মানবিক ও পরিবেশ বিপর্যয়ে ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধের পরিণতি হবে ভয়ংকর
শেয়ার করুন
ফলো করুন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন, সংকীর্ণ স্বার্থ এবং জাতিগত অহংকারই যুদ্ধের মূল কারণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, যত দিন মানুষ এই সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত না হবে, তত দিন যুদ্ধ চলতেই থাকবে। তার ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে তিনি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পরিবর্তে জীবনের জয়গান গেয়েছেন এবং মানুষের মধ্যে ঐক্য ও ভালোবাসার প্রসারের আহ্বান জানিয়েছেন।

মানবিক বিপর্যয়ের জন্য এখন কেবল অপেক্ষা করতে হবে
মানবিক বিপর্যয়ের জন্য এখন কেবল অপেক্ষা করতে হবে

সেই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে বেশ অনেকদিন হয় যোগ হয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও। ফলে যুদ্ধ তাদের অধিকারে পরিণত হয়েছে। এমনকি যুদ্ধ কখনোই স্থায়ী সমাধান নয় জেনেও তাদের কিছু যায়–আসে না। তারা শক্তির প্রদর্শন করে। তাদের অন্যায্য চড়াওয়ে সৃষ্টি হয় নতুন দুর্যোগের।

বিজ্ঞাপন

গাজায় হামলায় সেখানকার মানুষ দিশাহারা। এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে কাটছে তাদের মানবেতর জীবন। ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে শিশুরা। এরই মাঝে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ সৃষ্টি করেছে নতুন সংকটের। এই যুদ্ধের সম্ভাব্য বিস্তার শুধু দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না—এটা ইতিমধ্যে হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের কারণ। ইতিহাস সাক্ষী, পারমাণবিক বা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে ক্ষতির রেশ থেকে যায় শত বছর ধরে। তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আর যুদ্ধ নয়’ কবিতার শুরুর দুটো লাইন: ‘কার দিকে তুমি গুলি ছুঁড়ছো হে, এখানে সবাই মানুষ!/ তুমি কে, তুমি কি গ্রহান্তরের দলছুট?’

এ যুদ্ধ শেষ হলেও কিন্তু রক্ষা নেই
এ যুদ্ধ শেষ হলেও কিন্তু রক্ষা নেই

এ প্রশ্ন বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের। কেবল কিছু যুদ্ধংদেহী ব্যতিরেকে। তাই ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই আপাত বিরতি মানেই যুদ্ধের শেষ। যদি শেষ হয়েও যায়, তাহলেও এর রেশ থেকে যাবে বহুদিন। যেটা হবে যুদ্ধাবস্থার চেয়েও ভয়াবহ, বহুমাত্রিক ও সুদূরপ্রসারী। বিশ্ব এখন হিসাব মেলাতে বসেছে যুদ্ধ–পরবর্তী নানা বিষয় নিয়ে। এই সময়ে আমরাও একটু দেখে নিতে পারি সম্ভাব্য কত ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে মানুষ। কত ধরনের বিপদ অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।

বিজ্ঞাপন

পরিবেশের দুর্বিষহ বিপর্যয়

পরিবেশ পড়বে ঝুঁকিতে
পরিবেশ পড়বে ঝুঁকিতে

বিস্ফোরণ, জ্বালানি পোড়ানো ও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে বাতাস, পানি ও মাটি ভয়াবহভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। গাছপালা পুড়ে গেছে, বন্য প্রাণী মারা গেছে বা আবাস হারিয়েছে। নদীনালায় ছড়িয়েছে বিষক্রিয়া। যুদ্ধক্ষেত্র শুধু মানুষের নয়, প্রকৃতিরও মৃত্যুস্থল হয়ে ওঠে। হয়েছেও তা–ই।

বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হবে

জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরাণ্বিত করবে
জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরাণ্বিত করবে

যুদ্ধে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও বিস্ফোরকের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ঘটেছে। এতে বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বাড়বে, বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং জলবায়ু হয়ে পড়বে অস্থির। খরা, বন্যা ও দাবানলের মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়তে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনকি ‘নিউক্লিয়ার উইন্টার’-এর সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ধোঁয়া ও ছাই সূর্যের আলোকে প্রতিহত করবে; পরবর্তী পর্যায়ে গ্যাসের ঘনত্ব বাড়াবে উষ্ণতা।

জনস্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব

সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য প্রভাবিত হবে নেতিবাচকভাবে
সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য প্রভাবিত হবে নেতিবাচকভাবে

