পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে বেশ কুখ্যাত এক পোশাক হিসেবে পরিচিত ছিল পাতলা সুতি কাপড়ের হাতি প্রিন্টের ব্যাগি প্যান্টগুলো। এই পোশাকে সেসব পর্যটকের সিগনেচার আউটফিট ছিল, যাঁরা নিজেদের আপন সত্তা ও চ্যাং বিয়ার নামের থাইল্যান্ডের স্থানীয় এক পানীয়র সন্ধানে কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে থাইল্যান্ডে ঘুরে বেড়ান।
ফ্যাশনে এই হাতি প্রিন্টের একটা পোশাকি নাম আছে, পাকিডার্ম। গত দুই দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ যেমন থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান বাজেট ট্যুরিস্টদের ঢেউ বয়ে গেছে। কারণ, তাঁরা খুব কম বাজেটের মধ্যে এসব দেশ ভ্রমণ করতে পারেন। এ বাজেটে তাঁদের মধ্যে এই পাকিডার্ম প্যান্ট পরার প্রবণতা বেশি ছিল। এর পেছনে ছিল দুটি কারণ। প্রথম, প্যান্টগুলো বানাতে ব্যবহার করা হয় খুব পাতলা সুতি কাপড়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে থাইল্যান্ডের গরম আবহাওয়ার জন্য বেশ উপযোগী এই প্যান্ট এবং এগুলো পরে খুব আরামে ঘুরে বেড়ানো যায়। দ্বিতীয় কারণ হলো পাকিডার্ম বা হাতির প্রিন্ট। ট্যুরিস্টরা মনে করতেন এই হাতির প্রিন্টের প্যান্ট থাইল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
অবশ্য এ ধরনের বিভ্রান্তি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। হাতি থাইল্যান্ডের জাতীয় প্রাণী। দেশটিতে ঐতিহাসিকভাবে হাতিকে গৌরবের প্রতীক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে পর্যটকদের কাছে এই প্রিন্টের প্যান্টের চাহিদা ছিল অনেক এবং এখনো সেটা আছে। ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর দোকানে এগুলো কেনার জন্য বিদেশিদের ভিড় লেগে থাকে।
এত দিন স্থানীয় জনগণের কাছে এই প্যান্টগুলোর খুব একটা কদর ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে সেই দৃশ্যকল্পে পরিবর্তন এসেছে। এ বছর থাইল্যান্ডের ফ্যাশন মহলে সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে পাকিডার্ম প্যান্ট। এর পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকের ভূমিকা অনেক বেশি। কোভিডের সময় থেকে ফ্যাশন বিশ্বে টিকটকের দাপট শুরু হয়। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সমগ্র ফ্যাশন দুনিয়ায় এনেছে নাটকীয় পরিবর্তন। টিকটকের মাধ্যমে ট্রেন্ডে পরিবর্তন আসছে।
আগে ফ্যাশনপ্রেমীরা অপেক্ষা করত ফ্যাশন উইকগুলোর জন্য। কারণ, সেখান থেকে ট্রেন্ড আসত। এখন হয়েছে এর উল্টো। বেশির ভাগ ফ্যাশন ডিজাইনার টিকটকে ফ্যাশনপ্রেমী বা ইনফ্লুয়েন্সারদের কনটেন্ট দেখে তাঁদের চাহিদা ও রুচি বুঝে নিজেদের কালেকশন সাজাচ্ছে। ফ্যাশন ট্রেন্ড যা আসছে তার অন্তত ৯০ শতাংশ টিকটকের। থাইল্যান্ডের পাকিডার্ম প্যান্টের হঠাৎ করে আকর্ষণের বস্তুতে পরিণত হওয়ার কারণ এটাই।
গত এপ্রিলে থাইল্যান্ডের ১৯ বছর বয়সী থাই টিকটক ইনফ্লুয়েন্সার দালিন্তান ‘মরিচ’ প্রমফিনিত চলতি বছরের এপ্রিলে একটি উজ্জ্বল হলুদ প্যাকিডার্ম প্যান্ট পরে নাচের ভিডিও টিকটকে পোস্ট করেন। ভিডিওটির ভিউ সংখ্যা দুই মিলিয়নে পৌঁছে যায়। ওখানে সবাই কমেন্ট করে জানতে চায় যে প্যান্টটি কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। দালিন্তান এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘প্যান্টটি আসলেই অসাধারণ। এগুলো এখন কেবল বিদেশি ট্যুরিস্টদের কেনা স্যুভেনির নয়। এটি আমাদের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। বিশেষ করে টিনএজারদের স্ট্রিট স্টাইলের অংশ হয়েছে।’
কিংকার্ন ‘জ্যাক’ স্যামন একটি কারখানার মালিক, যেখানে প্রতিদিন ১০০ কারিগর হাজার হাজার পাকিডার্ম-অনুপ্রাণিত পোশাক তৈরি করেন। এর মধ্যে প্যান্ট ছাড়াও আছে শার্ট, ড্রেস, কো-অর্ড ও হ্যান্ডব্যাগ। কোভিড–পরবর্তী সময়ে পাকিডার্ম প্রিন্টের পোশাকের ৩০ শতাংশ বিক্রি বেড়েছে। এর ৮৫ শতাংশ এসেছে প্যান্ট থেকে। পাকিডার্ম প্রিন্টের জনপ্রিয়তা প্রভাব ফেলেছে দেশটির পোশাকশিল্পে। থাইল্যান্ডে ৩ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে এর জন্য।
কিংকার্নের থেকে আরও একটি কথা জানা যায়। এই প্রিন্টের জনপ্রিয়তা কোনো বিতর্ক ছাড়া আসেনি। বিতর্কের সূত্রপাতও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু কম্বোডিয়ান পাকিডার্ম প্রিন্ট নিজেদের দাবি করার পর থেকে। অবশ্য এতে সবার লাভ হয়েছে। বিতর্কের পর নাকি পাকিডার্ম প্রিন্টের পোশাকের বিক্রি আরও বেড়েছে।
শুধু নিম্ন ও মধ্যবিত্ত থাই নাগরিকদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা সীমাবদ্ধ নেই। এখন উচ্চবিত্তদের কাছেও এর রয়েছে আলাদা কদর। তাঁদের কথা ভেবেই এখন থাইল্যান্ডের বিলাসবহুল ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের দোকানের বেশ চড়া মূল্যে নানা প্যাটার্নের পাকিডার্ম প্যান্ট ও ড্রেস বিক্রি করছে।
থাই ফ্যাশন ডিজাইনার রাভিয়ান ‘জিজি’ ওয়াসিনসিরি এ নিয়ে বলেছেন, ‘আগে মানুষ যখনই হাতি প্রিন্টের কথা চিন্তা করত তখন একটা শব্দই তাদের মাথায় উদয় হতো। আর সেটা হলো সস্তা। আমি এই কনসেপ্ট থেকে বেরোতে চেয়েছি। পাকিডার্ম প্রিন্ট ট্রেন্ডে আসার আগে থেকে আমি কেবল ট্যুরিস্টদের জন্য এই প্রিন্টের দামি পোশাক নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু টিকটকের কল্যাণে এখন অনেক উচ্চবিত্ত থাই ফ্যাশনিস্তারা আমার পোশাক কিনছে। আশা করি, ভবিষ্যতে এর বিক্রি আরও বাড়বে।’
ছবি ও তথ্য: এএফপি