ঢাকার দুর্গাপূজার ইতিহাস কত পুরোনো, সে প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল বেশ কিছুদিন ধরে। ঢাকার ইতিহাস ৪০০ বছরের বেশি। যেমন মুসলিম স্থাপত্যে সমৃদ্ধ এ শহর, তেমনি সনাতনী প্রাচুর্যে স্মৃতিময়। হৃদয়নাথ মজুমদার নামের এক আইনজীবী (১৮৬৪-১৯০৫) তাঁর আত্মজীবনীতে উনিশ শতকের সত্তরের দশকের নানা কথা বলেছেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে মুনতাসীর মামুন লিখেছেন ‘হৃদয়নাথের ঢাকা শহর’ বই। ঢাকার প্রধান ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে দুর্গাপূজার কথা সেখানে ছিল না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঢাকা ছিল বৈষ্ণব শহর। এই ধারা বজায় ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও লেখক ভবতোষ দত্তের (১৯১১-১৯৯৭) আত্মজীবনী ‘সাত দশক’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে সেই সময় ঢাকায় দুর্গাপূজা সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি।
ঢাকায় তখন অনেক মন্দির ছিল বটে, তবে সেগুলো ঝুলন উৎসবের সময় সাজানো হতো। দোল উৎসবের পরই ঝুলন উৎসব ছিল বৈষ্ণবদের অন্যতম বড় উৎসব। সাদ উর রহমানের ‘উৎসবের ঢাকা’ বই থেকে জানা যায়, দুর্গাপূজার সর্বজনীন রূপ দেখা যায় দেশভাগের পর। সে সময় সম্ভ্রান্ত অনেক হিন্দু ঢাকা ছেড়ে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তখন ঢাকায় এককভাবে পূজা আয়োজন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে চাঁদা তুলে পূজার আয়োজন করা হতো। যদিও তখনো পারিবারিকভাবে পূজার আয়োজন বাদ যায়নি। সেই ঐতিহ্য এখনো পুরান ঢাকায় কিছু কিছু থেকে গেছে। তেমন তিনটি মন্দিরে গিয়েছিলাম দুর্গাপূজার আয়োজন ও ইতিহাস জানতে।
ঢাকার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত বেইলী রোডের কাছেই সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের অবস্থান। উনিশ শতকের শেষের দিকে ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে মন্দিরটি বিখ্যাত হয়। ‘সিদ্ধেশ্বরী’ নাম থেকে মন্দিরটির নামকরণ হয়। চাঁদ রায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন বলে মনে করা হয়। কথা হয় মন্দিরের সেবক মানস গোস্বামীর সঙ্গে। তিনি জানান, ৩৩ বছর ধরে এই মন্দিরে দুর্গাপূজার আয়োজন হয়ে আসছে। গোঁসাই বংশের পৈতৃক ভিটার ওপর মন্দিরটি গড়ে উঠেছে।
গোস্বামীরা এখানকার ভূস্বামী ছিলেন, তাঁরাই পরবর্তীকালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি ৩০০ বছরের পুরোনো। ঐতিহাসিক মতে দেবী কালীর প্রতিমার আবিষ্কার হয় ১৬৬০ থেকে ১৬৮০ সালের দিকে। তখনই অখণ্ড ভারতের অনেক জায়গায় কালীর প্রতিমা অধিষ্ঠিত হয় বলে ধারণা করা হয়। ২৫০ বছরের পুরোনো ঢাকেশ্বরী মন্দিরের চেয়ে পুরোনো এই কালীমন্দির। ভেতরে স্থাপিত আছে কালীর প্রতিমা, যার পূজা করা হয় প্রতি সন্ধ্যায়।
মানস গোস্বামী বলেন, এ বছর মহালয়া শুরু হবে ২ অক্টোবর ভোর ৬টায়। ষষ্ঠীর দিন সকালে কল্পারম্ভ বা বিহিত পূজা দিয়ে শুরু, বিকেলে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস। সপ্তমীর দিন মহাস্থান, সন্ধ্যা আরতি এবং সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত রোজ থাকছে ভক্তদের জন্য দুপুরে প্রসাদ বিতরণ। সন্ধ্যায় থাকছে গান-নাচসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন, যার মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে অষ্টমী ও নবমীর দিন ধুনচি নাচের প্রতিযোগিতা। প্রতিবছর বিক্রমপুর থেকে আসেন ধুনচি শিল্পীরা। স্থানীয় নারীপুরুষ-নির্বিশেষে অনেকেই এতে অংশগ্রহণ করেন। প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লার তবলাবাদক মিলন ভট্টাচার্য সিদ্ধেশ্বরী পূজা কমিটির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক। তাঁর পরিচালনায় আয়োজনটি হবে বলে জানান মানস গোস্বামী।
