সফর শুরুর সময় তেমন একটা পরিকল্পনা করিনি। কোথায় থাকব, কী খাব ইত্যাদি। কিন্তু ফেরার সময় মোটামুটি সবকিছু পরিকল্পনামাফিক করেছি। লুক্সেমবার্গেও একটি অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করে রেখেছিলাম। অ্যাপার্টমেন্টের হোস্টের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয়। লেখার ধরন দেখেই বোঝা যায়, খুব অমায়িক ভদ্রমহিলা। হাস্যোজ্জ্বল ইমোজি দিয়ে আমাকে ঠিক সময়ে অ্যাপার্টমেন্ট প্রস্তুতির আশ্বাস দিয়েছিলেন। অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে সবকিছু প্রতিশ্রুতিমতোই পেলাম।
ব্রাসেলস থেকে লুক্সেমবার্গের দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। হাতে সেদিন অনেক সময় পেলাম ছোট্ট দেশটির ছোট্ট শহরটা ঘুরে দেখার। লুক্সেমবার্গের রাজধানী লুক্সেমবার্গ সিটি। ১৯৯৪ সালে শহরটি ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে মনোনীত হয়। শহরটি খুবই ব্যয়বহুল। পুরোটা বিকেল শহরে হেঁটে বেড়িয়ে সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরলাম।
ভোরের আলো ফোটার আগেই রওনা দিলাম জার্মানির উদ্দেশে। ইচ্ছা আছে স্টুটগার্টে রাত্রিযাপনের। জার্মানির কিছু রাস্তায় স্পিড লিমিট নেই, আগেই জানতাম। তুমুল বেগে আমার মনস্টার ছুটল স্টুটগার্টের দিকে। কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই পৌঁছালাম। মার্সিডিজ ফ্যাক্টরির বেশ কাছেই ছিল আমার অ্যাপার্টমেন্ট।
ফ্রেশ হয়ে শহরে ঘুরে বেড়ালাম। এবার হেঁটে নয়, বাইকে। স্টুটগার্ট বেশ বড় শহর। একটি টার্কিশ রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। কাঠি কাবাবটা খুবই মজার ছিল। ছিল বিভিন্ন ধরনের চাটনি, যাকে তারা সালসা বলে; সঙ্গে রাইস আর সালাদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো প্লেট সাবাড়। মাত্র ১৪ ইউরো দিয়ে ভরপেট খেলাম। এবার বাসায় রওনা দেওয়ার পালা।
পরের দিন সকালে বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। বৃষ্টির প্রস্তুতি নিতে হবে।
সকালে উঠে দেখলাম, আসলে সারা দিন বৃষ্টি হতে পারে। এ কারণেই যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি রওনা দিই। আমি যখন রওনা দিচ্ছি, তখনো অধিকাংশ স্টুটগার্টবাসী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রওনা দেওয়ার ১৫ কি ২০ মিনিট হয়েছে, এরই মধ্যে প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা অনুভব করলাম। ঝিরিঝিরি শুরু হয়েছে। কিন্তু তেমন কিছু নয়। রেইন জ্যাকেট আছে, কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
মিউনিখে পৌঁছানোর আগে ডাখাউ নামে একটি শহর আছে। শহরটি পরিচিত সেখানে একটি নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কারণে। আমি আগেও এসেছি। সময় আছে ভেবে চলে গেলাম আরেকবার।
‘আরবাইট মাখট্ ফ্রাই’, যার বাংলা অর্থ কাজ আপনাকে মুক্তি দেবে—লেখা আছে গেটের ওপরে। লেখাটি ছিল প্রপাগান্ডামূলক নাৎসি স্লোগান। বাইরের দুনিয়ার কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে তারা এ স্লোগান ব্যবহার করত।
এখানে বিনা মূল্যে ঢোকা যায়। ঢুকেই বিশাল মাঠ। এই মাঠেই কয়েদিদের রোলকল করা হতো। হাতের ডান দিকে মিউজিয়াম, যেখানে এই ক্যাম্পের ইতিহাস, স্মারক ইত্যাদি সংরক্ষিত আছে।
গ্যাস চেম্বারের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময় গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো এক অনুভূতি হচ্ছিল। কয়েদিরা যেন গ্যাস চেম্বারে ঢোকায় কোনো ধরনের বাধা না দেয়, তার জন্য এখানে ঢোকানোর আগে তাদের বলা হতো যে গোসল করানো হবে। মাথার ওপরে ঝরনাও লাগানো ছিল, কিন্তু পানির পরিবর্তে সেখান থেকে বের হতো বিষাক্ত গ্যাস।
