অল্ডগেটে ইস্ট স্টেশনের সামনে আসতে ২০ মিনিট লাগল। স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছি। কিছুক্ষণ পর দূর থেকে হাসতে হাসতে এল তানভীর।
তানভীর আর আমি লন্ডনে একসঙ্গে পড়েছি। আগে লন্ডন থাকত; কিন্তু চাকরির কারণে ম্যানচেস্টার চলে গেছে প্রায় চার বছর। আগে থেকেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল বাইকে করে লন্ডন ঘোরার। তাই সে হেলমেট সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
মোটামুটি ২০ মিনিট সময় লাগল ক্যামডেন পৌঁছাতে। বাইক রাখার জায়গা খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হলো। কিন্তু শেষমেশ পাওয়া গেল। রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিন। হালকা বাতাস আছে, রোদের তাপ এখন বেশ।তাই জ্যাকেটটি খুলে হাঁটা শুরু করলাম।
ক্যামডেন টাউন হল মার্কেট লন্ডনের একটি প্রধান পর্যটন গন্তব্য; এখানে ফ্যাশন, কারুশিল্প এবং খাবার যেন একই সুতায় গাঁথা।
আমরা একটি থাই স্ট্রিট ফুডের দোকানে গিয়ে ব্যাং ব্যাং নামের বেশ ঝাল চিকেন ফ্রাই খেলাম; তার পাশেই আরেকটি ইন্ডিয়ান ফুডের দোকান থেকে ফুচকা নিলাম। ফুচকার ভেতরে বেদানা আর পনির দেওয়া, যা আমাদের দেশে সাধারণত দেওয়া হয় না।
অনেক দিন পর টক দিয়ে ফুচকা খেতে অসম্ভব মজা লাগল। খাওয়া শেষ হতেই দেরি না করে আমরা টাওয়ার ব্রিজের দিকে রওনা দিলাম।টাওয়ার ব্রিজে যখন আমরা পৌঁছালাম, তখন প্রায় বিকেল। পুরো জায়গাটা লোকে লোকারণ্য। রোদটা ঠিক সেতুর ওপরে গায়ে পড়েছে, তাই এর রং খাঁটি সোনার মতো দেখাচ্ছিল।
অধিকাংশ মানুষ মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করছে, একটু অবাক হলাম এই দেখে। শীত এখনো আছে মোটামুটি, সবাই অন্তত একটা জ্যাকেট অথবা পুলওভার পরে বেরিয়েছে। টেমস নদীটি আগের মতোই আছে। শুধু পরিবর্তন হয়েছে নদীর চারপাশ।
বেশ কিছুক্ষণ আমরা হাঁটলাম। আগেই ভেবে রেখেছিলাম টাওয়ার ব্রিজ থেকে স্ট্রাটফোর্ড সেন্টারে যাব শপিং করতে। রাস্তায় বেশ যানজট থাকলেও ৩০ মিনিট লাগল মার্কেটে পৌঁছাতে। অফিস-আদালত থেকে সবে লোকজন বের হচ্ছেন। মার্কেটের ভেতরে বেশ ভিড়। যে যাঁর মতো হেঁটে চলেছেন। মায়েরা বাচ্চাদের স্কুল শেষে তাদের সঙ্গে নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরিয়েছেন। কেউ মাথা নিচু করে নিজের স্মার্টফোন দেখতে দেখতে হেঁটে চলেছেন। শপিং শেষে তানভিরকে তার হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরলাম।
পরদিন সকালে আমরা আবার বের হলাম কার্ল মার্ক্সের সমাধি দেখতে। সমাধিটি নর্থ লন্ডনে হাইগেট সিমেট্রিতে।
পুরো কবরস্থানটি আমার কাছে বেশ রোমান্টিক লাগল। এখানে যেন মৃত্যুকে বিভিন্ন দর্শনীয় ভাস্কর্য দিয়ে অনন্যভাবে উপস্থাপনা করতে চেয়েছে।
যাহোক, কার্ল মার্ক্সের সমাধি দেখে রওনা দেব ইস্ট লন্ডনের দিকে। এরই মধ্যে কথা হলো রাজা ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘদিন লন্ডনে থাকেন। গানপাগল একজন মানুষ। তিনি কাজে থাকায় আমরা ঠিক করলাম, পরের দিন সন্ধ্যায় আড্ডা দেব। এরপর ফোন দিলাম রোমেল ভাইকে। তিনি বললেন যে আমাকে সময় দিতে পারবেন। তানভীকের চলে যেতে হবে ম্যানচেস্টার। তাঁকে নিয়ে ইস্ট লন্ডনে এসে তানভীরকে বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরলাম। পরের দিন রোমেল ভাইয়ের সঙ্গে পুরো বিকেল সেন্ট্রাল লন্ডনের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরলাম। আসলে রোমেল ভাই থাকলে গুগল ম্যাপ আর লাগে না। লন্ডনের অলিগলি তাঁর নখদর্পণে। আমার বেশ সুবিধা হলো বাইক চালাতে। রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমরা এলাম আপটন পার্কের বাংলা রেস্টুরেন্ট মুন কফি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে।