যেকোনো ধর্মের যে কেউ এই আয়োজন দেখতে আসতে পারেন। ১০ বছর ধরে মাগুরা থেকে গুরু নামের এক মৃৎশিল্পী এসে এখানকার প্রতিমা গড়েন। প্রতিমার পুরো কাঠামো মাগুরা থেকে তৈরি করে আনা হয়। এখানে এনে মাটির প্রলেপ দিয়ে পরে রং করা হয়। সব কটি প্রতিমার পোশাক, গয়নাসহ সবকিছু মাটি দিয়েই সৃজন করা হয়। এ ছাড়া পুরো মণ্ডপটিকে কীভাবে সাজানো হবে, সেটাও তিনি নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। ভোগের ব্যাপারে তিনি জানান, দেবীর জন্য যে ভোগ দেওয়া হয়, সেখানে পূজার প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫টি পদ থাকে। ভোগের প্রসাদে থাকে সবজিখিচুড়ি ও পায়েস। ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সবার জন্যই থাকে এই প্রসাদ।
ঢাকার আদি উপাসনালয় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন জনহিতৈষী কাজের জন্য প্রশংসিত। ১৯১৪ সালে ঢাকার গোপীবাগে মিশনটি প্রতিষ্ঠা করেন স্বামী প্রেমানন্দ। ঢাকার নবাব সলিমুল্লা ও নবাব পরিবারের সঙ্গে স্বামী প্রেমানন্দের বিশেষ সখ্য ছিল। আহসানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠার পেছনে রামকৃষ্ণ মিশনের যে বিশেষ প্রেরণা ছিল, তার উল্লেখ পাওয়া যায় খোদ খানবাহাদুরের উক্তিতে। তিনি বলেন, ‘দুস্থের সেবা করাই উক্ত মিশনের (রামকৃষ্ণ মিশনের) লক্ষ্য। ইহার দ্বারা কত স্থানে হাসপাতাল, শিক্ষামন্দির, পান্থশালা প্রস্তুত হইতেছে, আর আমরা নিজের সেবায় দিবারাত্র ব্যস্ত। মোছলেম সমাজে এই অভাব দেখিয়া আহসানিয়া মিশন গঠন করা হইয়াছে।’ (খানবাহাদুর আহসানউল্লা, ‘আমার শিক্ষা ও দীক্ষা’, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৬৮)। মূলত সব ধর্মের মানুষেরা আসেন এখানে, মিশনের বাইরের দাতব্য কেন্দ্র থেকে জনকল্যাণমূলক কাজ করা হয়। পূজার সময় আশপাশের দরিদ্র ও দুস্থ মানুষদের দান করা হয়, যা পূজার অন্যতম উদ্দেশ্য।
পূজার মণ্ডপ হয় বাইরের মাঠে। সনাতন প্রথা অনুযায়ী এবং মন্ত্রে ও শাস্ত্রে উল্লেখিত বর্ণনা অনুযায়ী তৈরি করা হয় প্রতিমা। এবার কিছু কিছু মন্দিরে চার দিন পূজা হলেও বিশুদ্ধ পঞ্জিকামতে রামকৃষ্ণ মিশনে পাঁচ দিনই পূজা হবে। মহাঅষ্টমীর দিন প্রতিবছর জাঁকজমকপূর্ণভাবে কুমারীপূজা পালন করা হয়। এবার নিরাপত্তার কারণে কুমারীপূজা হবে না বলে জানান রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরের সেবক। রামকৃষ্ণ মিশনে সব জপ, মন্ত্র ও প্রথা মেনে বিস্তারিতভাবেই সব সময় পূজা করা হয়। দুর্গা প্রতিমার মণ্ডপ রামকৃষ্ণ মিশনের বেলুড় মঠের আদলে তৈরি করা হয়। দেবীর শাড়ি মিরপুর বেনারসি পল্লি থেকে নেওয়া হয়। দেবীকে পরানো হয় অলংকার।
রামকৃষ্ণ মিশনের ভোগের প্রশংসা সবার মুখেই শোনা যায়। রামকৃষ্ণ মিশনের মিডিয়া সেন্টারের অফিস সহকারী নিপুণ রায় জানান, মিশনের হেঁশেলে নিজস্ব ভান্ডারি বা রাঁধুনি আছেন, যিনি ভোগের রান্নাগুলো করেন। সেখানে সবজিখিচুড়ি, পায়েস ও চাটনি দেওয়া হয়। ভোগ পর্যাপ্ত পরিমাণ রান্না করা হয়, কারণ, সব ধর্মের অনেক মানুষের সমাগম হয়। কেউ যাতে খালি হাতে ফিরে না যায়, সে চেষ্টা থাকে আয়োজকদের। তাঁরা বিশ্বাস করেন ‘যত মত, তত পথ’। এটা ছিল শ্রীরামকৃষ্ণেরই মত। এই দীক্ষা তিনি সবাইকে দিয়ে গেছেন।
তাই সব ধর্মের মানুষের জন্য দ্বার খোলা এই মঠের। অন্যান্য মন্দিরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকলেও রামকৃষ্ণ মিশন ব্যতিক্রম। এখানে কেবল পূজা, অর্চনা, মন্ত্রপাঠ, অঞ্জলি এসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানই থাকে। শাস্ত্র অনুযায়ী এখানে পূজা করা হয় বলে ভক্তদের ভিড় এখানে বেশি থাকে। রামকৃষ্ণ মিশনে স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকেই দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। ৭১-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুই বছর পূজা বন্ধ ছিল। এরপর ১৯৭৩ সাল থেকে আবার শুরু হয় দুর্গাপূজা। দেবীর পূজায় অত্যাবশ্যকীয় হলো লাল জবা, শিউলি, অতসী ফুল। দেবীর পছন্দ লাল ফুল। তাই মণ্ডপে এই ফুল থাকবেই।
