ভ্রমণে ভোজনে ৩: প্রাচীন বোহেমিয়া রাজ্য ভ্রমণে যা খেয়েছি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমার মতো বাজেট ট্রাভেলারের জন্য কোনো নির্দিষ্ট দেশের খাদ্য–সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া খানিকটা কষ্টসাধ্য। তারপরও ভ্রমণের সঙ্গে অল্প করে হলেও স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণের চেষ্টা করি।

আপেল ও চিজকেক
আপেল ও চিজকেক

প্রথমে বলছি বোহেমিয়া রাজ্যের কথা। প্রাচীন বোহেমিয়া রাজ্য বর্তমানের চেক প্রজাতন্ত্র। এ অঞ্চলটি মূলত বোহেমিয়া রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। যেখানে বোহেমিয়ান রাজা-বাদশাহ, বিশেষ করে হোলি রোমান সম্রাটদের বসবাস ছিল।

চেক প্রজাতন্ত্রের সংক্ষিপ্ত নাম চেকিয়া, মধ্য ইউরোপের একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। এটি দক্ষিণে অস্ট্রিয়া, পশ্চিমে জার্মানি, উত্তর-পূর্বে পোল্যান্ড এবং পূর্বে স্লোভাকিয়া সীমান্তে অবস্থিত।

বিজ্ঞাপন

সে সময় নেদারল্যান্ডসে দ্য হেগ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সে পড়াশোনা করছিলাম। ছুটি পেলেই আশপাশের দেশগুলো ভ্রমণের পরিকল্পনা করতাম। চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাচীন ইতিহাসের কারণে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সব সময় আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।

প্রাগে ক্যাফের সামনে
প্রাগে ক্যাফের সামনে

চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগের পাথুরে পথ, ভালতাভা নদী, চার্লস ব্রিজ, রোমান ইতিহাস, অগণিত স্থাপত্য, কুটনা হোরা শহরের কঙ্কালের গির্জা এবং অবশ্যই ভিন্নধর্মী খাবার এক ঐন্দ্রজালিক মায়ায় আচ্ছন্ন করেছিল। সে গল্পই না হয় করা যাক আজ অনেক দিন বাদে। স্মৃতি সজীব হবে তাতে।

বিজ্ঞাপন

বিফ গুয়াশ (Beef Goulash)

চেক প্রজাতন্ত্রের খাবারের কথা এলে প্রথমেই বলতে হয় বিফ গুয়াশের কথা। শুধু চেক প্রজাতন্ত্র নয়, পূর্ব ইউরোপের দুপুর ও রাতের প্রধান খাবারই বিগ গুলাস।
ভ্রমণ শুরুর দিনই প্রাগ শহরের একাংশ দেখার পর সন্ধ্যাবেলা সিটি সেন্টারের একটি রেস্তোরাঁয় বিফ গুয়াশ খেয়েছি। যিনি আমার খাবার পরিবেশন করেছিলেন, তাঁর মুখ থেকেই অল্প করে শুনেছি বিফ গুয়াশ সম্পর্কে। স্টিফেন বলেছিলেন, এটি মূলত হাঙ্গেরির খাবার। আমি বহুবার এ কথা লিখেছি, সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, স্থাপত্যরীতি সতত বহমান। এক অঞ্চল থেকে অনায়াসেই অন্য ভূখণ্ডে যায়।

বিফ গুয়াশ বা গুলাশ
বিফ গুয়াশ বা গুলাশ

হাঙ্গেরির কিছু ঝাল–মসলার উপাদান বাদ দিয়ে, চেকরা নিজেদের মসলার স্বাদ যুক্ত করে তৈরি করে চেক প্রজাতন্ত্রের নিজস্ব বিফ গুয়াশ। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে এর মূল উপাদান গরুর মাংস। সঙ্গে আলু আর পাউরুটির ব্যবহার। আলু আর গরুর মাংসের চপ, সঙ্গে ঝোল ও পাউরুটি। রেস্তোঁরাগুলোতে আপনি দুই ধরনের গুয়াশ পাবেন; একটি স্টুর মতো অর্থাৎ ঝোলযুক্ত। অন্যটি আরও বেশি ঝোলসহ, যা স্যুপ হিসেবে দেওয়া হয়।

