অ্যান্টার্কটিকায় নারীর অভিযাত্রা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

অ্যান্টার্কটিকায় মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৭৭৩ সালে। তবে সেটা ছিল পুরুষের মিছিল। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণে কোনো দেশ সম্মতি দেয়নি নারীদের। ব্যাপারটি এমন নয় যে এই না যেতে দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আইন ছিল। ছিল অনাগ্রহ। অ্যান্টার্কটিকার সঙ্গে নারীদের ইতিহাস বহু সংগ্রামের। কিন্তু প্রথাবিরোধী কেউ কেউ থাকেন। তেমনি একজন লুইস সেগুইন। প্রথম ইউরোপীয় মহিলা, যিনি অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ করেন ১৭৭৩ সালে। কেউ বলে, তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে পুরুষ ছদ্মবেশে জাহাজে চড়েছিলেন। কেউ বলে, তিনি গণিকা, অর্থাৎ বেশ্যা বেশে জাহাজে চড়েছিলেন। জাহাজ থেকে দেখেছেন অ্যান্টার্কটিকা। জাহাজ থেকে নামতে পারেননি।

ইনগ্রিড ক্রিস্টেনসেন (বাঁয়ে) ১৯৩১ সালে অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে
ইনগ্রিড ক্রিস্টেনসেন (বাঁয়ে) ১৯৩১ সালে অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে
ছবি: উইকিপিডয়া

অ্যান্টার্কটিকাগামী জাহাজের নাবিকেরা স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন সে সময়।
তিমিশিকারি জাহাজের ক্যাপটেনরা স্ত্রীদের সঙ্গে নিতেন কেউ কেউ। সে রকম এক নারী— ইনগ্রিড ক্রিস্টেনসেন। ক্রিস্টেনসেন ১৯৩০-এর দশকে জাহাজে তাঁর স্বামীর সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ করেছিলেন। এক–দুবার নয়, মোট চারবার। নরওয়েজীয় পিতা ছিলেন সে সময় জাহাজের পাইকারি বিক্রেতা ও জাহাজের মালিক।

বিজ্ঞাপন

পুরুষতন্ত্রের থাবা অ্যান্টার্কটিকায় পড়েছে। অ্যান্টার্কটিকা-সম্পর্কিত নিয়মনীতিগুলো যেহেতু পুরুষের তৈরি, স্বভাবতই সেখানে পুরুষের আধিপত্য। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, নারীরা তাপমাত্রা বা অন্যান্য চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে নিজেদের সামলাতে পারবেন না।

ষাটের দশকে অ্যান্টার্কটিকা জরিপের দায়িত্ব পান ইংরেজ বিজ্ঞানী ভিভিয়ান ফুচ। বিজ্ঞানী সাহেব তো বলেই বসলেন, নারীরা অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের ভারী সরঞ্জাম বহন করতে পারবেন না। এ অভিযাত্রায় নারী অনুপযুক্ত। পুরুষেরা কেবল ভেবেছেন, তাঁরাই হবেন অ্যান্টার্কটিক বীর। পুরুষ অভিযাত্রীরা একে নারীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। একে ভেবেছেন কুমারী। তুলনা করেছেন একে বিস্ময়কর নারীদেহের সঙ্গে, যে দেহ পুরুষদের দ্বারা জয় হবে! বলা হতো ‘নারীমুক্ত মহাদেশ’। পুরুষেরা এটাই চেয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবীতে এমন একটি স্থান থাকবে, যা কেবল তাদের। পুরুষতন্ত্রের এত বড় নজির আর কোথাও দেখা যায় না। পুরুষ ভেবেছে, নারীরা অভিযাত্রী হবে না, নারী হবে পুরুষের পরিচর্যাকারী। নারী সহযোদ্ধা হবে না, নারী হবে সহযোগী। নারী অভিযাত্রী হবে না, হবে অভিযাত্রীদের আকর্ষণের বস্তু। বিশ্বনেতারা অ্যান্টার্কটিকাকে ‘পুরুষের একমাত্র ক্লাব’ বলেছেন। নারীর উপস্থিতি এখানকার বিশুদ্ধতা নষ্ট করবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। অ্যান্টার্কটিক গবেষণায়ও নারীরা অনেক অনেক পরে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে।