কাজ শেষে রাজা ভাই, আমি, রোমেল ভাই আর একজন তানজিল ভাই চা খেতে খেতে বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা হলো।
পরের দিন সকালে তানজিল ভাই আমাকে বক্সহিল নামের এক জায়গায় নিয়ে গেলেন। সেখানে যেতে ঘণ্টা দেড়েক লাগল। ওপরে নীল আকাশ, আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছালাম। সেখানে উজ্জ্বল রোদ যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষায় ছিল। অসাধারণ দৃশ্য। নির্বাক হয়ে দিগন্তে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। তানজিল ভাই দীর্ঘদিন বিদেশে থাকলেও অনলাইন বিডি বাইক কমিউনিটিগুলোতে বেশ সরব। বিকেলের মধ্যে ফিরে এলাম আবার লন্ডনে।
সেই সন্ধ্যায় মীর ভাইয়ে বাসায় দাওয়াত ছিল। প্রায় ১০ বছর পর আকিব ভাই, সজল ভাই, আভিনা ভাবিসহ অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। খাওয়া হলো জম্পেশ, আড্ডা হলো চুটিয়ে। যদিও সময়ের কারণে শুধু ভাবির হাতের চাটগাঁইয়া বিরিয়ানি খাওয়া হলো না এবার।
এবার ফেরার পালা। পরের দিন সকালে ফিরতি পথে রওনা হব, তাই না চাইলেও বেশি রাত করা যাবে না। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। দেখতে দেখতে কীভাবে যেন পাঁচটা দিন কেটে গেল। এবার ফেরার পালা।
তাই আগেভাগে ৭০ ইউরো দিয়ে ফেরির টিকিট কেটে রেখেছি। আমার বাইকের চেইনে লুব্রিফিক্যান্ট স্প্রে করে নিই। আমারটা শেষ হয়ে যাওয়ায় তানজিল ভাই যেটা দিয়েছেন, তা দিয়ে বাকি রাস্তা সহজেই কাভার যাবে। পরদিন সকাল ঠিক আটটায় রওনা দিই। ডোভার হয়ে আবার কালিয়াস। ফেরিতে উঠে পড়ি।
বাইক নিচে রেখে তৃতীয় তলায় উঠে কিছু স্যুভেনির কিনি। ফেরি ছাড়ে। আমি ডেকে উঠে দেখছি, আস্তে আস্তে ব্রিটিশ উপকূল ছেড়ে ফেরিটি ফ্রান্সের দিকে রওনা দিচ্ছে। বাইরে প্রবল বাতাস। ফেরির ওপর থেকে বাতাসের গর্জন শুনছি আর হালকা বৃষ্টির ফোঁটা মুখে এসে পড়ছে। অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমিও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারব। হাঁটাহাঁটি করতে করতে বিশ্রাম নেওয়া হলো না আর। প্রায় ৯০ মিনিটের মতো যাত্রা শেষে ফ্রান্সের উপকূল দেখা দিল। জ্যাকেট আর রেইনকোট জড়িয়ে ডেক থেকে নামার প্রস্তুতি নিলাম। ফেরির ভেহিকল ম্যানেজমেন্ট খুবই ভালো লাগল আমার। নির্ঝঞ্ঝাটভাবে ফেরি থেকে এক্সিট নিলাম।
শেষ পর্যন্ত আবার এসে পৌঁছালাম ফ্রান্সের উপকূলে। আমি দেরি না করে রওনা দিলাম বেলজিয়ামের পথে। ব্রাসেলসে এক রাত থাকব। একটা এয়ার বিএনবি বুকিং দিয়ে রেখেছি। ফ্রান্সের থেকে বেলজিয়ামের রাস্তাগুলো বেশ চওড়া। সূর্যের তাপ আমার যাত্রাকে উপভোগ্য করে তুলেছে। কোনো বিভ্রাট ছাড়াই আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসে পৌঁছালাম। চিলেকোঠায় একটা সুন্দর রুম। টিপটপ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গোসল সেরে, খেয়েদেয়ে বেরিয়ে গেলাম ব্রুসেলস দেখতে। আমার খুব ভালো লাগল শহরটাকে। বেশ আধুনিক। শহরের সিটি সেন্টারটা বেশ ছোট।
অনেক বার আর পাব আশপাশে। সিটি সেন্টারের রাস্তায় স্থানীয় লোকজন ও এমার্জেন্সি ভেহিকল ছাড়া কেউ গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে পারে না। হাঁটার জন্য আদর্শ জায়গা। সূর্য এখন কমলা রঙের পোশাক পরেছে। ওপরে হালকা নীল আকাশ; চারপাশে লোকজনের সরব উপস্থিতি আজকের বিকেলটাকে মাতিয়ে রেখেছে।
অনেক হাঁটলাম সেদিন। সন্ধ্যা হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে জনসমাগম বেড়ে গেল। অল্প পেঁয়াজ দিয়ে রাঁধা পাস্তাটা খেতে অসাধারণ লাগল। সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে মাঝরাত হলো; তাই ফিরেই ঘুমিয়ে গেলাম। কারণ, পরদিন ভোরে রওনা দিতে হবে। এবার গন্তব্য লুক্সেমবার্গ। (চলবে)
ছবি: লেখক