মুনমুন শারমিন শামস্। নামটি যেন নারীর ভাবনা ও কথার মুক্ত প্রকাশের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সুপরিচিত অনলাইন নারীবাদী পত্রিকা ‘ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর’-এর প্রকাশক ও সম্পাদক তিনি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, লোকপ্রশাসনে। বিবাহিত জীবনে এক কন্যা সন্তানের মা তিনি। বাস করছেন ঢাকায়। দীর্ঘদিন ধরে লেখক ও সংবাদকর্মীর ভূমিকা্য কাজ করে চলেছেন তিনি। মুনমুন শামস্ নারীদের জন্য প্রতিষ্ঠান শান্তিবাড়ির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। নারীর মানসিক স্বাস্থ্য এবং আইনি অধিকার সুরক্ষার কাজ করে শান্তিবাড়ি। দেশের নারীদের আর্থ-সামাজিক, পেশাগত ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সহযোগিতা, পৃষ্ঠপোষকতা ও পরামর্শকেরও কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, নারীকে একটি ননজাজমেন্টাল ও সহমর্মিতাপূর্ণ পরিবেশ দেয় শান্তিবাড়ি, যেখানে এসে তিনি ইচ্ছামতো সময় কাটাতে পারেন, নিজের যেকোনো সমস্যা শেয়ার করতে পারে্ন এবং সমাধানের জন্য পরামর্শ ও সহযোগিতা নিতে পারেন। নারীর জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এটাই প্রথম। আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে তাই শান্তিবাড়ি নিয়ে কথা না বললেই নয়। এ প্রসঙ্গে নানা প্রশ্নের উত্তরে অনেক কিছু জানা গেল মুনমুনের বয়ানে।
আপনার কাছে নারী হিসেবে নিজের পরিচয় আসলে কী?
একজন নারীর পরিচয় একটাই। তিনি মানুষ। একজন নারীর পরিচয় যা, একজন পুরুষের পরিচয়ও তাই। অন্য যেকোনো লিঙ্গ- তাঁদেরও প্রথম পরিচয় তাঁরা মানুষ। এবং আস্তে আস্তে এই যে নারী, পুরুষ বিভাজন আমরা করি লিঙ্গভেদে- এই বিভাজনের বিষয়গুলো কেটে যাচ্ছে। পৃথিবী যত আধুনিক হচ্ছে, তত এগুলো থেকে বেরিয়ে আসছে সকলে। একটা সময় নারী নাকি পুরুষ, যেকোনো প্রাতিষ্ঠানিক ফর্ম পূরণের সময় তা জানান দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু এখন ঐ জায়গায় এমন অপশন থাকে না। আবার এমনও হতে পারে, কেউ বলতে চান না তিনি কোন জেন্ডারের। এই স্বাধীনতাটাও আছে। শারীরিক লিঙ্গ দিয়ে কারো পরিচয় নির্ধারণ করাটা এখন খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয়।
নারী দিবসে নারীদেরকে কেন্দ্র করে অনেক উদযাপন করা হয়, নারীদের অধিকার নিয়ে আলোচনা হতে দেখা যায়। এই বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন?
নারী দিবসের একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এটি সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। একজন শ্রমজীবি নারীর আন্দোলন, তাঁর সংগ্রাম, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, তাঁর মৃত্যু- অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে আমরা নারী দিবস পেয়েছি, যার মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী নারী তাঁর সম্মান, মর্যাদা, শ্রমিক হিসেবে পুরুষের সমান মর্যাদা অর্জন করেছেন। তাই নারী দিবস খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটা দিন।
বছরের পর বছর আমরা দিনটাকে উদযাপন করছি। এই সময়টাতে অনেক বেশি কথা বলছি নারী অধিকার নিয়ে, স্বাধীনতা নিয়ে। আমি মনে করি, এটাকে ছোট করে দেখার কোন কারণই নেই। এটা অনেকে বলতে পারে, 'সারা বছর আমরা নারীকে অত্যাচার করছি, কিন্তু নারী দিবসে এসে বড় বড় কথা বলছি'। তাহলে ৮ মার্চ কি কোন নারী নির্যাতন হয় না? এই দিনও ধর্ষণ হচ্ছে, খুন হচ্ছে, স্বামীর হাতে স্ত্রী মার খাচ্ছেন। তার মানে এই নয় যে আমরা কথা বলা বন্ধ করে দেব। আমরা নারী দিবস উদযাপন করব। দুটো কথা হবে, সচেতনতা তৈরি হবে- এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই যে ইন্টারভিউটা একজন নারী পড়বেন বা নারী দিবসে অন্যান্য খবর দেখবে্ন- এর মধ্য দিয়ে নারীর মনে তোলপাড় হওয়া, পুরুষের মনে একটা চিন্তার জায়গা তৈরি হবে। সামগ্রিকভাবে নতুন করে কথাগুলো সবার মাঝে ছড়ানোরও একটা বড় প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি।
'শান্তিবাড়ি' প্রতিষ্ঠা করার ভাবনাটা কিভাবে এলো?
