১ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের ‘দ্য গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ ইকরামুল হাসান শাকিল শুরু করেছিলেন গত বছরেরে ১ আগস্ট। আর শেষ করলেন ৯ জুলাই ২০২৩। তাঁর এই দীর্ঘ অভিযাত্রা শেষ হলো কাঞ্চনজঙ্ঘা উত্তর বেজক্যাম্পে (প্যাঙপেমা, ৫ হাজার ১৪২ মি.) এসে; ৯ জুলাই ভোর সাড়ে চারটায় লোনাক থেকে রওনা হয়ে সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেজক্যাম্পে পৌঁছান তিনি।
ইকরামুল হাসান বলেন, দ্য গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল (নেপাল) অভিযানে তিনি মোট ২৯টি গিরিখাত অতিক্রম করেছেন। এর মধ্যে পাঁচ হাজার মিটারের অধিক উঁচুতে ছিল ১৪টি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতার ৫ হাজার ৭৫৫ মিটার আর সর্বনিম্ন ছিল ৪০৫ মিটার
হিমালয় পর্বতের পশ্চিমে নেপাল-তিব্বতের হিলসা এলাকার সীমান্ত গেট থেকে শুরু করে পূর্ব নেপালের কাঞ্চনজঙ্ঘা বেজক্যাম্প পর্যন্ত ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন শাকিল। আর এই দীর্ঘ পথকেই মূলত গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল বলা হয়ে থাকে।
গেল বছরের ১০ জুলাই তিনি ঢাকা থেকে উড়ে যান নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু। গ্রেট হিমালয়া ট্রেইলের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিতে কাঠমান্ডুতে ১৫ দিন কেটে যায়। এর মাঝে সব ধরনের জটিলতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা মিটিয়ে ফেলতে হয়েছে। ২৫ জুলাই কাঠমান্ডু শহর ছেড়ে বাসে করে পৌঁছান নেপালগঞ্জ। সেখান থেকে এয়ারলাইনসের ছোট একটি যাত্রীবাহী বিমানে করে ৪৯ মিনিটের আকাশপথে পৌঁছান সিমিকোট।
সেখানে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি তাঁর। কেননা এখানকার প্রকৃতির মেজাজ সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা ছিল। মূলত সেই অভিজ্ঞতাই তাঁকে সাহস জুগিয়েছে বলে জানান শাকিল।
২৮ জুলাই সকাল থেকে শুরু হয় অভিযান। একটানা ৪ দিন ট্রেকিং করে পশ্চিম নেপালের নেপাল–তিব্বত সীমান্তে ৩ হাজার ৬৪২ মিটার উচ্চতার হিলসা গ্রামে পৌঁছান তিনি।
আগস্টের প্রথম সকালেই হিলশা থেকে মূল অভিযান শুরু করে হোমলা, মোগু, ডোলপা, মানাং, গোরখা, রুবি ভ্যালি, ল্যাংটাং, হিলাম্বু, গৌরীশঙ্কর, সলোখুম্বু, এভারেস্ট বেজক্যাম্প, মাকালু ন্যাশনাল পার্ক হয়ে নেপালের উঁচু-নিচু দুর্গম ও বিপজ্জনক পথ হেঁটে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেজক্যাম্পে পৌঁছান শাকিল ২০২৩ সালের ৯ জুলাই সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সময় লেগেছে ৯৬ দিন এবং তাকে হাঁটতে হয়েছে মোট ১০২ দিন।
তবে এই অভিযান তিনি একনাগাড়ে করেননি। বরং এর মাঝে এই মুস্তাং জেলার অন্নপূর্ণা সার্কিট করে বাংলাদেশ–নেপালের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ–নেপাল ফ্রেন্ডশিপ অভিযানে দুবারের এভারেস্ট বিজয়ী এম এ মুহিতের নেতৃত্বে দোগারি ও ডোলমা খাং নামক দুটি ৬ হাজার মিটারের পর্বত অভিযানে অংশগ্রহণ করেন শাকিল। ৬ হাজার ৩৩২ মিটার উচ্চতার ডোলমা খাং পর্বত সফলভাবে আরোহণ করে পুনরায় গ্রেট হিমালয়া ট্রেইলে ফিরে আসেন।
নেপালের সব থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল, দুর্গম ও বিপজ্জনক এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে পথ হারাতে হয়েছে অনেকবার, অনাহারে দিন-রাত কাটাতে হয়েছে, কখনো কখনো পাথুরে পথে নামতে গিয়ে পড়ে বিপদের সম্মুখীনও হতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি পাহাড়ধসে পড়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তিনি।
আরও তো ছিল বরফ ফাটল ও হিমালয়ের বিপজ্জনক গ্লেসিয়ার পাড়ি দেওয়া, অসংখ্য বরফগলা ঠান্ডা পানির খরগ্রোতা নদী পারাপার। অর্থের অভাবে স্থানীয় মানুষের কাছে হাত পাততে হয়েছে; তবু হাল ছাড়েননি শাকিল, স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কায় ভেঙে পড়েননি এই অকুতোভয় তরুণ।
এই অভিযানে হিমালয় পর্বতের কোলঘেঁষা কত শত গ্রাম, নদী, জঙ্গল, পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য রোমাঞ্চ আর বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতাও হয়েছে তাঁর; এসব কোনো সন্দেহ নেই সুন্দর ও ভয়ানক। ট্রেইল শেষ করে শাকিল এখন কাঠমান্ডুতে অবস্থান করছেন। তবে এই অভিযানে তাঁর পাশে যাঁরা নানাভাবে থেকেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি।
শাকিল বলেন, এই পুরো অভিযানে স্থানভেদে তিনজন শেরপা গাইড অর্জুন রায়, তাশি গ্যালজেন শেরপা ও পাসাঙ শেরপা ছিলেন তাঁর সঙ্গে।
অত্যন্ত বিপদসংকুল ও কষ্টসাধ্য পর্বতাভিযান এই গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল; যা সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত ৫০ জনের কম পর্বতারোহী এই অভিযান পুরোটা সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। অথচ কঠিন এই অভিযান সফলভাবে শেষ করে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন শাকিল।
অভিযানে অনেকেই পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে পাশে দাঁড়ালেও এখনো সম্পূর্ণ অর্থ জোগাড় হয়নি। অভিযানে খরচের জন্য নেপালের বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ঋণ করেছেন। এ ছাড়া বকেয়া রয়েছে গাইড ও পোর্টারের বিল বাবদ প্রায় আড়াই লাখ টাকা।
তবে কাঠমান্ডু থেকে ইকরামুল জানালেন, ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও দেশকে সম্মানিত করাটাই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর এই অভিযান কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে নতুন এক পালক যুক্ত করেছে।
এখন প্রয়োজন তাঁর সহযোগিতা। তাহলে দ্রুতই সফলতার আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরতে পারবেন শাকিল।
ছবি: শাকিলের সৌজন্যে পাওয়া