বিদ্র: এটাকেই হাঙ্গেরিতেস বলা হয় গুলাশ

সুইসকোভা (Svickova)

সুইসকোভার স্বাদ নিচ্ছেন লেখক
সুইসকোভার স্বাদ নিচ্ছেন লেখক

প্রাগ ও সমগ্র চেক প্রজাতন্ত্রের আরও একটি জনপ্রিয় খাবারের নাম সুইসকোভা। পাতলা করে কাটা গরুর মাংসের টুকরাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য ম্যারিনেট করে রাখা হয়। কারণ, আমি যখন খেলাম, দেখলাম মাংস একদম মুখেই মিলিয়ে গেল। মিষ্টি, নোনতা, টক স্বাদসহ একটি ঘন ও ক্রিমযুক্ত সসের সঙ্গে গরুর মাংসের পাতলা টুকরাও পাউরুটির সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। এটি বিফ গুলাসের কাছাকাছি একটি খাবারের মতোই মনে হয়েছে আমার। প্রাগ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে কুটনা হোরা শহর ভ্রমণে গিয়ে সুইসকোভা খেয়েছি।

ত্রেদেনিক (Trdelnik)

ত্রেদেনিক, প্রাগের সিটি সেন্টারে
ত্রেদেনিক, প্রাগের সিটি সেন্টারে

চিমনি কেক। সিটি সেন্টারের দোকানগুলোতে ত্রেদেনিকের পাশে এ রকমটাই লেখা দেখেছি। এ খাবারটি প্রাগ শহরের স্ট্রিট ফুড হিসেবে বিবেচিত। শীত কিংবা গ্রীষ্ম, যখনই আপনি প্রাগ ভ্রমণ করবেন, তখনই আপনার চোখে পড়বে। প্রাগ শহরের সিটি সেন্টারে সারি সারি দোকান রয়েছে, যেখানে বানানো হচ্ছে ত্রেদেনিক। কয়লার ওপরে তৈরি হচ্ছে। সিটি সেন্টারে প্রবেশ করলেই ত্রেদেনিকের খুশবু নাকে এসে লাগে। এর প্রস্তুত প্রণালিও দেখা যায়।

কয়লায় বেক করা হচ্ছে চিমনি কেক
কয়লায় বেক করা হচ্ছে চিমনি কেক

চিনি দিয়ে আচ্ছাদিত একধরনের রোস্ট করা ময়দার সিলিন্ডার বা বড় পাইপের মতো মনে হয়। ঋতুবিশেষে দুভাবে পরিবেশন করা হয়। যখন আবহাওয়া শীতল থাকে, তখন গরম চকলেটের সঙ্গে খাওয়া হয়। আবার আবহাওয়া উষ্ণ হয়ে গেলে সাধারণত বিভিন্ন স্বাদের আইসক্রিমসহ পরিবেশন করা হয়।

প্যালাচিঙ্কি (Palacinky)

প্যালাচিঙ্কি আসলে ক্ল্যাসিক ফরাসি ক্রেপস বা অস্ট্রিয়ান প্যালাচিঙ্কেনের মতো
প্যালাচিঙ্কি আসলে ক্ল্যাসিক ফরাসি ক্রেপস বা অস্ট্রিয়ান প্যালাচিঙ্কেনের মতো