অ্যান্টার্কটিক গবেষণায়ও নারীরা অনেক অনেক পরে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে
অ্যান্টার্কটিক গবেষণায়ও নারীরা অনেক অনেক পরে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে
ছবি: লেখক

এরই মধ্যে কোনো কোনো দেশ অ্যান্টার্কটিকায় নারীকে ভিন্ন স্বার্থে ব্যবহার করেছে। অভিযাত্রী হিসেবে গমনে নিষেধাজ্ঞা থাকলে কী হবে, রাজনৈতিক দখলদারির প্রয়োজনে কিন্তু নারীকে ঠিকই ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যান্টার্কটিকায় প্রসূতি পাঠানো হয়েছে। নারী সেখানে সন্তান প্রসব করবেন আর ভৌগোলিক অংশের দাবিদার হবেন। এ ঘটনা ঘটিয়েছে আর্জেন্টিনা। সিলভিয়া মোরেলা দে পালমা ছিলেন প্রথম নারী, যিনি ১৯৭৭ সালে অ্যান্টার্কটিকার আর্জেন্টাইন ঘাঁটিতে সন্তান প্রসব করেন।

অ্যান্টার্কটিকায় অভিযান ও গবেষণাকাজে নৌবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে বারবার। নৌবাহিনীও কখনো তাদের জাহাজে নারীর উপস্থিতিকে উৎসাহিত করেনি। বলা যেতে পারে, এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী একটা হাস্যকর অজুহাত দাঁড় করিয়েছিল। নারীদের বাধা দেওয়ার অজুহাত হিসেবে তারা বলে, অ্যান্টার্কটিকায় স্যানিটেশন-সুবিধা খুব সেকেলে। মার্কিন নৌবাহিনী অ্যান্টার্কটিকাকে ‘শুধু পুরুষের ঘাঁটি’ বলেছে।

মার্কিন নৌ কর্মকর্তা ও মেরুবিশেষজ্ঞ অ্যাডমিরাল জর্জ ডুফেক নারীর অ্যান্টার্টিকাযাত্রার বিষয়ে এতটাই বিমুখ ছিলেন যে ১৯৫৬ সালে বলে বসেন, নারীরা অ্যান্টার্কটিকায় যেতে চাইলে তাঁর মৃতদেহ পার হয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ এতে তাঁর এতটাই আপত্তি ছিল যে প্রয়োজনে তিনি জীবন দিয়ে দেবেন, তবু নারীদের অ্যান্টার্কটিকাযাত্রায় সমর্থন দেবেন না। তিনি আরও দাবি করেছেন, অ্যান্টার্কটিকায় নারীদের উপস্থিতি পুরুষদের বীর ও সীমান্তরক্ষী হওয়ার সাধনাকে ধ্বংস করবে। সামরিক গোষ্ঠীগুলোর শঙ্কা ছিল, নারীর উপস্থিতি যৌন অসদাচরণ বা ব্যভিচারের জন্ম দেবে।

নারীদের বিষয়ে পুরুষ অভিযাত্রীদের মনোভাব বোঝার জন্য একটা ভালো উদাহরণ হতে পারেন স্যার আর্নেস্ট হেনরি শ্যাকলটন। বিংশ শতাব্দীর শুরু। মেজর স্যার আর্নেস্ট হেনরি শ্যাকলটন একজন অ্যাংলো-আইরিশ অ্যান্টার্কটিক অভিযাত্রী। তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন একটি অভিযানের। শ্যাকলটন তিনটি ব্রিটিশ অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। খ্যাতিমান অভিযাত্রী। তিনি একটি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন। ১৯১৪ সালে শ্যাকলটন অ্যান্টার্কটিক অভিযানের বিজ্ঞাপন দিলেন। নারীরা সে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। তিনজন মহিলা তাঁকে চিঠি লিখলেন। যোগদানের জন্য অনুরোধ করলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে অভিযানে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তখন কেউ জানতে পারেনি কী ঘটেছিল। আর কী ঘটেছিল, সেটি জানতে গণমাধ্যমকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯১৯ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বেশ কিছু নারী যোগদানের জন্য উদ্‌গ্রীব থাকলেও তাঁদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।

