পার্সিয়ান কার্পেট বা ইরানি গালিচা বিশ্বের অন্যতম দামি ও নান্দনিক কার্পেট হিসেবে স্বীকৃত। এসব কার্পেটের উচ্চমূল্যের প্রধান কারণ হলো হাতে বোনার জটিল প্রক্রিয়া এবং খুবই উৎকৃষ্ট মানের উপকরণ ব্যবহার। উল, সিল্ক এবং কখনো কখনো সোনা বা রুপার সুতা ব্যবহার করে শতভাগ হাতে বোনা হয় এই গালিচা। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ কতটা প্রভাব ফেলছে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পে, সেটি একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
পার্সিয়ান গালিচার ইতিহাস প্রায় ২ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো। এটি পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই চলে আসছে, যা হয়ে উঠেছে ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শুধু ঘর সাজানোর উপকরণ নয়, এই গালিচা একেকটি শিল্পকর্ম, যার মাধ্যমে ফুটে ওঠে পারস্য সভ্যতার নান্দনিক রুচি, স্থায়িত্ব ও শিল্পবোধ। ইরানের অধিবাসীদের কাছে এটা এক ‘লিভিং ক্র্যাফটস’।
ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে পার্সিয়ান কার্পেট তৈরির পদ্ধতি আলাদা। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব নকশা, রং ও বুননের ধরন আলাদা। ইরানের বিখ্যাত গাব্বেহ (Gabbeh) কার্পেট হয় দক্ষিণ–পশ্চিম ইরানের পাহাড়, পর্বত, অরণ্যসমৃদ্ধ ‘ফার্স’ অঞ্চলে; তাই এই কার্পেটের মোটিফে দেখা যায় পাহাড়ি বয়ন; এই বয়নশৈলী ‘ইউনেসকো ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্থানীয় আদিবাসী নারীরা এই কার্পেট বুনে থাকেন।
‘ইস্পাহান’ অঞ্চলের ইম্প্রোভাইজড বা তাৎক্ষণিক নকশা ব্যবহার করা হয়, যেখানে গাছ, ভেড়া, ফুলসহ বিভিন্ন মোটিফ বয়নের সময় শিল্পীর সৃজনশীলতা প্রকাশ পায়। আবার ‘কুম’ অঞ্চলের কার্পেটে থাকে সূক্ষ্ম কাজ। ‘বিদজার’ অঞ্চলের কার্পেট হয় জটিল জ্যামিতিক নকশায়।
একটি পার্সিয়ান গালিচা তৈরি করতে দুই মাস থেকে বছরও লেগে যেতে পারে। এটি শুধু কার্পেট নয়; বরং একটি সংস্কৃতির গল্প। সিল্ক দিয়ে একটি এক মিটার কার্পেট বুনোতে ১০০০ গেরো দিতে হয়, যা খুবই সূক্ষ্মতম বিষয় ও ধৈর্যের কাজ। গুণগত মান, রঙের দীর্ঘস্থায়িত্ব আর সূক্ষ্ম ডিজাইন এই গালিচাগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে।
বর্তমানে গালিচার মান নির্ধারণে নট কাউন্ট নয়; বরং উপকরণ ও নকশাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১২ মিটারের একটি কার্পেট বুনতে সময় লাগে দুই বছর। চারজন মানুষ একসঙ্গে বুনতে শুরু করে একটি কার্পেট। এই বয়নশৈলী বেশ জটিল। তবে কেউ কাশকাই (Qashqai) পদ্ধতিতে বুনলে তাঁর পক্ষে তাবরিজি বা ইস্পাহান–পদ্ধতিতে বোনা সম্ভব না। একেকজন শিল্পী একেক ধরনের বয়নে পারদর্শী।
যদিও বিশ্বব্যাপী পার্সিয়ান কার্পেটের কদর আছে, বিশেষ করে শিল্প সংগ্রাহকদের কাছে। তারপরও এই শিল্প বিপদের মুখে পড়েছে চলমান ইরান- ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে। বেশ আগে থেকেই নতুন প্রজন্ম হস্তশিল্পের প্রতি আগ্রহ হারানোয় দক্ষ বয়নশিল্পীর সংখ্যা কমে আসছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী নকশা ও পদ্ধতি বিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই শিল্পকর্মের অন্যতম ক্রেতা হচ্ছে এখানে আগত বিদেশি পর্যটকেরা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইরানের পর্যটনশিল্পে পড়েছে মারাত্মক প্রভাব। আকাশযুদ্ধের কারণে এ রুটের ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রভাব পড়ছে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পেও।
২০২৪ সালে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ঘিরে নতুন করে পশ্চিমা বিশ্ব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা ও উত্তেজনার আগে ইরানের গালিচা রপ্তানি বছরে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। আজ তা নেমে এসেছে ৫০ মিলিয়ন ডলারের নিচে।
বর্তমানে পার্সিয়ান কার্পেট আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাসম্পন্ন হলেও তুরস্ক এই শিল্পে বড় প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে। বিগত এক দশকের হিসাব অনুযায়ী তুরস্ক বছরে প্রায় ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের হাতে বোনা কার্পেট রপ্তানি করে, যা ইরানের তুলনায় অনেক বেশি। এই প্রতিযোগিতা ইরানি কার্পেটের বাজার ধরে রাখার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
পার্সিয়ান গালিচার প্রতি সারা বিশ্বের চাহিদার প্রমাণ হলো, একটি ১৭০০ শতাব্দীর পার্সিয়ান কার্পেট, যা নিলামে ৩৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি কার্পেটগুলোর একটি এবং এই শিল্পের প্রতি বিশ্ববাজারের উচ্চমূল্যায়নের প্রতিফলন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা এটিকে ‘শিল্পের পতন’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনৈতিক লেনদেন ও বৈদেশিক বাণিজ্য প্রায় ১০ লাখ ইরানির কর্মসংস্থান ছিল এই খাতে। এরই মধ্যে অনেকে কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে কাশান, তাবরিজ, ইয়াজদ ও কেরমানের মতো ঐতিহ্যবাহী গালিচা উৎপাদন কেন্দ্রের বয়নশিল্পীরা চরম সংকটে আছেন।
বিক্রি না হওয়ায় এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে তারা দিনে মাত্র চার ডলার পর্যন্ত আয় করছেন বলে সংবাদমাধ্যমে আসছে। ফলে অনেকেই বয়নশিল্পকে পেশা হিসেবে ধরে রাখতে পারছেন না। গালিচা শিল্প শুধু বয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুতা কাটা, ডিজাইন তৈরি, রং করা, বাজারজাতকরণ একাধিক পেশা ও খাত। রপ্তানি কমে যাওয়ার ফলে এসব ক্ষেত্রেও সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে।বাধাগ্রস্ত হয়েছে, ফলে রপ্তানিকারকদের বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
পার্সিয়ান কার্পেট শুধু একটি কার্পেট নয়, এটি একটি ইতিহাস ও শিল্পের উত্তরাধিকার। এটি যেমন গৃহসজ্জায় অনন্য, তেমনি একটি জাতির সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। তবে আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ ও প্রতিযোগিতার ভিড়ে এই ঐতিহ্য রক্ষা করা এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ নয়, আমরা চাই শান্তি। বিশ্বের সব শিল্প বেঁচে থাকুক শিকড়ের অস্তিত্ব ধরে রেখে।
ছবি: উইকিপিডিয়া ও ইন্সটাগ্রাম