শান্তিবাড়ির বয়স বেশি না। ২০২২ সালের জুলাই থেকে এর যাত্রা শুরু। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করেছি। এরপর নারীবাদ নিয়ে কাজ শুরু করলাম। আমি একজন অ্যাক্টিভিস্ট, লেখালেখি করি। নারীবাদ ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে যখন লেখালেখি শুরু করলাম, তখন দেখলাম আমি অনেক মেয়েদের একদম হৃদয়ের কাছাকাছি হয়ে গেলাম। আমার অনেক লেখা পড়ে অনেকের ভালো লাগছে বা তাঁদের মনে হচ্ছে যে কথাগুলো কেউ বলতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি, সেটা আমি বলে দিয়েছি। এ রকম অনেক প্রতিক্রিয়া আমি বছরের পর বছর পেয়েছি।
এসবের পাশাপাশি দেখতাম, অনেক মেয়ের নানা রকম সমস্যা আছে। যেমন, কেউ হতাশা, উদ্বেগে ভুগছে, টক্সিক রিলেশনশিপজনিত সমস্যা, ওসিডিতে ভুগছে। এই পাশাপাশি দেখা যায়, অনেকের আইনগত সমস্যা আছে। যেমন, ঘরে স্বামী শারীরিকভাবে নির্যাতন করছে, আবার কারো স্বামী বাচ্চার ভরণপোষণ দিচ্ছে না, তালাকের পর কেউ বাচ্চার কাস্টডি পান না, দেনমোহর পান না। তখন দেখলাম আমাদের দেশের বেশিরভাগ মেয়েই জানে না এমন সমস্যার মুখোমুখি হলে কোথায় যেতে হবে, কোথায় গেলে সঠিক তথ্য ও সেবা পাবে। তো আমার কাছে এসে অনেক মেয়েই বলতো 'আপু আমাকে একজন আইনজীবী বা একজন মনোবিদের খোঁজ দেন’। তখন আমি তাঁদের আমার পরিচিত মনোবিদ ও আইনজীবীদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিতাম। এ রকম করতে করতে একটা সময় আমার মনে হলো, আমি এই কাজটা একা করতে পারছি না। তখন মনে হলো এই কাজের জন্য একটা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, যা এ ধরণের কাজ্গুলোকে বেশ ভালোভাবে গুছিয়ে করবে। তখন আমি এ নিয়ে ভাবতে শুরু করি। আমার পার্টনার, যারা সবাই আমার বন্ধু ও বোন- তাঁদের সঙ্গে আমার ভাবনাটা শেয়ার করি। তাঁরা সবাই এই আইডিয়াটার বেশ প্রশংসা করল এবং ওরা ভাবতে শুরু করলো এই প্ল্যানটাকে কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। এভাবে আমরা ধীরে ধীরে শান্তিবাড়ি প্রতিষ্ঠা করি। শান্তিবাড়ির সহ-প্রতিষ্ঠাতারা হলেন, সুমী শাহাবুদ্দিন, কিশোয়ার জাবীন, নাহিদ শামস্, অপরাজিতা গোস্বামী ও অনির্বাণ ভৌমিক।
শান্তিবাড়িতে একজন নারী কী কী সুবিধা পেতে পারেন?
এখানে সব সেবা শুধুমাত্র নারীদের জন্য। আমরা প্রথমত মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সেবা দিই। এখানে সবধরণের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা আছে। আমাদের এখানে সাইকোলজিস্ট ও সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। এছাড়া আইনি পরামর্শের ব্যবস্থা আছে। শান্তিবাড়িতে যেকোনো আইনি পরামর্শ আর আইনি সেবা দেওয়া হয়। আইনি পরামর্শের পর কারো যদি লিগ্যাল মিডিয়েশন দরকার হয় সেটাও করি আমরা। কারো যদি কোর্টে কেস করার দরকার হয় তার ব্যবস্থা করি। এছাড়া আমরা প্যারেন্টিং সার্ভিস দেই। প্যারেন্টিং বিষয়ক যেকোনো ওয়ান-টু-ওয়ান কনসালটেন্সি দেওয়া হয় এখানে। এছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে আমরা কাজ করি। আমাদের এখানে ছোট ছোট কর্ণার আছে, যেখানে নারী উদ্যোক্তারা তাঁদের প্রোডাক্ট রাখতে পারেন প্রদর্শন করার জন্য। আমরা প্রায়ই বিভিন্ন মেলার আয়োজন করি।
