টেপাপুতুল, শখের হাঁড়ি, লক্ষ্মীসরা, নানা রকমের খেলনা—সব কটিই যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আর শুধু আটপৌরে ব্যবহার্য জিনিস হিসেবে নয়, নানা রঙে রাঙিয়ে তোলা মাটির তৈরি এসব সামগ্রী অত্যন্ত মূল্যবান নান্দনিক শিল্পকর্ম হিসেবেও। অতীত আর বর্তমান সময়ের এমন সব মাটির তৈরি সামগ্রী নিয়ে বেঙ্গল আর্টস প্রোগ্রামের আয়োজনে ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে ২৯ জুলাই শুরু হয়েছে ‘বাংলাদেশের লোকশিল্প: চিত্রিত মৃৎশিল্প’ শিরোনামে বিশেষ প্রদর্শনীর।
অধ্যাপক নিসার হোসেনের গবেষণা ও নির্দেশনায় প্রদর্শনীটি রূপায়িত হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিসার হোসেন বলেন, ‘মৃৎশিল্পের পেছনের গল্প বা ভাবনা বাদ দিয়ে আমরা শুধু সেই সামগ্রীটি নিয়ে থাকি। এই প্রদর্শনীতে আমরা মাটির তৈরি এসব সামগ্রীর পেছনের গল্প, প্রক্রিয়া ও ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’
তিনি বলেন, এ ছাড়া এই প্রদর্শনীর আরও একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে জানানো যে এখনো বাংলাদেশে বেশ বড় পরিসরে মৃৎশিল্পের চর্চা হয় এবং সেগুলো সংগ্রহও করা হয়। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা, এই শহুরে মানুষেরা যদি টেপাপুতুল, খেলনা আর শখের হাঁড়ি কিনি, ব্যবহার করি আর আমাদের নিত্যকার জীবনযাত্রার অংশে পরিণত করি, তবেই মৃৎশিল্পী ও এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে।’
প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকারকর্মী, সংগ্রাহক ও কারুশিল্প গবেষক ড. হামিদা হোসেন। তিনি বলেন, পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মৃৎশিল্পের সামগ্রীগুলো বদলেছে। তিনি আশাবাদ জানান, এই শৈলীর বিবর্তন সবাই দেখবেন এবং এ নিয়ে ভাববেন।
এদিন বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কনিষ্ঠ পুত্র ময়নুল আবেদিন ও বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্র শেখর সাহা। ময়নুল আবেদিন তাঁর সংগ্রহ সম্পর্কে বলেন, ‘আমার বাবার মৃৎশিল্প সংগ্রহের সঙ্গে বসবাস করতে করতে আমার মাথায় এই শিল্পের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য এই অংশ নিয়ে কাজ করা, নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা শিল্পাঙ্গনের সবার দায়িত্ব।’
চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, `লোকশিল্পকে দেখতে হবে যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর চোখ দিয়ে, তাহলেই এর আসল মর্ম অনুধাবন করা যাবে।'
বাংলাদেশের বেশ কিছু জেলায় বর্তমানে মৃৎশিল্প নিয়ে কোথায় কী হচ্ছে, তার তথ্য এবং সেখানকার মৃৎশিল্পের নিদর্শন প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রদর্শনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিভিন্ন ঐতিহাসিক মৃৎপাত্র, যা ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদেরর কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, তিনি আশা করছেন, এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে নানা বর্ণ, আকৃতি ও অলংকরণে উজ্জ্বল আর বিপন্নপ্রায় মৃৎশিল্পের বিপুল বৈচিত্র্য ও শৈল্পিক ব্যঞ্জনা সবার সামনে তুলে ধরা সম্ভব হবে।
এই প্রদর্শনী আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে কামরুল হাসান প্রদর্শনশালায় (লেভেল ১, বেঙ্গল শিল্পালয়)। রোববার ছাড়া প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
এই প্রদর্শনীর সার্বিক গবেষণা ও নির্দেশনায় ছিলেন শিল্পী ও অধ্যাপক নিসার হোসেন। এখানকার মৃৎশিল্পের সামগ্রীগুলো নেওয়া হয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, ময়নুল আবেদিন, তরুণ ঘোষ, শিশির ভট্টাচার্য্য, সাইদুল হক, নিসার হোসেন, ইমরান উজ-জামান, নবরাজ রায়, টিটু সাহা, সুশান্ত ঘোষের ব্যক্তিগত সংগ্রহ আর সেই সঙ্গে কারুশিল্প বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রদর্শনীর জন্য মাঠপর্যায়ে উপাদান ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন ইমরান উজ-জামান, নবরাজ রায় ও টিটু সাহা।
ছবি: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও আরিফা খাতুন