একটা সময় পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল নারীদের
একটা সময় পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল নারীদের
ছবি: লেখক

সেকালে নারীদের কতই না আরাধ্য ছিল অ্যান্টার্কটিকা! ১৯৩৭ সাল। একটি ব্রিটিশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যান্টার্কটিক অভিযানের আয়োজন করছিল। ১ হাজার ৩০০ নারী যোগদানের জন্য আবেদন করেন। ভাবা যায়! ১ হাজার ৩০০ নারী। এই ১ হাজার ৩০০ আবেদনের একটিও গৃহীত হয়নি। ১৯৭০–এর দশকের শেষের দিকে জুলিয়া উবেরুয়াগা অভিযাত্রায় নয়, অ্যান্টার্কটিকার মার্কিন ঘাঁটিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সবে ফিরেছেন। চারদিকে উৎসুক গণমাধ্যম। অ্যান্টার্কটিকায় শত শত পুরুষের মধ্যে হাতে গোনা কয়েক নারীর একজন ছিলেন তিনি। নিজের অবস্থাটা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পুরুষেরা আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল, যেন আমি কোনো অপ্রীতিকর-অসম্মানজনক চাকরি করে এসেছি।’

ধীরে ধীরে সময় পাল্টেছে। নারীরা প্রতিকূলতাকে নিজেদের অনুকূলে নিয়েছেন।
প্রথম নারী বিজ্ঞানী সোভিয়েত ইউনিয়নের মারিয়া ভি ক্লেনোভা ১৯৫৫ সালে অ্যান্টার্কটিকায় গেছেন গবেষণার কাজে। অভিযাত্রা আর বিজ্ঞান গবেষণায় নারীর আজ সক্রিয় অবস্থান অ্যান্টার্কটিকায়।

প্রথম নারী বিজ্ঞানী সোভিয়েত ইউনিয়নের মারিয়া ভি ক্লেনোভা ১৯৫৫ সালে অ্যান্টার্কটিকায় গেছেন গবেষণার কাজে
প্রথম নারী বিজ্ঞানী সোভিয়েত ইউনিয়নের মারিয়া ভি ক্লেনোভা ১৯৫৫ সালে অ্যান্টার্কটিকায় গেছেন গবেষণার কাজে
ছবি: উইকিপিডয়া

মেহের মুস হলেন প্রথম ভারতীয় নারী, যিনি অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ করেন ১৯৭৭ সালে। নারী বিজ্ঞানী হিসেবে ভূতত্ত্ববিদ সুদীপ্তা সেনগুপ্ত ও সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী অদিতি পন্থ ভারতের হয়ে প্রথম অ্যান্টার্কটিক অভিযানে অংশ নিয়েছেন ১৯৮৩ সালে।

অ্যান্টার্কটিকায় উড়েছে বাংলাদেশের পতাকাও
অ্যান্টার্কটিকায় উড়েছে বাংলাদেশের পতাকাও
ছবি: লেখক

বাংলাদেশের লাল–সবুজ পতাকাও উড়েছে অ্যান্টার্কটিকায়। বাংলাদেশের নারী অভিযাত্রী ও ভূপর্যটক হিসেবে ২০২৩ সালে আমার সৌভাগ্য হয়েছে অ্যান্টার্কটিকায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর।

লেখক: মহুয়া রউফ, গবেষক, অভিযাত্রী ও ভূপর্যটক

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৪, ০৪: ০০
বিজ্ঞাপন