গ্যাস চেম্বার থেকে বের হয়ে কিছু দূর হাঁটলে পিস্তল শুটিং রেঞ্জ। এখানে দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের গুলি করে হত্যা করা হতো। ভাবতেই অবাক লাগে, মাত্র ৮০ বছর আগেই ঘটেছে এই নির্মমতা।
জায়গাটা জঙ্গলের ভেতরে ঘন গাছপালায় ঢাকা। অনেক সুনসান। কিছু দূর যেতেই একটি গণকবরের দেখা মিলল। এখানেও নাম না জানা অনেক মানুষকে কবর দেওয়া হয়েছিল। আমার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল। মনটা খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে মানুষই বিশ্বমণ্ডলের সবচেয়ে হিংস্র প্রাণী।
বৃষ্টির দিন হলেও অনেক মানুষ ভিড় করেছে। স্কুলের ছাত্ররাও এসেছে শিক্ষাসফরে। আর আছে মৃত কয়েদিদের পরিবার-পরিজন। দুই ঘণ্টা হিটলারের সেই মৃত্যুকারখানা ঘুরে দেখলাম।
সেখানে ছোট একটি রেস্টুরেন্টও রয়েছে। দুপুরে খেয়ে নিলাম সেখানে। সারা দিন আকাশ বেশ মেঘলা ছিল। আমি বের হব, এমন সময় আবার ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হলো। তবে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মিউনিখ আসামাত্রই বৃষ্টি থেমে গেল।
আমিও তেল নিলাম, কিছুক্ষণ শহরটা ঘুরে, সোজা অস্ট্রিয়ার দিকে রওনা দিলাম। জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়া ঢোকামাত্রই বেশ জোরেশোরে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। আসল পরীক্ষা অভিযানের শেষ দিন। নিয়তি যেন সব পরিকল্পনা আগে থেকেই করে রেখেছিল। ঠান্ডায় হাত জমে যাওয়ার অবস্থা। হাইওয়ের বাতাস আর বৃষ্টির পানি কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল।
অস্ট্রিয়ার তিরোল প্রদেশের পাহাড়ি রাস্তায় তখন আমি, ব্রেনার পাস দিয়ে ইতালি ঢুকব। এ অঞ্চলে বছরের বেশির ভাগ সময় হাড়কাঁপানো ঠান্ডা থাকে। হ্যাঁ, এ কারণেই বলেছিলাম যে আসল পরীক্ষা। ১৩০ কিলোমিটার জায়গায় ৩০-৪০ কিলোমিটার বেগে বাইক চালাচ্ছি। দৃষ্টিসীমা খুবই সীমিত। সামনে সবকিছু ঝাপসা। রেইনকোট ভেদ করে পানি জ্যাকেটের ভেতর গিয়ে ঢুকেছে। প্যান্টটাও ভিজে গেছে। জুতার ভেতরে পানি জমে গেছে। ভীষণ অস্বস্তিকর এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু করার কিছু নেই, দাঁতে দাঁত চেপে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া। পরবর্তী পাঁচ ঘণ্টা প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি ইতালি প্রবেশ করি।
রাত তখন নয়টা কি সাড়ে নয়টা। আমি বাসার নিচে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। হেলমেট খুলে মাথায়, মুখে মেখে নিচ্ছি বৃষ্টির ফোঁটা। ঘাম আর বৃষ্টিতে শরীর ভিজে একাকার। আমি আনন্দে ভিজে চলেছি। হ্যাঁ, অনেকেই সোফায় বসে টিভির রিমোট হাতে আমার অভিযানকে পাগলামি বলেছে ঠিকই; কিন্তু আমি ভীষণ খুশি এই ভেবে যে তাদের আশ্বস্ত অন্তত করা যাবে যে ইচ্ছাশক্তি আর বিশ্বাসে মেলায় বস্তু। তাই তর্কের প্রয়োজন নেই।
আনন্দ ভাগ করলে বাড়ে, তাই আমার এই রোমাঞ্চকর সফরের গল্প ভাগ করে নিলাম সবার সঙ্গে। আমাকে ফিরে যদি কেউ প্রশ্ন করে যে আবারও এ অভিযানে যাব কি না? আমি নির্দ্বিধায় বলব, কবে যেতে হবে, আমি প্রস্তুত। সব শেষে সবিনয় জানিয়ে রাখতে চাই, এ পথে আমি যে গেছি, সে পথে এর আগের আমার জানামতে কোনো বাংলাদেশি যাননি। তাই আমার আনন্দটা একটু বেশিই। (শেষ)
ছবি: লেখক