গতকাল ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে ঢাকা মেকার্স ২। গুলশানের আলোকি কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত হচ্ছে চার দিনব্যাপী এই আর্ট, ক্র্যাফটস আর ফ্যাশনের বর্ণিল উৎসব। ঢাকা মেকার্স ২ উপলক্ষে আলোকি কনভেনশন সেন্টারের বিভিন্ন অংশ সেজে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন নিয়ে। কনভেনশন প্রাঙ্গণে ঢুকতেই রয়েছে একটি বিশাল স্টেজ যেখানে উৎসবের প্রতিদিন বিকেল ও সন্ধ্যায় এ সময়ের জনপ্রিয় সব শিল্পীর অংশগ্রহণে সংগীতায়োজন করা হবে।
এর সামনে রয়েছে ঢাকার বিখ্যাত সব ক্যাফে ও অনলাইন ফুড সার্ভিস নিয়ে সাজানো ফুড প্যাভিলিয়ন, যার তত্ত্বাবধানে আছেন শেফ সামিরা ওয়াদুদ। ফুড প্যাভিলিয়নের পাশে গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে তরুণ চিত্রশিল্পীদের আধুনিক চিত্রকর্ম। এ গ্যালারির নাম দেওয়া হয়েছে জাদুঘর। এ ছাড়া প্রতিদিন আর্ট ও ক্র্যাফটের নানা বৈচিত্র্যময় বিষয়ে অভিজ্ঞ ও নবীন শিল্পী আর আর্টিজানরা কর্মশালায় অংশ নেবেন, যেখানে এসব স্কিল শেখার পথ তৈরি হবে সবার জন্য। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে আগত দর্শনার্থীদের আগ্রহের শীর্ষস্থানে রয়েছে এ আয়োজনের মেকার্স মার্কেট।
কনভেনশন সেন্টারের মূল ভবনের বড় হল ও এর দোতলায় আরেকটি হলরুমে আয়োজিত মার্কেটপ্লেসে মেধাবী ও উদ্যমী উদ্যোক্তারা তাঁদের সৃজনকর্ম নিয়ে হাজির হয়েছেন। সেই সঙ্গে রয়েছেন নিজেদের শিল্পক্ষেত্রে আলাদা অবস্থান গড়ে তোলা কিছু সুপরিচিত নাম।
প্রথমেই আসে পোশাকের কথা। দেশের অন্যতম তরুণ ও গুণী ডিজাইনার তানহা শেখের নিজের ডিজাইনার লেবেল তান রয়েছে এই মার্কেটপ্লেসে। রয়েছে মনের মাধুরি মিশিয়ে চোখজুড়ানো ফুল বা আলপনার মোটিফে ফেব্রিক রাঙিয়ে তোলা পিযুষ কান্তি সরকারের রেণুবালা। রয়েছে কার্পাস, পাতা, বসফরাস ক্লদিং আর হালের আলোচিত ব্র্যান্ড ডাক্কা। তবে অনেক উদ্যোগই অন্য সবকিছুর সঙ্গে টি–শার্টে নিজের আর্টফর্মের প্রকাশ ঘটিয়েছে। এর মধ্যে অলক্ষ্মী আর্টের কাজ নজরকাড়া। অনলাইন ফ্যাশন উদ্যোগ তাসা এনেছে তাদের সিগনেচার বোহো আমেজের শাড়ি। এদিকে জানা গেল এক মজার ব্যাপার। ছোট পরিসরে কালেকশন আর কাস্টমাইজড পোশাকের উদ্যোগ শাবানার নামটি নাকি ঢাকাই সিনেমায় শাবানার সেলাই মেশিনে কাজ করা দেখেই দেওয়া। পোশাক ছিল যাত্রা আইএমডিপেও। আবার ক্যালিগ্রাফি শিল্পী নাজম আনোয়ার আর ব্লকের উদ্যোগ ছাপ শেখাচ্ছিল কীভাবে নিজেই নিজের কাপড়ে এসব অলংকরণ করা যায়।
অনুষঙ্গের বিশাল পসরা রয়েছে মার্কেটপ্লেসে। আর বৈচিত্র্য সত্যিই অবাক করার মতো। নয়ার ক্লে জুয়েলারি, উড়ন্ত আরশোলার পলিমার ক্লের সূক্ষ্ম কাজের গয়না, তাসার পমপম আর কড়ির বোহো স্টাইলের জুয়েলারি তো সুপরিচিত সবার কাছে। এদিকে বারজাখ এনেছে সত্যিকারের পোকামাকড় আর ফুল সংরক্ষণ করে বানানো পেনডেন্ট।