শান্তিবাড়িতে নারীর সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল দিক নিয়ে কাজ করা হয়। যাঁরা চিত্রশিল্পী, ফটোগ্রাফার ও লেখক, তাঁদের জন্য এটা খুব দারুণ একটা স্পেস। এখানে আমাদের একটা গ্যালারি আছে। সেখানে চিত্রকর্ম ও ফটোগ্রাফির প্রদর্শনী করা হয়। কোন নারী লেখক তাঁর বই নিয়ে কোন অনুষ্ঠান করতে চাইলে এখানে সেটা আয়োজন করা হয়। নিয়মিত সাংস্কৃতিক উৎসবও করা হয়। কোনো নারী যদি এসে বলেন, ‘আমি গান গাই। এখানে আমি গানের অনুষ্ঠান করবো’- তাহলে শান্তিবাড়িতে সেই অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। আমরা মনে করি, মেয়েদের আসলে যাওয়ার জায়গা খুব কম। কিন্তু এখানে যেকোনো নারী এসে ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের মত সময় কাটাতে পারবেন। কেউ তাঁকে কিছুই বলবে না।
সাফল্য বা মুক্তির চেয়ে আপনার কাছে নারীর শান্তিটাই কেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
আমি মনে করি শান্তিই সবকিছু। এবং শান্তিটা নিজেই নিজের ভেতরে আনতে হয়। অনেকেই আছেন যারা জীবনে অনেক সফল, অনেক প্রতিভাবান, পরিশ্রমী, অনেক টাকা আয় করছেন কিন্তু মনে ভেতরে অনেক অশান্তি। যেমন ধরুন, কোনো নারী অফিসে প্রমোশন পেয়েছে কিন্তু সবাই তাঁকে বলছে ‘তোমার তো প্রমোশন হয়েছে বসের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা পেয়ে।’ তখন তো তিনি এই পদোন্নতি পেয়ে পুরোপুরি ভালো থাকতে পারছেন না। মনে অশান্তি দানা বাঁধছে। একজন নারীকে অশান্তি দিতে সমাজ খুবই পটু। কোন মেয়ে ভালো থাকলেও অশান্তি দেয়, খারাপ থাকলেও অশান্তি দেয়। তো শান্তি জিনিসটা মেয়েদের জন্য খুব আরাধ্য জিনিস। আমি মনে করি, একটা শান্তিপূর্ণ মন সবকিছুই করতে পারে। শান্তিপূর্ণ মন মানে এটা নয় যে তোমার অনেক টাকা আছে, তুমি সাফল্যের চূড়ায় রয়েছ।
আমাদের শান্তিবাড়িতে কোন চকচকে ব্যাপার নেই। পুরনো শাড়ি কেটে পর্দা বানানো হয়েছে, রিসাইকল করা ফার্নিচার ব্যবহার করা হয় এখানে। আমি মনে করি সাফল্য বা অর্থ দিয়ে শান্তিকে মূল্যায়ন করা যায় না। শান্তি হচ্ছে, আমি যেমন আছি তাতে আমার অধিকার খর্ব হচ্ছে না, আমার যা আছে তা নিয়ে আমি খুব সুখী এবং অন্যদেরকে আমি ভালো রাখতে পারছি- এই বোধটা উপলব্ধি করা। শুধু নিজে ভালো থেকে নয়, অন্য আরও দুটো মানুষকে নিয়ে ভালো থাকার মধ্যে আসল শান্তি। এটা থেকে যে শান্তিটা পাওয়া যায় তা আসলে অমূল্য।
আগামীতে শান্তিবাড়ি নিয়ে আপনার কী কী পরিকল্পনা আছে?
শান্তিবাড়ি নিয়ে আমাদের অনেক পরিকল্পনা আছে। অনেক কিছুই ভাবছি। আমরা আপাতত আমাদের যে কাজগুলো আরও বড় আকারে করতে চাই। আমরা প্রতিবছর একটা ‘ভালো থাকার উৎসব’ করি। গত বছরও হয়েছে। সামনে আবার হবে। আশা করি এবারের ‘ভালো থাকার উৎসব’ অনেক বড় করে হবে। আরও অনেক নারী এখানে অংশগ্রহণ করবেন। আমাদের আরেকটা ইচ্ছা হলো, আমাদের শান্তিবাড়ির সব কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া।
নারী দিবস উপলক্ষে নারীদের জন্য আপনার যদি কোন বিশেষ বার্তা থাকে…
একটা কথা আমি সবসময় বলি, আমাদের অনেক সাহসী হতে হবে। আমরা অনেক ভীতু। আমাদেরকে জন্মের পর থেকে অনেক ভীতু বানানো হয়। আমরা কুঁজো হয়ে যাই। কোথাও যেয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারি না, আমার প্রাপ্যটা চাইতে পারি না। এই জায়গা থেকে বের হতে চাইলে আমাদের সাহস থাকতে হবে। সাহসটা তখনই হবে যখন আমরা নিজের অধিকার সম্পর্কে জানবো, সচেতন হবো এবং নিজেকে ভবিষ্যত পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য তৈরি করবো। মেয়ে, ছেলে, ট্রান্সজেন্ডার এই লিঙ্গের চিন্তাটা বাদ দিয়ে ‘আমি একটা মানুষ’-এই বোধ নিয়ে কাজ করতে হবে।
ছবি: মুনমুন শারমিন শামস্