ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতবর্ষে আজকের জনপ্রিয় খাবার হালিমের আগমন আরবদের হাত ধরেই। আমরা যেমন পবিত্র শবে বরাতে হালুয়া-রুটি খাই, মধ্যপ্রাচ্যে তেমন বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে খাওয়া হতো হারিশা। একধরনের ডাল আর মাংসের সমন্বয়ে তৈরি হতো এই হারিশা। ইতিহাসবিদদের মতে, সম্রাটের হুমায়ুনের আমলে ভারতে হারিশার আগমন শুরু হলেও জনপ্রিয়তা লাভ করে হুমায়ুনপুত্র সম্রাট আকবরের আমলে। সম্রাট হুমায়ুনের সঙ্গে পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্যের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ইবন বতুতার ভ্রমণকাহিনিতে পাওয়া যায় পারস্যে ডাল, ঘি ও মাংস দিয়ে রান্না করা হারিশার কথা। তাই বলা যায়, পারস্য হয়ে হারিশা ভারতে এসেছিল। স্পেনের ইহুদিদের মধ্যেও পবিত্র দিনে হারিশা রান্না করার চল ছিল।
ইতিহাসবিদদের মতে, হায়দরাবাদের নিজামদের আরব সৈন্যরাই হারিশা এনেছিলেন হায়দরাবাদে। ধারণা করা হয়, ভারতীয় মসলার ছোঁয়া পেয়ে এই হারিশাই পরিণত হয়ে গেছে আজকের হালিমে। কিন্তু হারিশা কীভাবে হালিম হলো? এটি রান্না করতে দরকার হয় প্রচুর সময় ও ধৈর্যের। আরবিতে হালিম শব্দের অর্থ হলো ‘ধৈর্যশীল’। হয়তো সেখান থেকেই এই নামকরণ। তবে হারিশার সঙ্গে হালিমের মূল পার্থক্যটাই হলো মসলার ব্যবহারে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য খাবারগুলোর মতোই হারিশাতে কম মসলা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ভারতবর্ষে মসলার সমারোহ এবং জনপ্রিয়তার কারণে হালিমও হয় বেশ মসলাদার।
বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হালিম খুব জনপ্রিয় এক খাবারের নাম। হাল ফ্যাশনের পাঠকদের জন্য রইল পাঁচটি জম্পেশ হালিমের দোকানের খবর।
১. খাজা হালিম
মতিঝিল নটর ডেম কলেজের সঙ্গেই বিখ্যাত খাজা হালিম। এখানে মূলত নিহারির হালিম পাওয়া যায়। এই বিশেষ ধরনের হালিমের জন্যই খাজা হালিম বিখ্যাত। যাঁদের নলি ও পায়া পছন্দ, তাঁরা অবশ্যই খাজা হালিম খেয়ে দেখবেন। ৩০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিভিন্ন সাইজের বাটিতে হালিম পাওয়া যায় এখানে।
২.হোটেল আল-রাজ্জাকস
পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁটির হালিম অনেক বিখ্যাত। এখানে গরুর হালিম পাওয়া যায় না। মুরগি আর খাসির হালিম পাবেন। আকারভেদে মাটির পাত্রে ২০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় পাওয়া যায় হালিম। ১০০ বছরের পুরোনো হোটেল আল-রাজ্জাকসের এই হালিম ইফতারে অনন্য।
৩. ডিসেন্টের হালিম
রাজধানীর অন্যতম সেরা স্বাদের হালিম পাওয়া যায় ডিসেন্টে। চকবাজার, মতিঝিলসহ পুরো ঢাকায় তাদের ১৪টি আউটলেটে পাওয়া যায় এই হালিম। ডিসেন্টের হালিমের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অন্য সব বাবুর্চি আস্ত মাংস বা টুকরা মাংস দেন, কিন্তু ডিসেন্টের হালিমে দেওয়া হয় ঝুরা মাংস, যার ফলে স্বাদ হয় দারুণ। অথেনটিক লাহোরি হালিমে এভাবেই মাংস দেওয়ার নিয়ম। ১৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিভিন্ন মাপের পাত্রে এই হালিম পাওয়া যায়।
৪. মনির ভাইয়ের শাহী হালিম
মিরপুরের বিখ্যাত মনির ভাইয়ের শাহী হালিম চলছে গত ১৫ বছর। দারুস সালাম রোডের ক্যাপিটাল টাওয়ারের পেছনে এই দোকান। ৩০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিভিন্ন পরিমাণের হালিম পাওয়া যায় এখানে। পর্যাপ্ত মাংস আর সেই সঙ্গে টকপানি এর স্বাদে আনে ভিন্নতা।
৫. মোহাম্মদপুরের মনা মামার হালিম
মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে অবস্থিত ছোট্ট দোকান মনা মামার হালিম অ্যান্ড স্যুপ। প্রায় ৩০ বছর আগে এই দোকানের শুরু করেছিলেন মনা মামা। ঢাকার হালিমপ্রেমীদের আরেক প্রিয় নাম এটি। বছরজুড়ে দোকানে হালিম বিক্রি হয়।
গরু আর মুরগির মাংস ছাড়াও এই হালিমে দেওয়া হয় কোয়েল পাখির ডিম আর জলপাইয়ের আচার, যে কারণে পাওয়া যায় মুখরোচক স্বাদ। সিক্রেট রেসিপিতে মনা মামা নিজেই এই হালিম বানান বলে জানান দোকানের ম্যানেজার সোহেল। প্রতি কেজি মুরগির হালিমের দাম এখানে ২৫০ টাকা আর গরুর হালিম ৩০০ টাকা। সর্বনিম্ন ৫০০ গ্রাম করে পার্সেল কিনে নেওয়া যায়।
ছবি: লেখক