দেশের অনেক তরুণের মতোই উচ্চমাধ্যমিকের ধাপ পেরিয়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিলেন আরিফুল ইসলাম রাসেল। লক্ষ্য ছিল ফাউন্ডেশন টেকনোলজিস অ্যান্ড ডিজাইনিং বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন। মালয়েশিয়ায় গিয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে শুরু করেন খণ্ডকালীন চাকরি। শুরু করেছিলেন রেস্তোরাঁর কিচেন থেকে। সেখান থেকেই আগ্রহ জন্মাল কফির বিষয়ে। তারপর আস্তে আস্তে কফিই নেশা, কফিই পেশা হয়ে গেল তাঁর।
আরিফুল ইসলাম রাসেল আট বছর যাবৎ কাজ করছেন কফি নিয়ে। বর্তমানে সিনিয়র বারিস্তা ও ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন একটি ক্যাফেতে। ছাত্রাবস্থায় কিচেনে যখন কাজ শুরু করেছিলেন,পাশেই ছিল ক্যাফে। কফিবিনের সতেজ করা ঘ্রাণ তাঁকে আকর্ষণ করত চুম্বকের মতো। কিন্তু শুধু কফি বানানো নয়, করতে চেয়েছিলেন অন্য রকম কিছু। তখন ছুটির দিনে ছুটি না কাটিয়ে তাই শুরু করেন কফি আর্ট শেখা।
চিরপরিচিত টিউলিপ, হার্ট ও রাজহাঁসের বাইরে গিয়ে কফির ওপর অপূর্ব সব চিত্রকর্ম দিয়ে আরিফ মুগ্ধ করছেন বিভিন্ন দেশের কফিপ্রেমীদের। ছয় বছর প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফিরেও একইভাবে চমক দিচ্ছেন দেশের কফিপ্রেমীদের।
‘দুখ দুগুণে পাঁচ’ এমন দুঃখবিলাসী লেখা থেকে শুরু করে কফি আর্টেই ফুটিয়ে তুলছেন তামিম ইকবালের এক হাতে ব্যাটিং করার সেই স্মরণীয় দৃশ্য। পাশাপাশি গ্যালাক্সি, স্বাধীনতার ৫০ বছর, বঙ্গবন্ধু, শহীদ মিনার, মা ও বাবা দিবস, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা আর বিশেষ দিনগুলোর আর্ট তো আছেই।
ধরুন, বই হাতে আনমনে বসে আছেন কফি শপে, কিছুক্ষণ পর আপনার সামনে যে কফিটি পরিবেশিত হবে, তাতে যদি দেখেন আপনার এই আনমনে বসে থাকার ছবি, তাহলে মুগ্ধ হবেন না? ঠিক এভাবেই ক্যাফেতে আসা যুগল ও আড্ডারত বন্ধুদের চমকে দেন এই কফি আর্টিস্ট। আর এমন মনোমুগ্ধকর চিত্র দেখে গ্রাহকের মুখে যে হাসি ফুটে, সেটি আরিফকে প্রেরণা দেয় নতুন কিছু আঁকার। জীবিকার জন্য এই কাজ শুরু করলেও তিনি কফিকে ভালোবেসে প্রতিনিয়ত দিয়ে চলেছেন এতে শিল্পের ছোঁয়া।
একবার শহীদ দিবসে কফিতে শহীদ মিনার এঁকে সেই ভিডিও শেয়ার করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। সেই ভিডিও থেকেই পেয়েছেন অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। তার পর থেকে সময় পেলেই সুনিপুণ হাতে আঁকা কফিচিত্র শেয়ার করেন তিনি ফেসবুকে। তাঁর অভিনব এসব কফিচিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে অন্য বারিস্তারাও প্রেরণা পান। আর কেউ নতুন কোনো আর্ট করলে রাসেলকে সেটি শেয়ার করেন, কেমন হয়েছে জানতে চান। এসব কিছু থেকেই নিত্যনতুন কাজের শক্তি পান এই গুণী কফিশিল্পী।
প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই বেশির ভাগ চিত্রকর্ম করে থাকেন আরিফুল ইসলাম। যেমন গাছ, পাখি, ফুল প্রভৃতি। চকলেট সিরাপ আর চকলেট পাউডার দিয়ে কফির ফোমের ওপর এই ডিজাইনগুলো করতে প্রয়োজন অনেক যত্ন ও ধৈর্য। তাঁর মতে, কফির প্রতি সেই ভালোবাসা আর ধৈর্য থাকলে যে কেউ রপ্ত করতে পারেন এ শিল্প। আর গ্রাহকদের চমকে দিতেই নিত্যনতুন ও ভিন্ন কিছু করার তাগিদ পান এই কফিশিল্পী।
এত কিছু থাকতে বারিস্তা কেন, প্রশ্নের জবাবে বেশ আশাজাগানিয়া উত্তর দিয়েছেন রাসেল। একই কুইজিন কিন্তু ভিন্ন রেস্তোরাঁয় ভিন্ন স্বাদের হয়। পদ এক হলেও স্বাদ বদলে যায় দেশ ভেদে, রাঁধুনি ভেদে। কিন্তু কফিবিন মানসম্পন্ন হলে কফির স্বাদ সারা বিশ্বে একই। অর্থাৎ ক্যাপুচিনো এখানে যেমন বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই অনুপাতে কফি ও দুধ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। লাতে বা অন্যান্য কফির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাই কফি বানানোর এই দক্ষতা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় গিয়ে কাজে লাগানো যায়।
তবে বাংলাদেশে বারিস্তা হিসেবে বেশ কিছু অভিযোগ শুনতে হয়েছে রাসেলকে। আর যেগুলো এসেছে গ্রাহকদের অজ্ঞতা থেকেই। যেমন মেনু কার্ড দেখে ফরমায়েশ করেন এসপ্রেসোর। কিন্তু পরে তুলনামূলক তেতো স্বাদ আর কাপের আকার দেখে পরিবেশনকারীর সঙ্গে ঝামেলা করে বসেন অনেকে। কফি সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় এমন সমস্যা হয় অনেক ক্ষেত্রে। তাই রাসেলের মতে গ্রাহকেরা যখন ঠিকমতো জানবেন কোনটা কোন ধরনের কফি, স্বাদ কেমন, কোনটা কীভাবে প্রস্তুত করা হয়, তখন এ ব্যাপারগুলো ঘটবে না।
বাংলাদেশে যে হারে কফি কালচার বাড়ছে, তাতে আশা করা যায় দ্রুতই মানুষ শিখে নেবেন কফির ধরন। আর শুধু কফি পান করা নয়, কফি আর্টের প্রতিও মানুষের আগ্রহ বাড়বে বলে আরিফুল ইসলাম বিশ্বাস করেন। প্রিয় মানুষকে বিশেষ দিনের শুভেচ্ছা জানানো বা পাণিপ্রার্থনা অর্থাৎ প্রপোজ করার অনন্যসাধারণ মাধ্যম হতে পারে কফি আর্ট। আরিফের স্বপ্ন কফিচিত্রকে সবার কাছে সে রকম একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া।
ছবিঃ আরিফুল ইসলাম ও আশিকুর রহমান