বাতাসে ভেসে বেড়ানো সূক্ষ্ম ধূলিকণা ও বিষাক্ত গ্যাসে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর যুদ্ধকবলিত অঞ্চলে সেটা বাড়ে। ইরান ও ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি এরই মধ্যে হয়েছে। ফলে বাড়তে পারে নানা ধরনের রোগ। এর মধ্যে আছে অ্যাজমা ও ফুসফুসের সমস্যা, ক্যানসার, চোখ ও ত্বকের প্রদাহ, হরমোনের সমস্যা। পাশাপাশি হ্রাস পাবে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে, এই দূষণের কারণে বিকলাঙ্গ শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে। তেজস্ক্রিয়তা ডিএনএর মিউটেশন ঘটায়, যার প্রভাব পড়বে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর। এমনকি গর্ভবতী মায়েদেরও সমস্যা হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যের অন্ধকার অধ্যায়

অবনতি হবে মানসিক স্বাস্থ্যের
অবনতি হবে মানসিক স্বাস্থ্যের

যুদ্ধ মানুষকে কেবল আহত বা নিহতই করে না, মানসিকভাবে ধ্বংস করে। প্রিয়জন হারানো, নিরাপত্তাহীনতা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ভুগতে ভুগতে মানুষ ভেঙে পড়ে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় শিশু ও নারীরা। এই যুদ্ধে যেসব মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে: পিটিএসডি বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন ও আতঙ্ক, আত্মহত্যার প্রবণতা, ঘুমের সমস্যা ও দুঃস্বপ্ন, সহিংস আচরণ।

কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় বিপর্যয়

কমে যাবে মাটির উর্বরতা
কমে যাবে মাটির উর্বরতা

যুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এসব বোমার রাসায়নিক পদার্থ মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয়। এতে ফসল উৎপাদন কমে যায়, ফলে খাদ্যসংকট অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দেয়। খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশে গিয়ে তা মানবদেহে ক্যানসার, কিডনির রোগ ও হরমোনের সমস্যার সৃষ্টি করে। ফল ও শাকসবজির উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। একই সঙ্গে কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই বেড়ে যায়; এতে কৃষি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বাতাস হয়ে ওঠে বিষাক্ত

বাতাস হয়ে উঠবে বিষাক্ত
বাতাস হয়ে উঠবে বিষাক্ত

যুদ্ধ চলাকালে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই–অক্সাইড এবং ক্ষতিকর সূক্ষ্ম কণিকা (PM2.5, PM10)। এসব উপাদান ফুসফুসের গভীরে গিয়ে রক্তে মিশে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে।

ভবিষ্যৎ যেভাবে বিপন্ন

শিশুদের বিকাশ থমকে যাবে
শিশুদের বিকাশ থমকে যাবে

এই যুদ্ধ শুধু বর্তমান প্রজন্ম নয়, ভবিষ্যৎকেও বিপর্যস্ত করে তুলবে। দূষিত পরিবেশ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও খাদ্যসংকটে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ থেমে যাবে। ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানী, লেখক, চিকিৎসক কিংবা কৃষক—সবই যেন এক অনিশ্চিত অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।

উদ্বাস্তু সংকটের অনুঘটক

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

খাদ্য, পানি ও আশ্রয়ের সংকটে লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালাবে। এতে সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে তৈরি হবে উদ্বাস্তু সংকট, বাড়বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা।

ধ্বংস হবে সামুদ্রিক জীবন

প্রভাব হবে সুদুরপ্রসারী
প্রভাব হবে সুদুরপ্রসারী

বোমার আঘাতে সৃষ্ট কম্পন ও রাসায়নিক নিঃসরণ সাগর ও নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করবে। বিশেষত মাছ ও প্রবালের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।

সামগ্রিক প্রভাব

দীর্ঘস্থায়ী হবে এর রেশ
দীর্ঘস্থায়ী হবে এর রেশ

যুদ্ধ শেষে দীর্ঘ সময় ধরে (অন্তত দশকজুড়ে) এই ক্ষয়ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। একে বলা যায় ‘সাইলেন্ট আফটারম্যাথ’, অর্থাৎ যুদ্ধ শেষ হলেও ক্ষয়ক্ষতি চলতেই থাকে।

শান্তিই মানবতার একমাত্র আশ্রয়

সাধারণ মানুষ কখনোই চায় না যুদ্ধ
সাধারণ মানুষ কখনোই চায় না যুদ্ধ

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে পূর্ণমাত্রায় শুরু হলে সেটা কেবল একটি যুদ্ধ থাকবে না; বরং হয়ে উঠবে পৃথিবীর ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধ। পরিবেশ, স্বাস্থ্য, মানবতা, কৃষি—সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই কূটনীতি, সহনশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠাই হতে পারে একমাত্র যৌক্তিক ও মানবিক সমাধান।

ছবি: ইন্সটাগ্রাম ও উইকিপিডিয়া

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ০৫: ০০
বিজ্ঞাপন