থেকে তরতাজা। ধুলাপড়া হারমোনিয়াম বা তানপুরাটি মুছে নিয়ে বসা যেতে পারে। পছন্দের গানের ঝাঁপি খুলে ভেসে যাওয়া যায় সুরের স্রোতে। হয়তো রংতুলি নিয়ে বসা হয়নি অনেক দিন, প্রিয় বেকিংয়ের সামগ্রী পড়ে আছে গুদামঘরে। নিজের জন্য সময়টুকু নিজেরই প্রিয় কোনো কাজে ব্যয় করতে হবে, এটাই মোদ্দাকথা।

বিজ্ঞাপন

কতটুকু সময় যথেষ্ট

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নির্ভরযোগ্য ও সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৩০ মিনিট নিজের জন্য ব্যয় করলে তা অত্যন্ত ইতিবাচক হতে পারে জীবনের জন্য।

তবে মনোবিদ জাহিদ হাসান নীল বলেন, এ সময় ঠিক কতটুকু হবে, তার বাঁধাধরা নিয়ম নেই। একেকজনের জন্য তা হবে একেক রকম। হয়তো খুব ব্যস্ত জীবনপঞ্জি হতে দিনে ২০-৩০ মিনিট একেবারে নিয়মিত নিজের জন্য বের করে নিলে তা হতে পারে অত্যন্ত ফলপ্রসূ। মাঝেমধ্যে মাসে একটি সম্পূর্ণ দিন বা বছরে তিন দিন থেকে এক সপ্তাহের একটি অবকাশযাপনও বেশ কার্যকর।

নিজের জন্য সময় বের করার গুরুত্ব

মন আর শরীর আসলে একেবারেই জড়িয়ে আছে একসঙ্গে। জাহিদ হাসান নীল বলেন, মন আর শরীরের তাল-লয়ে কম হলে দুটিই প্রভাবিত হয়। মানসিক চাপ আর দুশ্চিন্তা যেমন শরীরে রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ, মাইগ্রেনের মতো অসুখের কারণ হতে পারে, তেমনি শরীরের জড়তা, ব্যথা-বেদনা ও অস্বস্তি একসময় মনে সংক্রামিত হয়। দেহ–মনকে ভালো রাখতে রীতিমতো পরিকল্পনা করে সুচিন্তিত কাজে নিজের জন্য নিয়মিত সময় কাটানোর জুড়ি মেলা ভার। এতে মন থাকে প্রফুল্ল, শরীরেও মেলে নবশক্তি। সবশেষে বলা যায়, এতে পারিবারিক আর সামাজিক সম্পর্কগুলোও উপকৃত হয়।

মানুষ হিসেবে নিজেই নিজেকে যথাযথ গুরুত্ব বা মূল্য না দিলে অন্যদের থেকে আর কীই–বা প্রত্যাশা করা যায়। প্রথম প্রথম বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে পারে নিজের জন্য নিয়ম করে সময় কাটানোর বিষয়টি। কিন্তু এ নিয়ে দ্বিধা, গ্লানিতে ভুগলে চলবে না। নিজে ভালো না থাকলে অন্য কাউকে ভালো রাখাটা অধরা স্বপ্নমাত্র, এই বোধটুকু সবারই থাকতে হবে।

ছবি: সাইফুল ইসলাম ও গোলাম রাউফু

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৩, ০২: ০০
বিজ্ঞাপন