নাজম আনওয়ারের ক্যালিগ্রাফি প্যাটার্নের কাটাই মেটাল পেনডেন্টগুলো চোখে পড়েছে। স্নিকার্সে তুলি চালিয়ে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠা লাবেইবা–খ্যাত লাবিবাও এনেছেন নানা অনুষঙ্গ। এ ছাড়া আছে বিডেড–এর পুঁতির গয়না।
মার্কেটপ্লেসের প্রায় প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী উদ্যোগই টোট ব্যাগ এনেছেন নিজেদের আর্টফর্ম দিয়ে। যাত্রা, নুজআর্ট, পেইন্টিঙ্ক, হল্লা, বসফরাস, বয়ন বিতান, অলক্ষ্মী, স্পোরকেস, ডাক্কা আর ভাই ভাই প্রোডাকশনসের আদৃতা মাহিন খানের ব্র্যান্ড আর টোটগুলো বেশ নজরকাড়া। পেইনটিঙ্ক আর সামিন ইশনাদের ক্রস বডি ব্যাগগুলোও বেশ ট্রেন্ডি।
কিশ আর্টের প্রাধান্য দেখা গেল অনেকগুলো উদ্যোগের কাজে। রিকশা পেইন্ট ও তা থেকে অনুপ্রাণিত কালার প্যালেট ও স্টাইল ব্যবহার করেছেন অনেকেই। প্রতিভা, যাত্রা, হল্লা এর মাঝে রয়েছে। বোল্ড আর উজ্জ্বল নানা রং ব্যবহার করেছেন অনেকেই।
মজার মজার আর অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা রেবেলিয়াস বা প্রথাভাঙা, বিদ্রোহী মেসেজ ব্যবহার করার বিষয়ে মিল দেখা গেল অনেক উদ্যোগের কাজে। এমন সব স্টেশনারি, পোস্টার, কার্ড, নোটবুক আর ডেকোর পিস পাকা, নুজ আর্ট, অলক্ষ্মীর পসরায় দেখা গেল। আর ব্যাডগার্লস নেশন আলাদা করে নজর কেড়েছে এ ক্ষেত্রে।
হোম ডেকোরেশনের অনেক সামগ্রী রয়েছে এই মার্কেটপ্লেসে। বাসা, বেনী বিনুন, পাতার গল্প স্টুডিও, কংক্রিট অ্যান্ড বেয়ন্ড, প্যাস্টেল হোমস, নেচার ডিজাইন স্টুডিও এর মাঝে রয়েছে।
এ ছাড়া তাহমিদ'স লাইভ স্কেচ নিয়ে শিল্পী তাহমিদ রয়েছেন। স্টুডিও স্ব-এর কথাও বলতে হয় আলাদা করে। আছে তাদের অভিনব কালারিং বুক ও অন্যান্য জিনিস। সেভেন ডেইজের নানা জেলার নাম নোটবুকগুলোর কথাও বলতে হয়। ছিল যথাশিল্পের নোটবুক ও অন্যান্য পণ্য। এ ছাড়া বিভিন্ন উদ্যোগের ঐতিহ্যবাহী শোলা, কাঠ আর মাটির পণ্যও দেখা গেল।
সব মিলিয়ে তারুণ্যের অকুণ্ঠ প্রকাশের এক বিস্ফোরণ ঘটেছে ঢাকা মেকার্স ২-এর মার্কেটপ্লেসে। আর সেটা হয়েছে যার যার সৎ ও সৃজনশীল শিল্পীসত্তাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার মাধ্যমে। ওয়্যারেবল আর্ট আসলে খুব দারুণ একটি বিষয়। এর মাধ্যমে চারু আর কারুশিল্প, আর সেই সঙ্গে শিল্পীমন আর উপযোগিতা খোঁজা বাস্তববাদী চিন্তা এক হয়ে যায়। শিল্প শুধুই সাজানোর জিনিস নয়। একে নিজের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে ফেলা যায়। আর সেই ধারণাটি যথেষ্ট সার্থকরূপে মূর্ত হয়েছে ঢাকা মেকার্স ২-এর মার্কেটপ্লেসে। উল্লেখ্য, ঢাকা মেকার্স সিজন টু-এর আয়োজনে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে আছে হাল ফ্যাশন।
ছবি: লেখক