রমনা কালীমন্দির ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দিরগুলোর একটি। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। মন্দিরটি প্রায় এক হাজার বছরের পুরোনো বলে বিশ্বাস করা হয়। ইংরেজ আমলে এই মন্দির আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রমনা পার্কে (এর বর্তমান নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এর অবস্থান। ঘোড়দৌড়ের মাঠের মাঝখানে প্রাচীরঘেরা মন্দিরে ভদ্রকালীর প্রতিমা সুন্দর একটি কাঠের সিংহাসনে স্থাপিত ছিল। এই প্রতিমার ডানদিকেই ছিল ভাওয়ালের কালী প্রতিমা।
মন্দিরের উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিমে ছিল পূজারী সেবায়েত ও অন্য ভক্তদের থাকার ঘর। পাশে একটি শিবমন্দির, একটি নাটমন্দির ও সিংহদরজা ছিল। সে সময়কার মানুষের পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে ভাওয়ালের রাণি বিলাসমণি কালীবাড়ির সামনে একটি দিঘি কাটিয়েছিলেন। তবে ইংরেজ আমলের নথিপত্র অনুসারে দিঘিটি কাটিয়েছিলেন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ডস সাহেব। বর্তমানে এই দিঘি রমনার কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের স্মৃতি বহন করছে। ভাওয়াল রাজা ও নবাব বোর্ডের ট্রাস্টিদের জায়গা এটি। রমনা কালীমন্দিরের উত্তর পাশে ছিল মা আনন্দময়ীর আশ্রম। ‘শাহবাগের মা’ নামে পরিচিত এই সন্ন্যাসিনী ছিলেন ঢাকার নবাবের শাহ বাগানের তত্ত্বাবধায় করমণী মোহন চক্রবর্তীর স্ত্রী।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী মন্দির ও আশ্রমে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত ও সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। ২০০৯ সালে মন্দিরটিকে ভারত সরকারের অর্থায়নে বর্তমান কাঠামো দেওয়া হয়। পুরোনো কাঠামোটি এখান থেকে একটু দূরেই অবস্থিত। পাশের পুরোনো ঘাটের সিঁড়ি এখনো আছে। কথা হয় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সুজিত চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে মূলত কালীপূজা হয়। তবে বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে দুর্গাপূজা করে আসছি ১৫ বছর ধরে।
এখানে যে আনন্দময়ীর পূজা করা হয়, তিনি সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর গুরু মা ছিলেন। তাই একে বলা হয় আনন্দময়ী আশ্রম, যেখানে একাত্তরের আগে আড়াই শ পরিবার বসবাস করত। রাজনৈতিক নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ভারতীয় হাইকমিশনের সহযোগিতায় এটির পুনর্নির্মাণ করা হয়।’
সুজিত চক্রবর্তী জানান, যখন থেকে দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হয়েছে, সে সময় থেকেই প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। সব ধর্মের মানুষেরা আসেন। কেবল হিন্দু নয়, সব ধর্মের মানুষই এখানে দান করেন। প্রতিবছর মাটির প্রতিমা তৈরি করা হয়। মায়ের শাড়ি কেনা হয় মিরপুর বেনারসি পল্লি থেকে। দেবীর দুটি শাড়ি লাগে। রমনা কালীমন্দিরে দেখা গেল, কালীর দুই পাশে থাকে তাঁর সহচরী জয়া ও বিজয়া। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে ধর্মীয় নাটক, নাচ, গান থাকে। তিন বছর ধরে ধুনচি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে।
পূজার দশমী ছাড়া রোজ প্রসাদ বিতরণের আয়োজন থাকে। প্রসাদ নিতে সব ধর্মের মানুষ আসেন। এমনকি কেউ যদি বাসায় প্রসাদ নিতে চান, সেটা নেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। প্রধান পুরোহিত বলেন, ‘আমাদের প্রসাদ কখনো শেষ হয় না। যতক্ষণ ভক্ত বা দর্শনার্থী আসবেন, আমাদের প্রসাদ থাকবে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আমরা খানিকটা শঙ্কায় ছিলাম এবাবের পূজার আয়োজন নিয়ে। তবে আমরা আশাবাদী এবং আমরা প্রস্তুত। এবার মেট্রোরেল আছে। তাই আশা করা যায় যে সব শঙ্কা কাটিয়ে মানুষ আসবে পূজায়।’
সর্বজনীন এই উৎসবের মাধ্যমে কাটুক শঙ্কা। মানুষের মনে ফিরে আসুক স্বস্তি। মঙ্গলময় হয়ে উঠুক শারদ উৎসব।
ছবি: প্রতিবেদক