আসলে এটি প্যানকেক। ফারাক কেবল আকারে। ইউরোপ যাওয়ার আগপর্যন্ত প্যানকেকের একটি আকারের সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম, যেটি দেখতে আমাদের চিতই পিঠার মতো। ডাচ প্যানকেক পিৎজার মতো। পিৎজা একটু স্বাস্থ্যবান আর ডাচ প্যানকেক তুলনায় পাতলা। চেক প্যালাচিঙ্কিও পিৎজার মতো; কিন্তু পাতলা। মূলত মিষ্টিজাতীয় খাবার এটি। দিন–রাতের যেকোনো সময় প্যালাচিঙ্কি খাওয়ার উপযুক্ত সময়। চিজ, চকলেট, শাকপাতাসহ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের প্যালাচিঙ্কি তৈরি হয়।

ভেজিটেবল ও চকলেট প্যালাচিঙ্কি
ভেজিটেবল ও চকলেট প্যালাচিঙ্কি

আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, প্যালাচিঙ্কি ক্ল্যাসিক ফরাসি ক্রেপস বা অস্ট্রিয়ান প্যালাচিঙ্কেনের মতো। একটি গোলাকার প্যানে একটি পাতলা স্তরে মসৃণ বাটার ছড়িয়ে এবং তারপর সামান্য বাদামি হওয়া পর্যন্ত উভয় পাশে ভেজে প্যালাচিঙ্কি তৈরি করা হয়। ভাজা প্যানকেকগুলো তারপর বিভিন্নভাবে ভরা হয়, রোলআপ করা হয় বা ভাঁজ করা হয়। এটিও পথ খাবারের আওতায় পড়ে।

প্রেতজেল (Pretzel)

ইউরোপ ভ্রমণে গেলে পাউরুটির বৈচিত্র্য চোখে পড়বেই। কত আকারের আর স্বাদের পাউরুটি হতে পারে, সেটি ইউরোপে গেলে বোঝা যায়। এর মধ্যে কোনো কোনোটি ভীষণ শক্ত; দাঁত দিয়ে কামড়ে খাওয়া দায়। চাকু, ছুরি ব্যবহার করতে হয় স্লাইস করার জন্য।

এত সবের মধ্যে প্রেতজেল আমার ভালো লাগত স্বাদ আর আকারের জন্য। প্যাঁচানো পাউরুটি। অনেকটা বড় জিলাপির মতো দেখতে। তবে জিলাপির মতো এত প্যাঁচ নেই। প্রেতজেলে মাত্র তিনটি ছিদ্র রয়েছে।

প্রেতজেল হাতে লেখক
প্রেতজেল হাতে লেখক

প্রেতজেলের আকারের ঐতিহাসিক পটভূমিও আছে। অনেকে বলেন, রুটির এই ধরন জার্মানি থেকে এসেছে। আরও মতবাদ রয়েছে এই পাউরুটির। প্রেতজেল ইউরোপীয় সন্ন্যাসীরা মধ্যযুগের প্রথম দিকে আবিষ্কার করেছিলেন—ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম শতকে। সন্ন্যাসীরা প্রেতজেলের স্বতন্ত্র গিঁটের আকৃতিটি পবিত্র ট্রিনিটির প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ব্যবহার করতেন। প্রেতজেলের তিনটি ছিদ্র পিতা, পুত্র আর পবিত্র আত্মার প্রতীক। এ তত্ত্বটি প্রেতজেলের ইতিহাসকে ধর্মীয় রীতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গেও সংযুক্ত করে।

এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সময় ভেজিটেবল সসে ভেজানো রোস্টেড চিকেন, আপেল স্ট্রুডেল, ভালতাভার পাড়ে বসে কফি, তিরামিসু খেয়েছি। চিজ ও অলিভ অয়েল মাখানো সবুজ সবজির সালাদ, টমেটো স্যুপ, মাশরুম স্যুপের সে কী স্বাদ! মনে করলেই পুরো ইউরোপের চিজ কেকের অমৃত স্বাদ এখনো টের পাই আমার স্বাদকোরকে।
লেখক: ভ্রামণিক
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন